পিকের কোন চালে ‘চেক মেট’ হলেন বিজেপির চাণক্য?

"উনি ভোটের হিসেব করুন। কোথায় কী দরকার আছে দলকে বলুন, সে ঠিক আছে। কিন্তু ওঁর লোকেরা সরাসরি নির্দেশ দিচ্ছে রাজনীতির লোকেদের।'' প্রশান্ত কিশোর (Prashant Kishor) কে এভাবেই তোপ দেগেছিলেন বিক্ষুব্ধ তৃণমূল নেতারা।

পিকের কোন চালে 'চেক মেট' হলেন বিজেপির চাণক্য?
অলংকরণ: অভিজিৎ বিশ্বাস
Follow Us:
| Updated on: May 02, 2021 | 7:59 PM

কলকাতা: বাংলায় পালা করে এসেছেন কেন্দ্রের গেরুয়া নেতারা। হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, এ বার দুশো আসন নিয়ে ‘সোনার বাংলা’ গড়বে বিজেপি। এ দিকে মোদী-শাহ জুটির সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে কার্যত কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee)। একের পর এক তৃণমূল নেতা ঘর ছেড়ে যোগ দিয়েছেন গেরুয়া শিবিরে। তবে তাঁরা যত না অসন্তুষ্ট দল বা নেত্রীর প্রতি, তার চেয়ে ঢের ক্ষুব্ধ ছিলেন নির্বাচনী স্ট্র্যাটেজিস্ট প্রশান্ত কিশোরের (Prashant Kishor) উপর। কেউ বলেছেন ভাড়াটে। কারোর বা কটাক্ষ, দায়িত্ব নিয়েই তৃণমূলকে হারাবেন প্রশান্ত কিশোর। একুশের ভোটের ফলাফলে (West Bengal Assembly Election Result) প্রশান্ত-অঙ্কে যেন নীরব জবাব পেলেন দলত্যাগী তৃণমূলীরা। প্রশান্ত প্রত্যয়ে হার মানলেন দুশো পার করার চ্যালেঞ্জ নেওয়া বিজেপির চাণক্য অমিত শাহও (Amit Shah)।

পিকেতে ‘এলার্জি’ তৃণমূলত্যাগীদের:

বারাকপুরের বিদায়ী তৃণমূল বিধায়ক শীলভদ্র ভোটের আগেই জানিয়ে দিলেন তিনি আর তৃণমূলের টিকিটে লড়বেন না। অচিরে যোগ দিলেন বিজেপিতে। একুশের ভোটে বিজেপির প্রার্থীও হন। কিন্তু দল বা তৃণমূল নেত্রীকে নিয়ে যত না তাঁর ক্ষোভ, তার কয়েকগুণ বেশি উষ্মা প্রশান্ত কিশোরের প্রতি। বলেছিলেন,”উনি ভোটের হিসেব করুন। কোথায় কী দরকার আছে দলকে বলুন, সে ঠিক আছে। কিন্তু ওঁর লোকেরা সরাসরি নির্দেশ দিচ্ছে রাজনীতির লোকেদের।” শীলভদ্রের কথায়, “একটা লোকের ৪০ বছরের রাজনৈতিক জীবন, আর ওঁর এমবিএ পাশ করা বা আইআইটি পাশ করা ছেলেরা এসে বলছে, আপনাকে কিছু করতে হবে না! ভোটে জেতাব আমরা। কারণ আমরা রাজনীতিটা বেশি বুঝি।” শীলভদ্র এও হুঁশিয়ারি দেন, কিশোরের পন্থা এখানে কাজ করবে না, কারণ এটা বাংলা। বিহার, উত্তর প্রদেশ বা দিল্লি নয়।

শীলভদ্র দত্ত যে ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করেছেন, তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বলেছেন শিবপুরের বিদায়ী বিধায়ক, প্রবীণ নেতা জটু লাহিড়ি। বলেছিলেন, ‘ভাড়াটে লোক দিয়ে ভোটে জেতা যায় না।’ প্রত্যাশিতভাবেই সেই মন্তব্য নিয়ে এখন তুমুল বিতর্ক ছড়ালেও নিজেই নিজেকে প্রার্থী ঘোষণা করে যেন প্রশান্ত কিশোরকে তিনি বোঝাতে চাইলেন তাঁকে তিনি পরোয়া করেন না। এদিকে তৃণমূল তাঁকে টিকিট দেয়নি। এবং শেষ পর্যন্ত বিজেপিতে গিয়েও ভোটে লড়ার লাইসেন্স পাননি চারবারের বিধায়ক।

তৃণমূল নেত্রীকে ৫০ হাজার ভোটে হারানোর হুঁশিয়ারি দেওয়া শুভেন্দু সবচেয়ে বেশি তোপ দেগেছেন প্রশান্ত কিশোরের দিকেই। প্রশান্ত কিশোরের টুইট চ্যালেঞ্জকে পাল্টা কটাক্ষ করে তাঁর বার্তা ছিল, যে টাকা দিয়ে তাঁকে তৃণমূল এনেছিল তা ‘কাটমানি’-র অর্থ। এবং পিকে-র বিজেপি ১০০ আসন পেলে পেশা ছেড়ে দেওয়ার চ্যালেঞ্জকে ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন, বিহারে যাওয়ার আগে বাংলার সব টাকা ফিরিয়ে দিয়ে যেতে হবে তাঁকে। কারণ সেগুলো কাটমানির অর্থ, বাংলার মানুষের সম্পত্তি।

নন্দীগ্রামে তৃণমূল নেত্রীর কাছে হার মানতে হয়েছে শুভেন্দুকে। তেমনি তাঁর মতো বিক্ষুব্ধ তৃণমূল নেতাদের জন্য ঘাসফুল শিবিরের এই বিপুল জয় যেন এক প্রশান্ত অথচ তীক্ষ্ণ বাণ হয়ে রইল।

প্রশ্ন হল, কীভাবে এতটা নিশ্চিত ছিলেন পিকে?

দলবদলুরা চলে যাওয়ায় শূন্যস্থান অবশ্যই সৃষ্টি হয় তৃণমূলে। কিন্তু পিকে-তেই আস্থা রেখেছিলেন মমতা। তাই দলবদলুদের মিরজাফর, বিশ্বাসঘাতক বলে পরিষ্কার জানিয়েছিলেন, এঁরা জোয়ারে আসে, ভাটায় চলে যায়। এমনকি এও জানান, ভোটের পর এই দলবদলুদের নিয়ে একটা পরিকল্পনা করবেন। দলের দরজা যেন আর তাঁদের জন্য খোলা না হয়। বিজেপির সব হিসেব এলোমেলো করে দেওয়া প্রশান্ত কিশোরের এই সাফল্যের পিছনে রয়েছে রাজনৈতিক পাটিগণিত।

আরও পড়ুন: ‘ঠিক প্রমাণ করার জন্য ধন্যবাদ,’ বাজি জিতেও পেশা ছাড়ছেন প্রশান্ত কিশোর!

কার্যত প্রতিটি বুথ ধরে সমীক্ষা করে সেখানকার সমস্যা জেনে নেওয়া এবং সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা তৈরি করেছেন তিনি। ‘দুয়ারে সরকার,’ ‘বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়’ ইত্যাদি কর্মসূচির পিছনে রয়েছে পিকের হাত। তাছাড়া পেশাদারদের দিয়ে অভিনব প্রচার ও রাজনৈতিক কর্মসূচি তৈরি করা এবং সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা রূপায়ণের পন্থা বাতলে দিয়েছেন তিনি। বিভিন্ন রকম সমীকরণ নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে তার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখে, খামতি দূর করে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে যাওয়ার পরিকল্পনাও প্রশান্তের সাফল্যের চাবিকাঠি। বারবার বুঝিয়েছেন ‘বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়।’ এখানে অন্য কোনও নেতা ফ্যাক্টর নন।