Buddhadeb Bhattacharya: কেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পাম অ্যাভিনিউয়ের দু’কামরায় ফ্ল্যাট আঁকড়ে রইলেন বুদ্ধবাবু?
Buddhadeb Bhattacharya: সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মলিন হয়েছিল দেওয়ালের রঙ। আবাসনের হতশ্রী অবস্থা দেখে উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন খোদ মমতা বন্দোপাধ্যায়ও। কিন্তু সেই ফ্ল্যাট ছেড়ে কোনওদিন এক পা-ও নড়েননি বুদ্ধবাবু। প্রায় ৫০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে ১১ বছর মুখ্যমন্ত্রী থেকেছেন, তখনও নয়।
কলকাতা: চলে গেলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন, চলাফেরা প্রায় বন্ধ ছিল। মাঝে মাঝেই ভর্তি হতে হত হাসপাতালে। কিন্তু হাসপাতালে থাকাটা মোটেই পছন্দ ছিল না তাঁর। বাড়ি যাওয়ার খবর পেলেই চোখে-মুখে ধরা পড়ত অনাবিল আনন্দ। রাইল্স টিউব, বাইপ্যাপ মেশিন নিয়ে বাড়িতেই স্বছন্দ ছিলেন তিনি। বাড়ি মানে তাঁর সেই পাম অ্যাভিনিউয়ের দু’কামরার ফ্ল্যাট। জীবনের শেষ দিনটাও কাটালেন সেই ফ্ল্যাটেই। হাসপাতালে যেতে হয়নি আর। সেই সুযোগও তিনি দেননি। জীবনের শেষ সময়টা ছিলেন প্রাণ প্রিয় বাড়িতেই।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মলিন হয়েছে দেওয়ালের রঙ। আবাসনের হতশ্রী অবস্থা দেখে উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ও। কিন্তু সেই ফ্ল্যাট ছেড়ে কোনোদিন এক পা-ও নড়েননি বুদ্ধবাবু। প্রায় ৫০ বছরের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে ১১ বছর মুখ্যমন্ত্রী থেকেছেন, একটানা ২৪ বছর ছিলেন বিধায়ক। প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র, দীর্ঘ রাজনৈতিক পথ পেরিয়ে রাইটার্স বিল্ডিং-এ পৌঁছে গেলেও তাঁর ঠিকানা বদলায়নি কখনও। কেন এত টান ছিল ওই দুই কামরার ফ্ল্যাটবাড়িতে? অতীতে এক সাক্ষাৎকারে নিজেই জানিয়েছিলেন বুদ্ধবাবু।
মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর চাইলেই সরকারি ব্যবস্থাপনায় থাকতে পারতেন তিনি। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের সরকারি বাসভবনে থাকার বন্দোবস্ত করা হয়। জ্যোতি বসু থাকতেন ইন্দিরা ভবনে। ২০০০ সালে যখন প্রথমবার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন, তাঁকে সেই সময় অন্য কোনও সরকারি ভবনে থাকার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, পাম অ্যাভিনিউয়ের ফ্ল্যাট ছাড়তে চাননি তিনি। যুক্তি ছিল, ‘পুরনো অভ্যাস ছাড়তে পারব না। কোনও অভ্যাসই না।’ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “আমার বই, আমার টেবিল.. ছেড়ে আসতে পারব না। অসুবিধা হবে আমার।”
তিনি তখন মুখ্যমন্ত্রী। দেশি, বিদেশি অতিথি, শিল্পপতিদের সঙ্গে তাঁর নিত্য ওঠাবসা। অনেকেই আসতেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। সরকারি বাসভবনে থাকলে, সেখানে অভ্যাগতদের সঙ্গে দেখা করতে পারতেন। তবে, বুদ্ধবাবু সেই সকল প্রয়োজন মেটাতেন রাইটার্সেই। প্রয়োজনে বেশি সময় থেকে যেতেন সেখানেও। দরকারে দিন-রাতও পড়ে থাকতেন অফিসে, কিন্তু নিজের বাড়ি নিয়ে কোনও আপোষ নয়।
বাড়ির প্রতি কেন এত টান? বোঝাতে গিয়ে বুদ্ধবাবু ওই সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “সেই কলেজ লাইফ থেকে যে ধরণের পোশাক পরতাম, এখনও তেমন পরি। যা খেতে পছন্দ করতাম, এখনও তাই খাই। যে ভাবে আড্ডা মারতাম, সেভাবেই আড্ডা মারি। ওটাই আমার সামাজিক স্তর। খুব বড়, একটা সাজানো গোছানো ঘরে গেলে আমার অস্বস্তি হবে, মনে হবে ফিশ আউট অব ওয়াটার।” শুধু তাই নয়, বুদ্ধবাবু বক্তব্য ছিল, তিনি খুব স্বাধীনতাপ্রেমী। তিনি বলেছিলেন, “আমি গোঁড়া নই, খুব স্বাধীনতা প্রেমী। ওই ঘরে থাকাটাও আমার একটা স্বাধীনতা।”
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর পর বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন মমতা বন্দোপাধ্যায়। তিনিও পূর্বসূরির মতোই টালির চালের বাড়ি ছাড়েননি। অনেকেই মনে করেন, ‘আমি তোমাদেরই লোক’ এটা বোঝাতেই অনেক রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীই বিলাস-ব্যাসন থেকে দূরে থাকেন। কিন্তু মমতার সঙ্গে সেই তুলনা মানতে রাজি ছিলেন না বুদ্ধদেব ভট্টাচাৰ্য। তিনি জানিয়েছিলেন, অতিথিদের সঙ্গে দেখা করার জন্য পাম অ্যাভেনিউয়ের ফ্ল্যাটে আলাদা ব্যবস্থা আছে তাঁর। ফলে বাড়ি ছোট হলেও কাজের ক্ষেত্রে কোনও অসুবিধা ছিল না।
বুদ্ধবাবুর পরিবারও সবসময় তাঁর এই সিদ্ধান্তকে স্বীকৃতি দিয়েছে। স্ত্রী মীরা ভট্টাচার্য বা সন্তান সুচেতনা ওই বাড়িতেই কাটিয়েছেন বরাবর। সাক্ষাৎকারে বুদ্ধদেব ভট্টাচাৰ্য বলেছিলেন, ‘ওরা খুব খুশি। মেয়ে আমাকে তিন বার বলেছে, বাবা একদম বাড়ি ছেড়ে যাবে না।’ শেষ দিন পর্যন্ত বাড়ি ছেড়ে যাননি বুদ্ধদেব।