Winter Weather : পশ্চিমী ঝঞ্ঝা ‘চুরি’ চিনের, ১২২ বছরে ‘উষ্ণতম’ ডিসেম্বর দেশে

Winter Weather : আবহবিদদের সহজ ব্যাখ্যা, গরম হাওয়ায় দেশে তাপমাত্রার পারদ চড়ে। আর হিমেল হাওয়ায় নিম্নমুখী দৌড় দেয় পারদ। এ বার হিমেল হাওয়ার আমদানিতেই ঘাটতি।

Winter Weather : পশ্চিমী ঝঞ্ঝা ‘চুরি’ চিনের, ১২২ বছরে ‘উষ্ণতম’ ডিসেম্বর দেশে
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Jan 04, 2023 | 10:49 PM

কমলেশ চৌধুরী

গ্রীষ্মে গরমের রেকর্ড ভাঙে। এটাই নিয়তি। তাই বলে শীতেও উষ্ণতার রেকর্ড! আবহাওয়ার খেয়ালিপনায় এটাও যেন নব্য-নিয়তি। দু’বছর আগে ১২১ বছরের মধ্যে দ্বিতীয় ‘উষ্ণতম’ শীতের সাক্ষী হয়েছিল দেশ। এ বার উষ্ণতার রেকর্ড সদ্যসমাপ্ত ডিসেম্বরেরও। মৌসম ভবনের রিপোর্ট, গড় তাপমাত্রার নিরিখে ১২২ বছরের মধ্যে ‘উষ্ণতম’ এ বারের ডিসেম্বরই। শুধু দেশে নয়, পূর্ব-উত্তরপূর্ব ভারতেও। যে অঞ্চলের অংশ বাংলা।

রেকর্ডের অঙ্ক সামনে এনেছে আবহাওয়া দফতর। জনতা অবশ্য আগেই ‘ডিসেম্বরি-গরম’ টের পেয়ে গিয়েছে। বড়দিনে হইহই করতে বেরিয়ে ঘামতে হয়েছে জনতাকে। সে দিন কলকাতার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা উঠে যায় ১৭.২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা পৌঁছে যায় ২৯ ডিগ্রির চৌকাঠে। বড়দিন যেতে না যেতেই কুড়ির উপরে উঠে যায় কলকাতার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। ডিসেম্বরের দ্বিতীয়ার্ধে কলকাতার পারদ ২০.৭ ডিগ্রিতে, এমনটা ১৯৬৯ সালের পর এ বারই প্রথম দেখল কলকাতা। অর্থাত্‍, ৫৩ বছরের রেকর্ড ভেঙে চুরমার। দিল্লি-রাজস্থানে বাংলার চেয়ে বেশি ঠান্ডা পড়ে, এ বারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু নিজের ভাগের তুলনায় কম ঠান্ডা পেয়েছে উত্তর-পশ্চিম ভারতও। মৌসম ভবনের তথ্য, ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ওই তল্লাটে শৈত্যপ্রবাহের কোনও বালাই ছিল না। শৈত্যপ্রবাহের যাত্রা শুরু হয় ১৮ ডিসেম্বর। তাও বিক্ষিপ্ত ভাবে, সময়সীমাও ছোট।

ঠিক সেই কারণেই একের পর এক উষ্ণতার রেকর্ড ডিসেম্বরে। মৌসম ভবনের রিপোর্ট বলছে, গড় তাপমাত্রার নিরিখে ১২২ বছরে উষ্ণতম এ বারের ডিসেম্বর। ভেঙেছে ২০০৮ সালের পুরোনো রেকর্ড। এক নজির পূর্ব-উত্তরপূর্ব ভারতেও। দেশের গড় সর্বোচ্চ ও গড় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা- দুই ক্ষেত্রেই ১২২ বছরের মধ্যে দ্বিতীয় উষ্ণতম বাইশের ডিসেম্বর। 

WEATHER

গ্রাফিক্স – অভীক দেবনাথ

শীতে কেন ‘উষ্ণতা’র রেকর্ড?

আবহবিদদের সহজ ব্যাখ্যা, গরম হাওয়ায় দেশে তাপমাত্রার পারদ চড়ে। আর হিমেল হাওয়ায় নিম্নমুখী দৌড় দেয় পারদ। এ বার হিমেল হাওয়ার আমদানিতেই ঘাটতি। আর এর পিছনে শক্তিশালী পশ্চিমী ঝঞ্ঝার ঘাটতিই সবচেয়ে বড় কারণ। ঝঞ্ঝা ভূমধ্যসাগর থেকে ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান পেরিয়ে কাশ্মীরে ঢোকে। বরফ পড়ে কাশ্মীর, হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ডে। বৃষ্টি হয় দিল্লি-সহ উত্তর ভারতে। পাহাড়ের তুষারছোঁয়া ঠান্ডা হাওয়া সমতলে নেমে কাঁপন ধরায়। নির্ধারিত সময়ের ফারাকে যত বেশি শক্তিশালী ঝঞ্ঝা, তত বেশি ঠান্ডার কামড়। এ বার ঘেঁটে গিয়েছে এই সমীকরণই। 

মৌসম ভবনের রিপোর্ট, ডিসেম্বরে ৭টি পশ্চিমী ঝঞ্ঝা এসেছে। এর মধ্যে মাত্র একটিই শক্তিশালী ছিল। বাকি ৬টিই দুর্বল। সবচেয়ে বড় কথা, ৬টি ঝঞ্ঝাই বেরিয়ে গিয়েছে অনেকটা উত্তর অক্ষাংশ হয়ে। অর্থাত্‍, কাশ্মীর-হিমাচল-উত্তরাখণ্ডের পরিবর্তে চিন হয়ে। তাহলে কী দাঁড়াল? পশ্চিমী ঝঞ্ঝা ‘চুরি’ চিনের, শীতে ‘হাত খালি’ দেশের!  

মৌসম ভবনের অ্যাডিশনাল ডিরেক্টর জেনারেল সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘শক্তিশালী পশ্চিমী ঝঞ্ঝা তেমন না আসায় এ বার ডিসেম্বরে পাহাড়ে খুব কম তুষারপাত হয়েছে। হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, সিকিম, কোথাওই তেমন বরফ পড়েনি। সমতলে বৃষ্টিও তেমন হয়নি। ফলে কখনও উত্তুরে হাওয়া তেমন একটা জোরদার হতে পারেনি।’’

বৃষ্টির ঘাটতি মূলত উত্তর-পশ্চিম, পূর্ব-উত্তরপূর্ব ও মধ্য ভারতে। অর্থাত্‍, দেশের মূল শীত বলয়ে। ডিসেম্বরে উত্তর-পশ্চিমে ভারতে ৮৩%, মধ্য ভারতে ৭৭%, পূর্ব-উত্তরপূর্ব ভারতে ৫৩% বৃষ্টির ঘাটতি। অথচ, ৫৭% বেশি বৃষ্টি হয়েছে দক্ষিণ ভারতে। চলতি শতাব্দীতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এর কারণ অবশ্যই সক্রিয় বঙ্গোপসাগর। শুধু ঘূর্ণিঝড় ‘মান্দাস’ নয়, আরও দু’টি গভীর নিম্নচাপও সৃষ্টি হয়। ফলে ডিসেম্বর জুড়ে অতিসক্রিয় ছিল উত্তুরে-পুবালি বাতাস। সঞ্জীববাবুর কথায়, ‘‘ভালো ঠান্ডার জন্য উত্তুরে-পশ্চিমী বাতাস শক্তিশালী হওয়া দরকার। অথচ, এ বছর উত্তুরে-পুবালি বাতাস অনেক বেশি সক্রিয় ছিল। ডিসেম্বরে বেশি তাপমাত্রার পিছনে এটাও একটা কারণ।’’

এ কি তবে বিশ্ব উষ্ণায়নের খাঁড়া? 

তথ্য বলছে, যত সময় এগোচ্ছে, তত উষ্ণ হচ্ছে দেশ-দুনিয়া। দেশের প্রথম পাঁচটি উষ্ণতম বছরে পাঁচটিই চলতি শতাব্দীর। প্রথম চারে ২০১৬, ২০০৯, ২০১৭, ২০১০। পঞ্চম স্থানে হালফিলের ২০২১। এই যে উষ্ণতার রেকর্ড তৈরি হচ্ছে, এর পিছনে শুধু গ্রীষ্মের হাত নেই। নেপথ্যে বর্ষা বা শীতে পারদের লাফও। মোদ্দা কথা হল, শীত আর আগের মতো নেই। কিছু কিছু জায়গায়, কিছু কিছু সময় হাড়-হিম শীত যে পড়ছে না, তা নয়। জমকালো শীত পড়ছে, কিন্তু তার বিস্তার কমছে, কমছে সময়সীমাও। সঞ্জীববাবুর ব্যাখ্যা, ‘‘অনেক বছরের তথ্য খতিয়ে দেখলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির স্পষ্ট প্রবণতা চোখে পড়ছে। এক এক বছরের মধ্যে আবহাওয়া খামখেয়ালিপনাও বাড়ছে। তবে ২০২১, ২০২২-এর তথ্য দেখে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছনো মুশকিল।’’ একই সুর পুণের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ট্রপিক্যাল মেটেরোলজির জলবায়ু বিজ্ঞানী পার্থসারথি মুখোপাধ্যায়ের গলাতেও। তাঁর কথায়, ‘‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে কি না, তা বোঝার জন্য ৩০-৪০ বছরের তথ্য ঘাঁটতে হবে। এ বছর শক্তিশালী ঝঞ্ঝা কম এসেছে। পুবালি বাতাস সক্রিয় থাকায় জলীয় বাষ্প বেশি ঢুকেছে। তাই শুকনো, ঠান্ডা বাতাস কোণঠাসা।’’

এই হতাশা-চিত্রের মধ্যেও সান্ত্বনা পুরস্কারের ব্যবস্থা রেখেছে প্রকৃতি। ডিসেম্বরে না হলেও, জানুয়ারিতে শীতের দাপট বাড়ছে। মঙ্গলবারই রাজস্থানের চুরুর তাপমাত্রা শূন্যের নীচে নেমেছে। বুধবার চার ডিগ্রিতে নেমেছে দিল্লির পারদ। এ বার বাংলার দুয়ারেও জাঁকিয়ে শীত। বৃহস্পতিবার বা শুক্রবার চলতি মরসুমের শীতলতম দিন হওয়ার জোর সম্ভাবনা। কলকাতার তাপমাত্রা ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নামার ইঙ্গিত। 

মহানগরের তাপমাত্রা ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস মানে যে বড়সড় পারাপতন, এমন নয়। গত ১০ বছরের হিসেব বলছে, ২০২১ বাদ দিয়ে প্রতি বছর জানুয়ারিতেই আলিপুরে বারোর নীচে নেমেছে পারদ। ২০১৩ সালে তো ৯ ডিগ্রির শৈত্যপ্রবাহেও কেঁপেছে কলকাতা। তবে যে মরসুমে শীত উষ্ণতার রেকর্ড ভাঙছে, তখন পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মতো যা জোটে, তাই অমূল্য!