CPIM: পান্তাভাত, কাঁচালঙ্কা আর সিপিএম = দেবলীনা হেমব্রম!
Deblina Hembram: দেবলীনা দায়িত্ব পাওয়ায় খুশি বাঁকুড়া জেলার সিপিএম নেতৃত্ব। নেত্রী হিসেবে দেবলীনাকেই দেখতে চান কর্মীদের বৃহত্তর অংশ।
কলকাতা: ২০১৯ সালের ব্রিগেড। বামেদের তাবড় নেতারা একে একে বক্তৃতা দিয়ে মঞ্চ ছাড়ছেন। মাঝে মাঝে সমর্থকদের মধ্যে স্লোগান উঠছে। হঠাৎ সাদা শাড়ি পরা, আদিবাসী নেত্রীর মুখে শোনা গেল, ‘রক্ত দেব, তবু মাথা নত করব না।’ কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে তিনি বলে উঠলেন জঙ্গলমহলের ভাষা। সবগুলো শব্দের অর্থ আমজনতার বোধগম্য না হলেও, সে দিন দেবলীনা হেমব্রমের ব্কৃতা যেন শিরায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল বাম সমর্থকদের। আজ ৬ বছর পর ইতিহাস তৈরি করলেন সেই দেবলীনা হেমব্রম।
৩৪ বছরের শাসনকাল বা তারপরও সিপিএম-এ কখনও যা হয়নি, সেটাই হয়েছে ৬১ বছরের দেবলীনার সঙ্গে। একইসঙ্গে দলের তিনটি পদের দায়িত্ব পেয়েছেন আদিবাসী-মহিলা নেত্রী দেবলীনা। সম্প্রতি বাঁকুড়ার জেলা সিপিএমের সম্পাদক হিসেবে তাঁর নাম ঘোষিত হয়েছে। সিপিএম-এর ইতিহাসে প্রথম কোনও মহিলাকে এই পদ দেওয়া হল। দেবলীনাকে এভাবে সামনে আনা কি সিপিএম-এর কোনও বড় কৌশল? চর্চা শুরু হয়েছে রাজনৈতিক মহলে।
প্রশ্ন উঠছে, আদিবাসী ভোট টানতেই কি দীর্ঘদিনের লড়াকু নেত্রীর কাঁধে এমন গুরুদায়িত্ব দেওয়া হল? কারণ ভোটে জিততে না পারলেও দেবলীনার জনপ্রিয়তার কথা সবারই জানা। বাঁকুড়ার ঘরের মেয়ে দেবলীনা।
বাঁকুড়ার রানিবাঁধের তিনবারের বিধায়ক দেবলীনা হেমব্রম। ১৯৯৬, ২০০৬ ও ২০১১ সালে জয়ী হয়ে বিধায়ক হন দেবলীনা। বাম আমলের শেষের দিকে, ২০০৬ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত রাজ্যের উপজাতি বিষয়ক মন্ত্রীও ছিলেন তিনি। আদিবাসী কল্যাণ দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন দেবলীনা। ২০২২ সালের এপ্রিলে সিপিএম-এর পার্টি কংগ্রেসে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য করা হয় দেবলীনাকে।
লড়াকু নেত্রী হলেও দেবলীনা এক সহজ সত্ত্বা বরাবরই চর্চিত হয়েছে রাজনৈতিক মহলে। মন্ত্রী বা বিধায়ক হওয়ার পরও কখনই মাটি থেকে দূরে চলে যাননি বলে মনে করেন তাঁর দলের কর্মীরা। বাঁকুড়ার সিপিএম সমর্থকদের কথায়, দেবলীনা সাধারণ মানুষের সঙ্গে সহজে মিশে যাওয়ার কতটা ক্ষমতা রাখেন। খুব সাধারণভাবে তিনি মানুষের সঙ্গে মিশতে পারেন। যে কোনও পরিবারের সঙ্গে, তাদের ঘরের বারান্দায় বসে পান্তা খেয়ে নিতে পারেন অনায়াসে। সাধারণ কর্মীদের সঙ্গে রাস্তায় দাঁড়িয়ে গল্প করেন। সভামঞ্চে দাঁড়িয়েও এমনভাবে কথা বলেন, যার সঙ্গে সহজেই নিজেকে মিলিয়ে নিতে পারে সাধারণ মানুষ। আর দেবলীনার এই সহজ সত্ত্বাকেই সিপিএম ব্যবহার করতে চাইছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহলের একাংশ।
২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে বিধায়ক থাকাকালীন বিধানসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে আক্রান্ত হতে হয়েছিল দেবলীনাকে। হামলার অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। চিটফান্ড দুর্নীতি সম্পর্কে তৃণমূলের বিরুদ্ধে বক্তব্য পেশ করছিলেন তিনি। সেই সময় তৃণমূলের বিধায়কদের হাতে আক্রান্ত হন বলে অভিযোগ করেন দেবলীনা। অসুস্থ অবস্থায় দেবলীনাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়। সেই ঘটনাতেও তাঁর লড়াকু ‘ইমেজ’ আরও একবার মন কাড়ে সিপিএম সমর্থকদের।
বর্তমানে দেবলীনা সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, রাজ্য সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য এবং বাঁকুড়ার জেলা সম্পাদক। সিপিএমে এমন নজির খুব বেশি নেই। ২০১২ সালে বাম নেতা গৌতম দেব একসঙ্গে তিনটি পদে ছিলেন। তাঁকে নিয়ে ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সিপিএম নেতৃত্ব। এবারও দেবলীনার ক্ষেত্রে পলিটব্যুরো থেকে বিশেষ অনুমতি নেওয়া হবে বলে জানা গিয়েছে। শমীক লাহিড়ি ও সুমিত দে-র ক্ষেত্রে একই পদ থাকলেও ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। তাই আদিবাসী ও মহিলা হিসেবে এই সিদ্ধান্ত গোটা দেশের সিপিএম-এর মধ্যেই সম্ভবত নজিরবিহীন। ত্রিপুরা বা কেরল, কোথাও সিপিএম এমন কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি।
তবে এই গুরুদায়িত্ব পাওয়ার পরও দেবলীনা বলছেন, ‘আমি কেউ নই।’ বাঁকুড়ার জেলা সম্পাদক পদ পাওয়ার পর দেবলীনা বলেন, “আমি কে? আমি কেউ না। সবাইকে নিয়ে আমাদের দল। নেতা-কর্মী-সাধারণ মানুষ সবাইকে নিয়েই ‘আমি’।” তিনি বুঝিয়ে দেন, সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করবেন তিনি। দেবলীনা আরও বলেন, “বাঁকুড়া জেলার সব মানুষকে সঙ্গে নিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করব। মানুষের অধিকার হারিয়ে যাচ্ছে। রাজ্য ও কেন্দ্র দুই সরকার গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিচ্ছে। পরিবেশ নষ্ট করতে চাইছে। সেটা ফিরিয়ে আনার লড়াই আমার।”
আদিবাসীদের লড়াইয়ের ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করে দেবলীনা বলেন, “ইংরেজদের তাড়িয়েছি। আর আজও অধিকারের জন্য লড়াই করতে হচ্ছে। কাজের সন্ধানে অন্য রাজ্যে যেতে হচ্ছে।” তাঁর কথায়, জাতি-ধর্ম আলাদা হতে পারে, মন্দির-মসজিদ আলাদা হতে পারে, কিন্তু মানুষের খিদেটা এক।
দেবলীনা দায়িত্ব পাওয়ায় খুশি বাঁকুড়া জেলার সিপিএম নেতৃত্ব। নেত্রী হিসেবে দেবলীনাকেই দেখতে চান কর্মীদের বৃহত্তর অংশ। জেলার বর্ষীয়ান বাম নেতা অমিয় পাত্র বলেন, ‘যোগ্যতমকেই জায়গা দেওয়া হয়েছে। সাংগঠনিকভাবে ঠিক করা হয়েছে দেবলীনাকে সম্পাদক করা হবে। সবাই এতে সমর্থন করেছেন।’
তিনি মনে করেন, শ্রমজীবী, খেটে খাওয়া মানুষ, যাঁরা বঞ্চনার শিকার, তাঁরাই একসময় লাল ঝান্ডাকে শক্ত করেছিল। আজ নানা কারণে সেই সব মানুষের সঙ্গে দলের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। তাই আবার তাদের কাছাকাছি যেতে চায় সিপিএম। সেই ক্ষেত্রে দেবলীনার এই পদ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন তিনি।
তবে শাসক দল দেবলীনাকে ‘অচল আধুলি’ বলেই মনে করছে। তৃণমূল সাংসদ অরূপ চক্রবর্তী বলেন, “উনি তো আগেও মন্ত্রী ছিলেন। ওঁর আমলেই তো পার্টিটা ডুবেছিল। অচল আধুলি দিয়ে কিছুই হবে না। জনসমর্থন যেখানে নেই সেখানে দেবলীনা কেন, অন্য কেউ এলেও চলবে না।”