ভাইরাস-যুদ্ধ শুরু হলে প্রাণে বাঁচতে কলকাতার পুরনো বাড়িই ভরসা, হঠাৎ কেন একথা বলছেন বিজ্ঞানীরা
Virus Outbreak: ভারত-চিন যুদ্ধে চিন যদি তাদের তৈরি ‘রেমেডি’ ব্যবহার করে, তা হলে দেশের যে কোনও প্রান্তে ঘরে বসেই মরতে হবে মানুষকে। কারও স্রেফ কিচ্ছুটি করার নেই। বাঁচার উপায় কী তাহলে একেবারেই নেই? না, তা নয়। উপায় রয়েছে। একদল বাঙালি বিজ্ঞানীই সেই পথ দেখাচ্ছেন।
সোমনাথ ভট্টাচার্য
যুদ্ধটা এখন আর শুধু বন্দুক হাতে, বিমানে বোমা ফেলে হচ্ছে না। দুনিয়ার অনেক দেশই জীবাণুযুদ্ধ বা বায়োলজিক্যাল বা ‘ভাইরাস ওয়ারফেয়ার-এর প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত, আর কয়েক বছর—ব্যস… তারপর হয়তো পুরোদস্তুর জীবাণুযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। ভাইরাস ওয়ার-এর পরিণাম কী হতে পারে, তার একটা ছোট্ট ট্রেলার—অন্তত ষড়যন্ত্র তত্ত্ব (Conspiracy Theory) যাঁরা বিশ্বাস করেন এবং বিশ্বাস করাতেও চান বিশ্ববাসীকে, তাঁদের যুক্তি অনুযায়ী—দেখা গিয়েছে ইতিমধ্যেই: কোভিড। দু’টি দেশ যদি একে-অন্যের বিরুদ্ধে এই ধরনের জীবাণু প্রয়োগ করে, তার ফল কী হতে পারে? খুব কম করে ভাবলেও সেটা শিউরে ওঠার মতো। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তেমনটা হলে সেকেন্ডে দেড় লক্ষ মানুষের চরম ক্ষতির আশঙ্কা। হ্যাঁ—একেবারে ঠিকই পড়লেন: মাত্র দেড় সেকেন্ডে ১,৫০,০০০ মানুষের চরম ক্ষতির আশঙ্কা। মৃত্যুর সংখ্যা নির্ভর করবে ভাইরাসের মারণক্ষমতার উপর। সেটা হাজার হতে পারে, আবার পৌঁছতে পারে কোটিতেও।
সাধারণভাবে ল্যাবরেটরিতে কৃত্রিমভাবে তৈরি মারণ ভাইরাস অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক। কোভিডের থেকে তো বটেই, এমনকী কোনও-কোনও ক্ষেত্রেও পরমাণু বোমার থেকেও। ‘প্রিভেনশন অফ বায়োলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার’-এর দাবি, এই রকম ভাইরাস হয়তো অনেক দেশের ল্যাবে তৈরিও হয়ে গিয়েছে। এগুলির পোষাকি নাম ‘ওয়ার রেডি ভাইরাস’ (War Ready Virus)—সহজ কথায় যুদ্ধ-প্রস্তুত জীবাণু। মানে যে জীবাণু নির্দেশ আসার সঙ্গে-সঙ্গে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করতে প্রস্তুত। চলতি বছরে অর্থাৎ ২০২৩-এর জুন মাসে এ ব্যাপারে একটি রিপোর্ট দিয়েছে ‘প্রিভেনশন অফ বায়োলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার’। কী তথ্য উঠে এসেছে এই রিপোর্টে? যা জানা যাচ্ছে আপাতত, তা এক টেক্কায় হারিয়ে দেবে কোনও সায়েন্স ফিকশন সিনেমা বা উপন্যাসকেও। আপাতত জানা যাচ্ছে, ল্যাবরেটরিতে মারাত্মক জীবাণু তৈরির চেষ্টায় রয়েছে বিশ্বের অন্তত ২২টি বড় দেশ। শুধু তাই-ই নয়, হাড়-হিম করে দেওয়া সেই রিপোর্ট মোতাবেক আরও জানা যাচ্ছে, কিছু ক্ষেত্রে ‘ওয়ার রেডি ভাইরাস’ তৈরির কাজও হয়তো শেষ। জেমস বন্ড যেমন পরিচিত 007-এর মাধ্যমে (কারণ বন্ড ‘license to kill’-এর অধিকারী), তেমনই এই ভাইরাসগুলিরও রয়েছে সাঙ্কেতিক নাম: ‘প্রিভেনশন অফ বায়োলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার’-এর রিপোর্ট বলছে, ‘ওয়ার রেডি ভাইরাস’-এর সাঙ্কেতিক নাম ‘রেমেডি’।
ভারত-চিন যুদ্ধে চিন যদি তাদের তৈরি ‘রেমেডি’ ব্যবহার করে, তা হলে দেশের যে কোনও প্রান্তে ঘরে বসেই মরতে হবে মানুষকে। কারও স্রেফ কিচ্ছুটি করার নেই। বাঁচার উপায় কী তাহলে একেবারেই নেই? না, তা নয়। উপায় রয়েছে। একদল বাঙালি বিজ্ঞানীই সেই পথ দেখাচ্ছেন। তাদের কেউ নিউ ইয়র্কবাসী, কেউ বা আবার শিলিগুড়ির যক্ষ্মা-বিশেষজ্ঞ। তাঁরা বলছেন, জীবাণুর প্রবেশটাকেই যদি কমিয়ে দেওয়া যায়, তাজা হাওয়ার হাতে তবে দুষ্টু জীবাণু জব্দ হবে। সেই রাস্তাও আছে। অবশ্যই আছে। সেটি নির্ভর করছে ‘এয়ার এক্সচেঞ্জ পার আওয়ার’-এর উপর। বিষয়টা কী? কোনও একটি ঘরে জমে-থাকা বাতাস যদি প্রতি ঘন্টায় ১০ থেকে ১৫ (গড়ে ১২) বার বদলে দেওয়া যায় (replacement) পরিশুদ্ধ হাওয়া বা বাতাস (air) দিয়ে, তবে সেখানে জীবাণু ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য।
কোন ধরনের বাড়ি-অফিসে এরকম সুবিধা রয়েছে, তার একটা তালিকা তৈরি করেছেন ‘প্রিভেনশন অফ বায়োলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার’ রিপোর্টের কারিগররা। এখানেই রয়ছে চমক। সবচেয়ে নিরাপদ জায়গার তালিকাটা অনেকটা এরকম:
এরও একটা হিসাব আছে।
ধরা যাক, কোনও ঘরের আয়তন যদি হয় ২০০ স্কোয়ার ফিট, তবে উন্মুক্ত দরজা জানালা ঘুলঘুলি ইত্যাদির মোট আয়তন অন্ততপক্ষে চল্লিশ স্কোয়ার ফিট হতে হবে। মোদ্দা কথাটা হল, পুরনো দিনের বাড়ি বলতে চোখে যা ভাসে, অর্থাত্ সপাট সোজা লবি, বিরাট বারান্দা, বিশাল জানলা, বড় দরজা, ঘরে একাধিক ঘুলঘুলি, তাই-ই। বাড়ির দেওয়াল আঠারো বা বিশ ইঞ্চির গাঁথনিতে তৈরি। পুরু ছাদ। এরকম একটা বাড়িতে জীবাণু সহজে দেখাতে পারবে না তার কেরামতি—অর্থাৎ মারণক্ষমতা। তাজা হাওয়ার সঙ্গে লড়তে-লড়তে জীবাণুর ক্ষমতা অনেকটা কমে আসবে। বাকিটা নির্ভর করছে আপনার-আমার ইমিউনিটির উপর। নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অর্ক চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, “পুরনো বাড়িতে জীবাণু আক্রমণে মৃত্যুর সম্ভাবনা ৯২ শতাংশ পর্যন্ত কম। গবেষণার তথ্য জানাচ্ছে, কলকাতায় ৬০ বছর বা তার পুরনো বাড়ির ৮৫ শতাংশই এই সব শর্ত পূরণ করছে। অর্থাত্ ছোট হোক বড়, পুরনো বাড়িতে আপনি সবথেকে নিরাপদ। এয়ারবোর্ন ইনফেকশন অর্থাৎ বায়ুবাহিত সংক্রমণ চট করে আপনাকে কাবু করতে পারবে না।” অর্কর আরও দাবি, “এয়ারবোর্ন ইনফেকশন চট করে কাবু করতে পারবে না, মানে কিন্তু এই ধরনের যাবতীয় অসুখ-বিসুখ থেকেও আপনি অনেক নিরাপদ। টিবি হোক বা কোভিড, এসব অসুখ কাবু করতে পারবে না সহজে।” এ তো না হয় গেল আশার কথা। আশঙ্কার দিকটা অনেক ভয়াবহ। বদ্ধ এসি ঘর বা কেবিন বিশেষত কাচের জানলা বা স্লাইডিং ডোর—এমন ক্ষেত্রে বিপদের সম্ভাবনা অনেক-অনেক বেশি। তাই বিজ্ঞানীরা দিচ্ছেন কিছু পরামর্শ:
(১) নতুন বাড়ি বানালে, পাল্লা দেওয়া জানালা অর্ডার দিন। (২) ঘরে থাকতেই হবে ঘুলঘুলি (৩) বেশ কয়েক ঘণ্টা এসি বন্ধ করে জানালা-দরজা খুলে রাখতে হবে। (৪) আসবাব যদি জানালা ব্লক করে অর্থাৎ আটকে দেয়, তাহলে তা সরিয়ে দিতে হবে।
তাই সব দিকে খতিয়ে দেখে বিজ্ঞানীদের বক্তব্য, ‘এয়ার এক্সচেঞ্চ পার আওয়ার’ (প্রতি ঘণ্টায় ঘরের বাতাস কতবার বদল বা পরিবর্তিত হচ্ছে)-এর হিসেবে ব্রিটিশ আমলের পুরনো বাড়িগুলির থেকে নিরাপদ আর কিছুই নেই। অদ্ভুত ব্যাপার বটে। পুরনো বাড়ি নিয়ে কত সমস্যা… বাড়িওয়ালা বিরক্ত, ভাড়াটেরা অতিষ্ঠ। পুরসভারও চিন্তার অন্ত নেই। একের পর এক বাড়ি ভেঙে পড়ছে। যাঁরা এখন বাড়ির বাসিন্দা, তাদের আফসোসের কারণ নেই। ‘এয়ার এক্সচেঞ্চ পার আওয়ার’-এর বিষয়ে কিছুমাত্র না-জেনেবুঝেই হয়তো বাড়ি তৈরি করা হয়েছিল বহু দশক আগে। আপনি সেইসব দূরদর্শী ইঞ্জিনিয়ারদেরই সুকর্মের ভাগীদার হয়ে রয়েছেন। ‘বায়োলিজক্যাল ওয়ার’ শুরু হলে এমন ক’টা বাড়ি আর এ শহরের বুকে থাকবে কে জানে?