Education System: থমকে ‘মিষ্টি বুলি’, পড়াশোনায় ‘ভাগ’ বসিয়েছে কোভিড

ASER Report: এবার ভাবুন। একটু সময় নিয়ে ভাবুন। শিক্ষাক্ষেত্রে ঠিক কতটা বড় ক্ষত তৈরি করেছে কোভিড। এই সমস্যার কি আদৌ সুরাহা সম্ভব?

Education System: থমকে 'মিষ্টি বুলি', পড়াশোনায় 'ভাগ' বসিয়েছে কোভিড
রিডিংও পড়তে পারছে না অনেকে।
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Jan 23, 2023 | 6:42 PM

সুমন মহাপাত্র

কলকাতা শহরে একটা ইএম বাইপাস আছে। বড় বড় রাস্তা। হাইরাইজ বিল্ডিং। এত উঁচু যে তাকাতে গেলে মাথা ঘুরে যেতে পারে। সেই কলকাতা শহর থেকে অনেক দূরে, আমরা এলাম সুন্দরবনে। আমরা গেলাম দার্জিলিং, বাঁকুড়া, পুরুলিয়াতেও। ঘুরলাম জেলার স্কুলগুলোতে। মেঠো রাস্তা, টিউবওয়েলের জল, উনুনের রান্না, এখানেও মিড ডে মিল হয়। পড়াশোনা হয়। ফারাক একটাই, কলকাতা শহরের হাইরাইজ বিল্ডিংগুলো এখানে মাটি কামড়াতে পারেনি। ফলে এখানে অধিকাংশ বাবা মায়ের প্রথম পছন্দ মফস্বলের নামকরা সরকারি স্কুলটা। এই স্কুলগুলোতে নাম তোলার জন্য এখনও জোর টক্কর চলে। কলকাতাতে তো সরকারি স্কুলকে খুব একটা কেউ পাত্তাই দেয় না। ওই যে হাইরাইজ বিল্ডিংগুলোর চাকচিক্যের কাছে হেরে যায় বিদ্যানিকেতন বা বিদ্যালয়। গ্রাম বাংলা আর শহর বাংলার ফারাক বোঝাচ্ছি না। তবে যে তথ্য সামনে এসেছে, তা কিন্তু যথেষ্ট উদ্বেগের। গ্রাম হোক বা শহর, ভাবলে অবাক হতে হবে, ক্লাস ফাইভ, সিক্সের ৭০ শতাংশ পড়ুয়াই রিডিং পড়তে পারছে না। ASER রিপোর্টে এর একটা প্রতিফলন ছিল, তবু সরেজমিনে খতিয়ে দেখতে বেরিয়ে পড়ল টিভি নাইন বাংলা।

ভোর ৫টা আমাদের পথচলা শুরু হয়। ইএম বাইপাস ছাড়িয়ে সরু গলি পেরিয়ে আমরা এসে পৌঁছলাম মথুরাপুরের একটা গ্রামে। এবড়ো খেবড়ো রাস্তা, বাসে বাদুড়ঝোলা নয়, ভিড় এতটাই বাসের ওপরে সমান্তরাল আরেকটা বাস চলে। কলকাতা হলে লোকে বলত বিপজ্জনক, এখানে এটাই স্বাভাবিক ছবি। দু’পাশে পুকুর পেরিয়ে পৌঁছনো গেল একটা বাড়িতে। এই বাড়ির ছেলে ক্লাস ফাইভে পড়ে। গ্রামের নামকরা স্কুলে তার রোল নম্বর ৩০। হাতে দেওয়া হল, ক্লাস ফাইভেরই বাংলা পাঠ্য বই। দু’ লাইন পড়তে বলা হল। সে পড়ল। যা পড়ল তা অনেকটা এরকম- “ম যূ ব-এ শূন্য র। ম-ম-ম…………” তারপর নিস্তব্ধতা। পাঠ্য বইতে লেখা ছিল, “ময়ূর, চড়াই, কোকিল মিষ্টি বুলি বলে।”

বোঝাই গেল, সমস্যাটা ঠিক কতটা গভীরে। ছেলেটি নিজেই বলল, কোভিডের সময় যখন স্কুল বন্ধ ছিল, তখন টিউশনের দিদিমণি মেয়েকে নিয়ে অন্যত্র চলে গিয়েছিলেন। ফলে পড়াশোনা বিশেষ হয়নি। এখন সে বিধানকাকুর কাছে পড়ে। কাকুর আবার মুদির দোকান। পড়াও চলে, আনার হিসেবনিকেষও। অগত্যা ‘ম যূ ব-এ শূন্য’। স্কুল খুলেছে বটে, তবে এখনও আগের ক্লাসের শূন্যস্থানই পূরণ হয়নি। ফলে এখনও রিডিং পড়ার চেষ্টা চলছে।

পাশের বাড়িতেও দেখা গেল সেই ছবি। দু’ কামরার ঘর। এক কামরায় থাকেন ক্লাস সিক্সের ছাত্রীর দাদু-দিদা। বাবা, মা ও ওই ছাত্রী এক ঘরে। বই রাখার একটা তাক আছ। তবে সেখানে চালের বস্তা, বই আর কেরোসিন তেল একসঙ্গে থাকে। জিজ্ঞাসা করা হল, হোয়াট ইজ ইওর ফাদার্স নেম? বাঙালি ছেলে বলল, “আমার ফাদার কা নাম….”। পরের প্রশ্ন, হোয়াইট ইজ ইওর ভিলেজস নেম? উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছে ছেলেটা। কিন্তু ইংরেজি বলতে হবে ভেবে মুখ দিয়ে আর শব্দ বেরচ্ছে না। কথায় কথায় জানা গেল, ছেলেটির বাবা লরি চালান। মা কলকাতায় কোনও একটা কাজ করতে যান। কী কাজ ছেলেটাও জানে না। কোভিডের সময় স্কুল বন্ধ ছিল। কোচিং বন্ধ ছিল। মোবাইলে পড়াশোনা কীভাবে হবে? বাবা তো ফোন নিয়ে বেরিয়ে যান। দাদু-দিদাকে দেখে রাখার দায়িত্ব সামলাতে সামলাতেই কোভিড কেটে গিয়েছে। কখন যে দু’টো ক্লাস পাশ করে গিয়েছে সে নিজেই জানে না।

আমরা গিয়েছিলাম এলাকার এক স্কুলেও। স্যর নিয়ে গেলেন ক্লাস ফাইভের বি সেকশনে। অঙ্কের ক্লাস। বোর্ডে দিন, তারিখ ও পড়ার বিষয় লেখা। ৩ জনকে ডাকা হল ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে। ভাগ করতে দেওয়া হল। ৪৬৫ কে ৫ দিয়ে ভাগ। প্রথম জন ভাগের উত্তর লিখল ৩২৫। পরের জন, ব্ল্যাকবোর্ডে চকই ছোঁয়াল না। পরের জন অবশ্য ঠিক উত্তর লিখল। অঙ্কের স্যর পুলকবাবু বলেন, “অনেকেই সাধারণ যোগ বা ভাগ পারে না। আসলে এরা তো অনেকেই গরিব পরিবার থেকে আসে। কোভিডের সময় আর্থিক অনটন ছিল। পড়াশোনা বিশেষ করতে পারেনি। তবে অনেকে পড়েছে। তারা পারছে।”

এবার ভাবুন। একটু সময় নিয়ে ভাবুন। শিক্ষাক্ষেত্রে ঠিক কতটা বড় ক্ষত তৈরি করেছে কোভিড। এই সমস্যার কি আদৌ সুরাহা সম্ভব? সরকার আগের ক্লাসের পড়া পড়ানোর জন্য সেতুবন্ধনের চেষ্টা যে করেনি তা নয়। স্কুলে স্কুলে পৌঁছেছে ব্রিজ কোর্সের বই। পুরনোটাকে ঝালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। তবে লাভের লাভ খুব একটা হয়নি। কারণ হিসেবে একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক চন্দন মাইতি বলছেন, “হাইজাম্প হয়ে গিয়েছে। হুট করে প্রোমোশন হয়েছে। পড়ুয়ারা বুঝতেই পারেনি। আর গ্রামের স্কুলে কে ব্রিজ কোর্স পড়াবে বলুন তো? মাস্টারমশাইরাই তো নেই। সবাই তো শহরমুখী। গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছেন। সরকারের যে কী অদ্ভুত নীতি! আর স্কুলগুলোতে শূন্যপদে ধুঁকছে। যোগ্যরা রাস্তায়, সেতুটা বাঁধা হবে কী করে। তবু আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”

প্রায় একই মত শিক্ষাবিদ দেবাশিস সরকারেরও। তিনি বলছেন, “এটাকে শুধুমাত্র কোভিডের একটা তাৎক্ষণিক প্রভাব বললে ঠিক হবে না। প্রায় এক দশক ধরে শিক্ষাক্ষেত্রের একটা প্রভাব এটা। যোগ্য শিক্ষক নেই, রেশিও ঘেঁটে গিয়েছে। সরকার তো বটেই, মাস্টারমশাইদেরও আরও বাড়তি দায়িত্ব নিতে হবে, নাহলে স্কুলছুট আটকানো যাবে না।”

পরিশেষে একটা কথাই বলা চলে, আমরা যখন ফিরছিলাম, এক জায়গায় প্রচুর মোয়া বিক্রি হচ্ছিল। সেখানে দেখা পাওয়া গেল বছর চোদ্দোর সাদ্দামের। সে বলল, ও এখানেই কাজ করে। কথায় কথায় জানা গেল, কোভিডের সময় থেকে ওই যে স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়েছে। আর শুরু হয়নি। একদম মথুরাপুরের গ্রামে কেটে যাওয়া একটা ঘুড়ির মতো। আর ফেরত আসছে না। লাটাই দিয়ে শুধু দড়ি গোটানোর কাজ চলছে।