Antarctica: ফুটন্ত জল মুহূর্তেই বরফ! ২৩ ঘণ্টার একটানা তুষার ঝড় সামলেও আন্টার্কটিকায় ফুটবল খেলে এলেন জলপাইগুড়ির প্রীতম
Antarctica: দুনিয়ার শীতলতম, শুষ্কতম, ঝোড়ো এবং জনবসতিহীন মহাদেশে আবহাওয়া সংক্রান্ত গবেষণা সেরে ফিরেছেন তিনি। জলপাইগুড়ি শহরের গোমস্ত পাড়ার বাসিন্দা বছর ৩৩-এর প্রীতম। বিজ্ঞানে ঝোঁক ছিল ছোটবেলা থেকেই। আনন্দচন্দ্র কলেজ থেকে ফিজিক্সে স্নাতক, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করার পর, কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দফতরে চাকরি পান।
নীলেশ্বর সান্যালের রিপোর্ট
কাশ্মীরে টানা বরফ পড়ছে। আবার ছাংগু, সান্দাকফুতে বরফপাত দেখে ভ্রমণপ্রিয় বাঙালি এক্কেবারে আত্মহারা। ঘুরতে গিয়ে বরফের গোলা বানিয়ে ছোড়াছুড়ি বা ছবি তোলা, খুব বেশি হলে রিল বানানো। এতেই খুশি মাছেভাতে বাঙালি। কিন্তু বরফের সঙ্গে ঘরকন্যা- নৈব নৈব চ। নিন্দুকেরা তো বলেই থাকেন যে বাঙালি শীতকাতুরে। সেই বাঙালিই যখন বরফের দেশ জয় করেন, সমস্ত প্রতিকূলতাকে হেলায় হারিয়ে দেড় বছর কুমেরুতে কাটিয়ে ফেলেন, তখন কি আর সেই বাঙালিকে ঘরকুনো বলা চলে! জলপাইগুড়ির প্রীতম চক্রবর্তী সেই ছক ভাঙা বাঙালি। হিমবাহ কেন গলছে, এর বিপদ কোথায়? দুনিয়ার দক্ষিণ প্রান্তে প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে কীভাবে কাটালেন? সব অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরেছেন। একবার ভাবুন গোটা বিশ্বের ৯০ শতাংশ বরফ যেখানে থাকে, সেখানেই ১৮ মাস গবেষণার জন্য কাটিয়েছেন প্রীতম। কেমন ছিল সেই কনকনে দিনগুলো?
প্রীতম বলছেন, শৈশবের ভাবনা পূর্ণতা পেল যৌবনে। স্বপ্ন যে একদিন সত্যি সত্যি দুনিয়ার দক্ষিণ প্রান্তে পৌঁছে দেবে কে ভেবেছিল! তাঁর কথায়, ছোটবেলায় বইতে পড়তাম পেঙ্গুইন, সিল, অরোরা, আমাদের এখানে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ নেই। ইচ্ছে ছিল সুযোগ পেলে দেখা। ওখানে গিয়ে তো চোখ মিললেই পেঙ্গুইনের ছোটাছুটি দেখতে পেতাম। হাত বাড়ালেই সিল। মাঝরাতে ঘুম ভাঙলে অরোরা অস্ট্রালিস বা কুমেরু প্রভা দেখার সুযোগ।
দুনিয়ার শীতলতম, শুষ্কতম, ঝোড়ো এবং জনবসতিহীন মহাদেশে আবহাওয়া সংক্রান্ত গবেষণা সেরে ফিরেছেন তিনি। জলপাইগুড়ি শহরের গোমস্ত পাড়ার বাসিন্দা বছর ৩৩-এর প্রীতম। বিজ্ঞানে ঝোঁক ছিল ছোটবেলা থেকেই। আনন্দচন্দ্র কলেজ থেকে ফিজিক্সে স্নাতক, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করার পর, কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দফতরে চাকরি পান। তারপরই কুমেরু যাওয়ার সুযোগ চলে আসা। স্বাস্থ্যপরীক্ষা ও বেশ কিছু প্রশিক্ষণের পর ২০২৩-এর অক্টোবরে রওনা দেন আন্টার্কটিকার উদ্দেশ্যে। রুট ছিল গোয়া থেকে কেপটাউন হয়ে দুনিয়ার দক্ষিণ প্রান্ত।
সেই থেকে প্রায় দেড় বছর আন্টার্কটিকায় ভারতী রিসার্চ স্টেশন হয়ে উঠেছিল তাঁর ঘরবাড়ি। আর্থ স্টেশনের মধ্যে সহনশীল তাপমাত্রা। কিন্তু বাইরে ঠিক উল্টো। ভয়ঙ্কর ঠান্ডা। যখন-তখন তুষারঝড়। তার বেগ ছিল মারাত্মক। প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই চলত দিনভর। সেই অভিজ্ঞতার কথাও ভাগ করেছেন টিভি ৯ বাংলার সঙ্গে। প্রীতম তো বলছেন, সর্বোচ্চ দেড়শো কিমি গতিতে তুষারঝড় দেখেছি, বছরে ৮টা তুষারঝড় দেখেছি। তাপামাত্রা তো সর্বোচ্চ ০-৫, সর্বনিম্ন -৩৫ ডিগ্রির আশেপাশে।
তিরাশি থেকেই দক্ষিণ মেরুতে ভারতীয় গবেষকরা
প্রসঙ্গত, সেই ১৯৮৩ সাল থেকে ভারতীয়রা গবেষকরা যাচ্ছেন দক্ষিণ মেরুতে। দক্ষিণ গঙ্গোত্রী নামের আর্থ স্টেশন কাজ শুরু করে ৪১ বছর আগে থেকে। আপাতত সেখানে মৈত্রী ও ভারতী নামে দুটি সায়েন্টিফিক রিসার্চ স্টেশন ভারতের। আর ভারতী সায়েন্টিফিক আর্থ স্টেশন ছিলেন এই বঙ্গতনয়। ২০২৩-এর যে ব্যাচ যায় আন্টার্টিকায় সেই দলের অন্যতম মুখ জলপাইগুড়ির এই প্রীতম।
করলা নদীর তীর থেকে এক্কেবারে দুনিয়ার শেষ প্রান্তে। যেখানে দূষণ যেমন নেই, তেমন কোলাহল কী জিনিস অনেকেই জানেন না। না জানার জায়গা যে আরও আছে। বাড়ি ফিরে আসার পর বাঙালি বিজ্ঞানীর মন কিন্তু পড়ে সেই আন্টার্কটিকায়। বারবার ফিরে যাচ্ছেন স্মৃতির পাতায়, বলছেন, এত পরিষ্কার আকাশ জীবনে দেখিনি। দূষণমুক্ত এলাকা। এখানে এসে মানিয়ে নিতে অসুবিধা হয়। ওখানে সব শান্ত।
দুনিয়ার ৯০ শতাংশ বরফ যেখানে, পৃথিবীর পানীয় জলের সত্তর ভাগ যে অংশে, সেখানে আবহাওয়া নিয়ে টানা গবেষণা, আন্টার্কটিকা নিয়ে রহস্যভেদের খোঁজ। এভাবেই বাঙালি বিজ্ঞানীর কেটে গেল ৪০০টা দিন। উদ্দেশ্য, আন্টার্কটিকার বরফ গললে বরফ, পাথর, হ্রদের স্টাডি করা যায়, তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণ করা, বেলুন ছেড়ে ওজন গ্যাসের গবেষণা। এবং সেই সব রিপোর্ট পাঠাতে হয় দিল্লিতে। এত কাজের মাঝেও যেন ভালবেসে ফেলেছিলেন আন্টার্কটিকাকে। কারণও অনেক! এই ধরুন রাতে ঘুম আসছে না! তাতে অবশ্য চিন্তা নেই। মন ভাল করার সব উপকরণই তো মজুত দক্ষিণ মেরুতে। আর্থ স্টেশনের জানালা দিয়ে রাতের আকাশে রঙিন কুমেরুজ্যোতির আলোর ছটা দেখে মনে ভরে যেত জলপাইগুড়ির বিজ্ঞানীর। কখনও ১৫০ কিলোমিটার বেগে টানা ২৩ ঘণ্টা ধরে চলা তুষার ঝড়ের মুখোমুখি হয়েছেন। আবার আর্থ স্টেশনে ঢুকে পড়লে এসব থেকে অনেক দূরে।
পেঙ্গুইনের দেশ বলে কথা। তাই উঠতে বসতে পেঙ্গুইনের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়া। কখনও বরফের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া পেঙ্গুইনদের পিছু ধাওয়াও করেছেন বিজ্ঞানী। এমনই মজার মজার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। তবে একটি ঘটনায় নিজেকে যেন জাদুকর মনে করেছিলেন বাঙালি বিজ্ঞানী। বিষয়টি কী? একবার আর্থ স্টেশন থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন অল্প সময়ের জন্য। হাতে ছিল টগবগ করা জল। কিন্তু, এরপরই তো ম্যাজিক। সহকর্মীদের কথায়, ফুটন্ত জল আকাশের দিকে ছোড়েন প্রীতম, তারপর তো অবাক হওয়ার পালা। ফুটন্ত জল মুহূর্তেই হয়ে গিয়েছিল বরফ। গল্প এখানেই শেষ নয়!
আন্টার্কটিকাতেও ফুটবল!
আন্টার্কটিকায় মাছ-ভাত না পাওয়া যাক, ফুটবলের ব্যবস্থা আছে! হাড়কাঁপানো ঠান্ডাতেও খেলেছেন ফুটবল! সুমেরুতে ভারতের আর্থ স্টেশনের পাশেই রয়েছে রাশিয়ার আর্থ স্টেশন। দুই দেশের অভিযাত্রীরা একদিন ঠিক করেন বরফের মধ্যেই হবে ফুটবল। যেমন কথা তেমন কাজ। হইহই করে শুরু হয়ে গেল ফুটবল! দক্ষিণ মেরুতে গিয়ে গোলে শটে নিতে পেরে বাঙালি বিজ্ঞানীকে আর পায় কে!
তবে বাঙালির ফুটবল যেমন আছে, তেমন খাওয়া দাওয়াও আছে। বছরে এক আধদিন তো ভুরিভোজের ব্যবস্থা। আর্থ স্টেশনের হেঁশেলে রান্না হয়েছিল জিভে জল আনা নানা রকমের পদ। রান্নায় হাত লাগিয়েছিলেন প্রীতমও। তাঁর হাতের ব্রেড পকোড়া খেয়ে অনেকেই খুশি। কুমেরুর আর্থ স্টেশনে ভারতীয়রার এভাবেই হইহই করে কাটান। তবে দক্ষিণ মেরুতে একবার ঢুকে পড়লে এক্কেবারে সচেতনতার মোড়কে নিজেদের মুড়িয়ে ফেলেন ভারতীয় গবেষকরা। জানেন, তাঁরা এই এলাকায় ভিনদেশী। অতএব যেখানকার জায়গা, সেখানকার মতো করে রেখেই বাড়ি ফিরতে হয়। অবশেষে সব কাজ শেষে গন্তব্য সেই বাংলা!