Chhoto Angaria massacre: রামপুরহাটের ‘হত্যালীলা’ উস্কে দিচ্ছে দুই দশক আগের ছোট আঙারিয়ার নৃশংসতার স্মৃতি, কী হয়েছিল সেদিন সন্ধ্যায়?

Chhoto Angaria Case: সন্ধ্যার আঁধার নামতেই বক্তারের বাড়ি চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলেছিল দুষ্কৃতীরা। আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে আগুন। বাড়ি পুড়ে ছারখার। সেদিনের নৃশংসতায় পাঁচ জন মারা যাওয়ার অভিযোগ উঠেছিল।

Chhoto Angaria massacre: রামপুরহাটের 'হত্যালীলা' উস্কে দিচ্ছে দুই দশক আগের ছোট আঙারিয়ার নৃশংসতার স্মৃতি, কী হয়েছিল সেদিন সন্ধ্যায়?
রামপুরহাটের ঘটনা ফের উস্কে দিচ্ছে ছোট আঙারিয়ার বীভৎসতা
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Mar 22, 2022 | 10:42 PM

গড়বেতা : রণক্ষেত্র রামপুরহাট। সোমবার রামপুরহাটে বোমাবাজিতে ‘খুন’ (Rampurhat Murder) হন রামপুরহাট-১ ব্লকের বড়শাল গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান ভাদু শেখ। তাঁর বাড়ি বগটুই গ্রামে। তারপর থেকেই সারা রাত ধরে গ্রামে তাণ্ডব চলেছে অভিযোগ। একের পর এক বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। বোমাবাজির চিহ্নও পাওয়া গিয়েছে। ‘সন্ত্রাসের’ আগুনে পুড়ে প্রাণ হারিয়েছে অন্তত আচ জন। দমকল সূত্রে সকালে জানানো হয়েছিল, সোমবার রাতেই তিন জনের দেহ উদ্ধার হয়, মঙ্গলবার সকালে আরও সাত জনের। পরে পুলিশের তরফে অবশ্য জানিয়ে দেওয়া হয়, আটজনের দেহ উদ্ধার হয়েছে। আর এই ঘটনায় ফের একবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে ছোট আঙারিয়ার স্মৃতি।

দুই দশক পেরিয়েও বীভৎস ‘হত্যালীলা’ ঝাপসা হয়নি

গড়বেতা। ছোট আঙারিয়া। তপন-শুকুর। এই শব্দগুলি রাজনীতিতে যতবার উঠে আসে, ততবারই অস্বস্তিতে পড়ে যায় তৎকালীন শাসক দল সিপিএম। দুই দশক আগের ঘটনা। পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতা থানা এলাকায় ছোট্ট একটি গ্রাম ছোট আঙারিয়া। ২০০১ সালের আগে ছোট আঙারিয়া গ্রামটির সঙ্গে বাংলার মানুষের তেমন পরিচয় ছিল না। ২০০১ সালের ৪ জানুয়ারি। রাজ্যে তখন বামেদের রাজত্ব। পশ্চিম মেদিনীপুরের কোনও কোনও জায়গায় তখন মাথা তুলে দাড়ানোর চেষ্টা করছে তৃণমূল। সিপিএমের আতঙ্কে ঘরছাড়া তৃণমূলের বহু কর্মী। স্থানীয় সিপিএম নেতৃত্বের আশ্বাস পেয়ে এলাকায় ফিরে আসেন ঘরছাড়া তৃণমূল কর্মীদের একাংশ। ছোট আঙারিয়ার বাসিন্দা বক্তার মণ্ডলের বাড়িতে জড়ো হয়েছিলেন তাঁদেরই কয়েকজন।

আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল বক্তার মণ্ডলের বাড়িতে

সেদিন সন্ধ্যায় হঠাৎই সেখানে চড়াও হয় একদল দুষ্কৃতী। তৃণমূলের অভিযোগ ছিল, সিপিএম আশ্রিত হার্মাদ বাহিনী তাদের কর্মীদের আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে। ছোট আঙারিয়ায় সেই রাতে এক ভয়ঙ্কর গণহত্যার সাক্ষী হয়েছিল গোটা বাংলা। রাতের অন্ধকারে, বক্তার মণ্ডলের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অভিযোগ, আগুনের তাপে যাঁরা বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছিল, তাঁদের ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয়েছিল। গুলিও চালানো হয়েছিল। অভিযোগ, পাঁচজনকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। নিহতরা ছিলেন, মুক্তার খাঁ, রবিয়াল ভাঙ্গি, হায়দার মণ্ডল, জয়ন্ত পাত্র, মুক্ত পাত্র। তৃণমূলের অভিযোগ ছিল, তাঁদের পাঁচ কর্মীকে খুন করে তাঁদের দেহ লোপাট করে দেওয়া হয়। সেই ঘটনা বাম সরকারকে তীব্র অস্বস্তিতে ফেলেছিল। নিন্দার ঝড় উঠেছিল রাজ্যজুড়ে। মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় তখন কেন্দ্রের বিজেপি শাসিত এনডিএ সরকারের জোটসঙ্গী। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। ছোট আঙারিয়াকে কেন্দ্র করে আন্দোলন দিকে দিকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বিরোধী নেত্রী মমতা ।

লাল বাতি লাগানো গাড়িতে দেহ লোপাটের অভিযোগ

সেদিন সন্ধ্যায় বক্তার মণ্ডলের বাড়িতে হামলায় অভিযোগ উঠেছিল পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা কমিটির সদস্য তপন ঘোষ ও সিপিএম জোনাল কমিটির সম্পাদক শুকুর আলির বিরুদ্ধে। অভিযোগ ছিল, তাঁদের নেতৃত্বেই সেদিন সিপিএমের ‘হার্মাদ বাহিনী’ হামলা চালিয়েছিল। বক্তার মণ্ডল ছিলেন এই ঘটনার প্রধান সাক্ষী। বক্তার মণ্ডলের দাবি ছিল, তপন ঘোষ, শুকুর আলি – এরাই ছিল ঘটনার মাস্টার মাইন্ড। অভিযোগ, ঘটনায় সবার মাথার উপরে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা হলেন সুশান্ত ঘোষ এবং তৎকালীন জেলা সম্পাদক দীপক সরকার। তৃণমূল এঁদের নামও করেছিল।  দুষ্কৃতীদের কাছে আগে থেকেই খবর ছিল, তৃণমূল কর্মীরা গ্রামে ফিরে এসেছেন। বক্তার মণ্ডলের বাড়িতে যে তাঁরা ঢুকেছেন, সেই খবরও ছিল। সন্ধ্যার আঁধার নামতেই বক্তারের বাড়ি চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলেছিল দুষ্কৃতীরা। আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে আগুন। বাড়ি পুড়ে ছারখার। জীবন্ত পুড়ে মারা যান কয়েকজন। বাকিরা দোতলা থেকে লাফ দেন। যাঁরা বেরিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের লক্ষ্য করে গুলি চালানোর অভিযোগও রয়েছে। উঠেছিল মুণ্ডচ্ছেদের অভিযোগও। বক্তার শেষ পর্যন্ত প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। তাঁর দাবি ছিল, গোটা ঘটনা নিজের চোখে দেখেছিলেন তিনি। পরবর্তীতে তিনিই মামলার মূল সাক্ষী হন। কিন্তু সেদিন ছোট আঙারিয়ার ঘটনায় মৃত দেহগুলির খোঁজ পাওয়া যায়নি। অভিযোগ, লাল বাতি লাগানো গাড়িতে করে দেহ লোপাট করে দেওয়া হয়েছিল।

সাত বছর পর গ্রেফতার সিপিএম নেতা তপন-শুকুর

এদিকে ঘটনার পরই এলাকা থেকে তপন ঘোষ ও শুকুর আলিরা পালিয়ে গিয়েছিলেন বলে অভিযোগ। বাম সরকারের পুলিশের খাতায় অভিযুক্তদের ফেরার ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছিল। প্রায় সাত বছর পর ধরা পড়েছিলেন তপন, শুকুর। সেও এক ঘটনা। ২০০৭ সাল। ততদিনে ১৪ মার্চের নন্দীগ্রামে আরও একটা ‘গণহত্যা’ হয়ে গিয়েছে। বাম সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আরও জোরালো হচ্ছে রাজ্যজুড়ে। ২০০৭ সালের নভেম্বরে সিপিএম ফের নন্দীগ্রাম পুনর্দখলের অভিযান শুরু করে। সেই সময় ১০ নভেম্বর গোকুলনগরে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির মিছিলে হামলার অভিযোগ ওঠে। সেখানে আক্রান্তদের অ্যাম্বুলেন্সে করে অপহরণের চেষ্টার অভিযোগ ওঠে। সেই সময়ই এগরার কাছে স্থানীয় বাসিন্দারা ওই গাড়ি আটকে দেয়। আহতদের উদ্ধার করে সিপিএমের লোকেদের পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। সেই সময়ই ধড়া পড়েন তপন-শুকুররা। কিন্তু তখন অবশ্য নিজেদের পরিচয় গোপন করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু সেই সময় শিশির অধিকারী তাঁদের আসল পরিচয় পুলিশের কাছে জানান এবং গ্রেফতার করা হয় তাঁদের। সেদিন তপন ঘোষ ও শুকুর আলিদের গ্রেফতারির পিছনে বড় ভূমিকা ছিল শিশির অধিকারীর।

সিবিআই তদন্ত শুরু, সাক্ষীরা বেঁকে বসায় বেকসুর খালাস

তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুরু থেকেই সিবিআই তদন্তের জন্য দাবি করেছিলেন। শেষে ২০০১ সালের ৩০ মার্চ হাইকোর্ট ছোট আঙারিয়ার ঘটনায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয়। ঘটনায় ১৩ জনের উপর নজর ছিল সিবিআইয়ের। তাদের মধ্যে আট জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল এবং পাঁচজন ফেরার ছিল। কিন্তু ঘটনার মূল সাক্ষী বক্তার মণ্ডল সহ অন্যান্য সাক্ষীরা আদালতে বেঁকে বসেন। অভিযোগ, তাঁদের ভয় দেখানো হয়েছিল। ফলে, মামলাটির সেই সময় বিশেষ কিছু এগোয় না। পর্যাপ্ত সাক্ষ্যের অভাবে তপন ঘোষ, শুকুর আলি সহ মোট আট সিপিএম নেতা-কর্মী, যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল, তাঁরা বেকসুর খালাস পেয়ে যান।

নতুন করে তদন্তে নামে সিবিআই

পরে ২০১১ সালের মে মাসে গড়বেতায় অস্ত্র আইনে গ্রেফতার হয় দিল মহম্মদ নামে এক ব্যক্তি। ছোট আঙারিয়ার অগ্নি সংযোগ মামলাতেও ফেরার অভিযুক্তদের তালিকায় তার নাম ছিল। এরপর সিবিআই তাকে নিজেদের হেফাজতে নেয়। তাকে জেরা করে নতুন তথ্য উঠে আসে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার অফিসারদের হাতে। নতুন করে তদন্ত শুরু করে সিবিআই। ফের সাক্ষ্য নেওয়া হয় বক্তার মণ্ডল ও তাঁর স্ত্রী সহ অন্যান্যদের। ২০১৩ সালে বক্তার দাবি করেছিলেন, তাঁর চোখের সামনেই ছোট আঙারিয়ার পাঁচ তৃণমূল কর্মীকে খুন করা হয়েছিল। আগে শাসক দলের চাপেই তাঁকে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা হয়েছিল।

মূল্য সাক্ষীর মৃত্যুতে মামলা বিশ বাঁও জলে

বর্তমানে মেদিনীপুর জেলা আদালতে সেই মামলা চলছে। সাক্ষ্য গ্রহণ পর্ব চলছে আদালতে। কিন্তু এরই মধ্যে গত মাসেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় ছোট আঙারিয়া হত্যালীলার অন্যতম প্রধান সাক্ষী বক্তার মণ্ডল।

আরও পড়ুন : Rampurhat Case: ‘রাজনীতি নেই’ বলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কুণাল বললেন, ‘বৃহত্তর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র’