Ratha Yatra 2022: মাত্র ৩ মাইল রাস্তা, তাও প্রতি বছর মাসির বাড়ি যাওয়ার জন্য নতুন রথ চাই জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরামের!
Puri Rath Yatra: তিনটি আলাদা রথে চড়ে সওয়ার হন পুরীর জগন্নাথ, বলভদ্র, সুভদ্রা। এই তিনটি আলাদা রথের আলাদা আলারা নাম রয়েছে। রথযাত্রা উৎসবের মূল দর্শনীয় দিকটিও হল এই রথ তিনটি।
রথযাত্রা (Ratha Yatra 2022) হিন্দুদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব। এতে রথের ওপর দেবতাদের মূর্তি স্থাপন করে রথ চালানো হয়। বিভিন্ন পুরাণে বিভিন্ন দেবদেবীর রথযাত্রার উল্লেখ আছে, যেমন ভবিষ্যপুরাণে সূর্যদেবের রথযাত্রা, দেবীপুরাণে মহাদেবীর রথযাত্রা, পদ্মপুরাণ, স্কন্দপুরাণ ও ভবিষ্যোত্তরপুরাণে বিষ্ণুর রথযাত্রা বর্ণিত হয়েছে। রথযাত্রা বা রথদ্বিতীয়া ভারতের ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গে ধুমধাম করে পালিত হয়। দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর কৃষ্ণের বৃন্দাবন প্রত্যাবর্তনের স্মরণে এই উৎসব আয়োজিত হয়ে থাকে। দেশের সর্বাধিক প্রসিদ্ধ রথযাত্রা ওড়িশার পুরী শহরের জগন্নাথ মন্দিরের (Puri Jaganath Temple) রথযাত্রা। পুরীতে রথ টানতে প্রতি বছর লক্ষাধিক পুণ্যার্থীর সমাগম হয়।
এ বছর রথযাত্রা পালিত হবে আগামী ১ জুলাই, সোমবার। বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে, ১৬ আষাঢ় মাসে পালিত হবে এই পবিত্র জগন্নাথ যাত্রা।
পুরীর রথযাত্রা
উড়িষ্যার প্রাচীন পুঁথি ‘ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ’ এ জগন্নাথদেবের রথযাত্রার ইতিহাস প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, এই রথযাত্রার প্রচলন হয়েছিল প্রায় সত্যযুগে। সে সময় উড়িষ্যা মালবদেশ নামে পরিচিত ছিল। সেই মালবদেশের সূর্যবংশীয় পরম বিষ্ণুভক্ত রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে ভগবান বিষ্ণুর জগন্নাথরূপী মূর্তি নির্মাণ করেন এবং রথযাত্রারও স্বপ্নাদেশ পান। পরবর্তীতে তাঁর হাত ধরেই পুরীতে জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ ও রথযাত্রার প্রচলন শুরু হয়। বাংলা আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে রথ উৎসব হয়ে থাকে। এই দিন দাদা বলরাম ও বোন সুভদ্রার সঙ্গে গুন্ডিচা মন্দিরে যান জগন্নাথ। সেখান থেকে সাতদিন পর নিজ মন্দিরে ফিরে আসেন। যাওয়ার দিনকে বলে সোজা রথ এবং একই পথে নিজ মন্দিরে ফিরে আসাকে বলে উলটা রথ। পরপর তিনটি সুসজ্জিত রথে চেপে যাত্রা শুরু করেন তারা। গুন্ডিচা মন্দির ভ্রমণকেই আবার মাসির বাড়ি যাওয়া মনে করেন অনেকে। পুরাবিদেরা বলেন, রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের স্ত্রীই ছিলেন গুণ্ডিচা।
পুরীতে জগন্নাথ, সুভদ্রা, বলভদ্রের রথযাত্রা ঘিরে একাধিক রহস্যময় তথ্য় উঠে আসে। কথিত রয়েছে , পুরীর রথযাত্রায় যিনি একবার রথের রশি ছুঁয়ে নেন, তাঁর সমস্ত ইচ্ছা পুরণ হয়। আর সেই থেকে রথের দড়ি ছোঁয়া ও টানবার পরম্পরা চালু হয়েছে। প্রতি বছর রথযাত্রার উদ্বোধন করেন সেখানকার রাজা। রাজত্ব না থাকলেও বংশপরম্পরা ক্রমে পুরীর রাজপরিবার আজও আছে। সেই রাজপরিবারের নিয়ম অনুসারে, যিনি রাজা উপাধি প্রাপ্ত হন, তিনিই পুরীর রাজা জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রাদেবীর পর পর তিনটি রথের সামনে পুষ্পাঞ্জলি প্রদান করেন এবং সোনার ঝাড়ু ও সুগন্ধী জল দিয়ে রথের সম্মুখভাগ ঝাঁট দেন। তারপরই পুরীর রথের রশিতে টান পড়ে। শুরু হয় জগন্নাথদেবের রথযাত্রা।
কৌলিন্য, জাঁকজমক ও জনসমারোহের হিসাবে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য হল পুরীর রথ। এখানকার বৈশিষ্ট্য হল -অন্য সব জায়গায় রথযাত্রায় একটা রথ দেখা গেলেও এখানে তিনটে রথ দেখা যায়। সারা বছর পুরীর মন্দিরে জগন্নাথদেব পূজিত হলেও সেখানে সকলের প্রবেশাধিকার ছিল না। তাই আপামর জনসাধারণ যাতে জগন্নাথদেবর দর্শন করতে পায় সে জন্যই এই রথযাত্রা – জগন্নাথের গুণ্ডিচা যাত্রা। জগন্নাথ দেবের রথের প্রতিটি অংশই অতি পবিত্র, কারণ তিনটি রথেই বিরাজ করেন তেত্রিশ কোটি দেবতা। তাই এই রথের রশি একটু স্পর্শ করা বা টানা মানে এই তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর চরণ স্পর্শ করা।
রথের চাকা
রথ তিনটির চাকার ব্যাস সাত ফুট। প্রতি রথেই ৩৪টি অংশ — চাকা, আরা, ডাণ্ডিয়া, বেকি, হংসপট, কানি, শঙ্খদ্বার, জালি, গইপট, সিংহাসন, রুশিপট ইত্যাদি। রথের চূড়ায় কলস ও সুদর্শন চক্র এবং সবার উপরে ধ্বজা। কয়েক টন ওজনের এই রথ তিনটি টানতে যে খুব শক্তপোক্ত রশি বা দৌড়ি (ওড়িয়া ভাষায়) লাগে তাতে সন্দেহ নেই। তবে এই রশি ১৯৯০ সাল পর্যন্ত কেরল থেকে আসত। আর এখন ওড়িশা কয়ার বোর্ড এই দড়ি তৈরি করে দেয়। তিনটি আলাদা রথে চড়ে সওয়ার হন পুরীর জগন্নাথ, বলভদ্র, সুভদ্রা। এই তিনটি আলাদা রথের আলাদা আলারা নাম রয়েছে। রথযাত্রা উৎসবের মূল দর্শনীয় দিকটিও হল এই রথ তিনটি। তিনটি রথ যাত্রার কিছু নিয়ম রয়েছে এবং রথের আকার, রঙেও ভিন্নতা দেখা যায়। প্রতি বছর উল্টোরথের পর রথ তিনটি ভেঙ্গে ফেললেও রথের পার্শ্বদেবদেবীর মূর্তি, সারথি ও ঘোড়াগুলিকে সযত্নে তুলে রাখা হয়।
তালধ্বজ: ৭৬৩টি ছোট বড় কাষ্ঠখণ্ড দিয়ে নির্মিত এই রথের উচ্চতা ১৩.২ মিটার। দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ৩৩’ x ৩৩”। চাকার সংখ্যা ১৪টি। ধ্বজার নাম উন্মনী এবং রশির নাম বাসুকী নাগ। ন’জন পার্শ্বদেবতা হলেন- গণেশ, কার্তিক, সর্বমঙ্গলা, প্রলম্ব, হলায়ুধ, মৃত্যুঞ্জয়, নাটেশ্বর, মহেশ্বর ও শেষদেব। দ্বারপাল রুদ্র ও সাত্যকি। সারথি মাতলি এবং রক্ষক বাসুদেব। রথের শ্বেতবর্ণের চারটি ঘোড়ার নাম তীব্র, ঘোর, শ্রম (স্বর্ণনাভ) ও দীর্ঘ (দীর্ঘশর্মা)। সুদর্শন চক্রের পাশে দুটি পাখির (কাকাতুয়া) নাম স্বধা ও বিশ্বাস। রথটি সবুজ ও লাল কাপড়ে মোড়া।
দেবদলন: ৫৯৩টি টুকরো কাঠ দিয়ে তৈরি এই রথের উচ্চতা ৪২’৩” বা ১২.৯ মিটার এবং দৈর্ঘ্য – প্রস্থ ৩১’৬” x ৩১’৬”। চাকার সংখ্যা ১২। ধ্বজার নাম নাদম্বিক এবং রশির নাম স্বর্ণচূড় নাগ। ধ্বজার পাশের পাখি দুটির নাম শ্রুতি ও স্মৃতি। রথটি লাল ও কালো কাপড়ে ঢাকা। ন’জন পার্শ্বদেবী হলেন -চন্ডী, চামুণ্ডা, মঙ্গলা, উগ্রতারা, বনদুর্গা, শূলিদুর্গা, শ্যামাকালী, বিমলা ও বরাহি। দ্বারপালিকা- ভূদেবী ও শ্রীদেবী। সারথি অর্জুন আর রক্ষক জয়দুর্গা। লাল রঙের ঘোড়া চারটির নাম রচিকা, মোচিকা‚ জিতা ও অপরাজিতা।
নন্দীঘোষ: এই রথ নির্মাণে ছোট বড় ৮৩২টি কাষ্ঠখণ্ড লাগে। উচ্চতা ৪৪’২” বা ১৩.৫ মিটার ও দৈর্ঘ্য প্রস্থ ৩৪’৬” x ৩৪’৬” পূর্বে অষ্টাদশ সিদ্ধির পরিচয়জ্ঞাপক ১৮টি চাকা থাকলেও বর্তমানে ১৬টি থাকে। রথের ধ্বজার নাম ত্রৈলোক্যমোহিনী ও রশির নাম শঙ্খচূড় নাগিনী। দ্বারপাল ব্রহ্মা ও ইন্দ্র। রথে উপস্থিত নয়জন পার্শ্ব দেবগণ হলেন — বরাহ, গোবর্ধন, কৃষ্ণ/গোপীকৃষ্ণ, নৃসিংহ, রাম, নারায়ণ, ত্রিবিক্রম, হনুমান ও রুদ্র। এঁদের সঙ্গে রয়েছেন ধ্যানমগ্ন ঋষিরা-নারদ, দেবল, ব্যাসদেব, শূক, পরাশর, বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র ও মরীচি। লাল ও হলুদ কাপড়ে মোড়া এই রথে কালো রঙের চারটি ঘোড়া হল — সংখ, বলাহক, শ্বেত ও হরিদাক্ষ। রথের সারথি মাতলি ও রক্ষক গরুড়। রথের কলসের নাম হিরন্ময়।
তথ্য সৌজন্য- শ্রীমৎ স্বামী অভয়ানন্দ দাস ও উকিপিডিয়া