পূর্ব বর্ধমান: মিড ডে মিল খাওয়াব না ক্লাস করাব! নিজেদের অবস্থা দেখে সন্তানদের সরকারি স্কুলে পড়াতে সাহস পাচ্ছেন না শিক্ষকরাই
Purba Burdwan: কেউ বলছেন, সোশ্যাল স্টেটাস রক্ষায় সন্তানদের ইংরাজি মিডিয়ামে পড়াতে চান অনেকে। ইংরাজিটা ভাল বলবে। তবে এমনও কেউ কেউ বলছেন, রাজ্য শিক্ষানীতির হাল খুব খারাপ। কে চাইবে সন্তানকে সে পথে ঠেলতে?
পূর্ব বর্ধমান: প্রাথমিকের কোনও স্কুলে (Government School) হয়ত তিনজন শিক্ষক। ২ জন মিড ডে মিলে ব্যস্ত থাকেন, একজন ক্লাসের দায়িত্বে। উচ্চ প্রাথমিকগুলিতেও পড়াশোনার থেকে বেশি সরকারি প্রকল্পের উপরই জোর চলে। শুধু ক্লাস নেওয়াই নয়, মিড ডে মিল খাওয়ানো থেকে শুরু করে আরও দায়িত্ব তাঁদের বলে বিভিন্ন সময় অভিযোগ তোলেন মাস্টারমশাই, দিদিমণিরা। আর এসবের ফাঁকে মাঝেমধ্যে ফাঁকি পড়ে যায় ক্লাসে। ফলে সরকারি স্কুলে পঠনপাঠন নিয়ে সরকারি স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকাদের মনেই রয়েছে প্রশ্ন। তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই মাস্টারমশাই, দিদিমণিরা চান নিজেদের সন্তানকে বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করতে। শুধু কি এই একটাই কারণে সরকারি স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকারা সন্তানদের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠান? টিভি নাইন বাংলা এই উত্তরের খোঁজে গিয়েছিল পূর্ব বর্ধমান জেলার একাধিক সরকারি স্কুলে। যেসব তথ্য সামনে এল, যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।
বর্ধমান শহরের নাম করা স্কুলগুলির মধ্যে একটি স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকার সংখ্যা ৫৪ জন। যার মধ্যে ৮ জন প্যারাটিচার। এই ৫৪ জন শিক্ষকের মধ্যে ১৪ জনের ছেলেমেয়ে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করে। স্কুলে যাঁরা ইংরাজি পড়ান, অর্থাৎ একজন শিক্ষক ও তিনজন শিক্ষিকার ছেলে মেয়ে বেসরকারি স্কুলেই পড়ে।
এই শিক্ষক শিক্ষিকাদের বক্তব্য, শহরের হাতে গোনা তিন চারটি সরকারি স্কুল ছাড়া বাকি স্কুলগুলিতে নানা সমস্যা রয়েছে। পরিকাঠামো, শৃঙ্খলা, সিলেবাস, পরিবেশ, পড়াশোনার ধরন সবই তাঁদের স্কুলের থেকে উন্নত বলেই মত ওই শিক্ষক শিক্ষিকাদের। এক প্রধান শিক্ষকের কথায়, “রাজ্য শিক্ষানীতিটাও দায়ী। পাশ ফেল তুলে দিয়েছে। শুধু মিড ডে মিল খাওয়া, কন্যাশ্রী, সাইকেল পাওয়া, কাপড় দেওয়ার উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। পড়াশোনার বাইরে এসবেই জোর দেয়। প্রাথমিকে তো আরও খারাপ অবস্থা। তিনজন শিক্ষক আছেন। তার মধ্যে ২ জন মিড ডে মিল দেন, একজন প্রথম শ্রেণি থেকে চতুর্থ শ্রেণি অবধি ক্লাস নিচ্ছেন। তাহলে আর কী হবে?”
শহরের আরও একটি স্কুলে গিয়েছিল টিভি নাইন বাংলা। সেখানে মোট শিক্ষক শিক্ষিকা ৩৫ জন। ৫০ শতাংশ শিক্ষক শিক্ষিকা তাঁদের ছেলে মেয়েকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ান। ইংরাজি শিক্ষক শিক্ষিকা সেখানে ৫ জন। তাঁদের সকলের ছেলেমেয়েই ইংরাজি মাধ্যমে পড়াশোনা করে।
আরেকটি স্কুলেও একই ছবি। মোট শিক্ষক শিক্ষিকা ২৫ জন। ৬০ শতাংশ শিক্ষক-শিক্ষিকা তাঁদের ছেলে মেয়েকে ইংরাজি মাধ্যমে পড়ান। অথচ এ স্কুলে ইংরাজির শিক্ষক শিক্ষিকা ৩ জন। এদের প্রত্যেকের ছেলেমেয়ে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করে। তবে তিনটি স্কুলেরই প্রধান শিক্ষকের সন্তানরা সরকারি স্কুলেই পড়াশোনা করে বা করেছে।
এক স্কুলের প্রধান শিক্ষক জানাচ্ছেন, “আমরা সরকারি স্কুলে পড়াশোনা করেই আজ শিক্ষকতা করছি, ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছি। বেসরকারি স্কুলে পড়াশোনার পরে চাকরি বা রিসার্চের ক্ষেত্রে যে জায়গায় ছাত্রছাত্রীরা পৌঁছয়, অনেক সময় তার থেকেও উপরের স্তরে পৌঁছ সরকারি স্কুল থেকে পড়াশোনা করে উঠে আসা ছাত্র ছাত্রীরা। তাই আমি আমার ছেলেমেয়েকে সরকারি স্কুলেই পড়িয়েছি।”
তবে তিনিও মানছেন সরকারি স্কুলে পরিকাঠামোগত কিছু সমস্যা রয়েছে। তাঁর আবেদন, সরকার তাতে বিশেষ নজর দিক। একইসঙ্গে স্কুলের পরিচালন সমিতি থেকে রাজনীতিকে দূরে রাখারও আবেদন তাঁর। রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিত্ব নয়, শিক্ষার আলোতে আলোকিতদের পরিচালন সমিতিতে আনার পক্ষপাতী তিনি।