বঙ্গযুদ্ধের ষষ্ঠদফায় ৪৩ আসন: যে কেন্দ্রগুলিতে বিশেষ নজর রাজনৈতিক মহলের

নদিয়ার কৃষ্ণনগর উত্তর, উত্তর ২৪ পরগনার রায়গঞ্জ, উত্তর ২৪ পরগনার বারাকপুর, দমদম উত্তর ও হাবড়া। ভোটযুদ্ধে তীব্র রেষারেষি হতে পারে এই সব কেন্দ্রে।

বঙ্গযুদ্ধের ষষ্ঠদফায় ৪৩ আসন: যে কেন্দ্রগুলিতে বিশেষ নজর রাজনৈতিক মহলের
প্রতীকী চিত্র।
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Apr 22, 2021 | 6:19 AM

পশ্চিমবঙ্গ: বৃহস্পতিবার ২২ এপ্রিল রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের (West Bengal Assembly Election 2021)  ষষ্ঠ দফায় (Sixth Phase)  উত্তর ২৪ পরগনা, নদিয়া, পূর্ব বর্ধমান এবং গোটা উত্তর দিনাজপুর জেলা ৪৩ আসনে ভোট গ্রহণ। তবে এই দফার ভোটে কয়েকটি বিশেষ কেন্দ্রে নজর থাকছে রাজনৈতিক মহলের। এগুলি হল নদিয়ার কৃষ্ণনগর উত্তর, উত্তর ২৪ পরগনার রায়গঞ্জ, উত্তর ২৪ পরগনার বারাকপুর, দমদম উত্তর ও হাবড়া। ভোটযুদ্ধে তীব্র রেষারেষি হতে পারে এই সব কেন্দ্রে।

কৃষ্ণনগর উত্তর:

একুশের ভোটে বিজেপি (BJP)-র জন্য আলাদা গুরুত্ব রয়েছে কৃষ্ণনগর উত্তর আসনের। একসময়ের তৃণমূলের সেকেন্ড ইন কমান্ড এবং বর্তমানে বিজেপি সর্বভারতীয় সভাপতি মুকুল রায় ২০ বছর পর ভোটের ময়দানে। ২০ বছর তৃণমূলে কাটানোর পর ২০১৭ সালে বিজেপি যোগ দেন মুকুল। শেষবার ২০০১ সালে নিজের জেলা উত্তর ২৪ পরগনার জগদ্দলে হেরে গিয়েছিলেন মুকুল। তখন তিনি মমতার সঙ্গে। এবার লড়াই সেই মমতারই বিপক্ষে। তাঁর বিপরীতে তৃণমূল প্রার্থী করেছে রাজনীতিতে নবাগতা এবং অভিনেত্রী কৌশানী মুখার্জিকে।

২০০১ সালের ১৩ মে জগদ্দলে ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থী হরিপদ বিশ্বাসের কাছে হেরে গিয়েছিলেন মুকুল। দীর্ঘ দুই দশক বাদে, ২০২১ সালের ২ মে কি মুকুলের জীবনে ২০০১ এর ১৩ মে হয়ে ফিরবে নাকি এবার ভোট রাজনীতিতে নয়া ইনিংস শুরু করবেন সেটাই দেখার।

তৃণমূলের সংগঠনকে মজবুত করতে বড় ভূমিকা ছিল মুকুলের। সেই মুকুল যখন বিজেপিতে যান তখন লোকসভা ভোটে বাংলার মাটিতে নিজেদের শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে গেরুয়া শিবির। উনেশের লোকসভা ভোটের ফলাফলে দেখা গেল বিজেপির ভোট সেয়ার ৪০ শতাংশের উপরে চলে গিয়েছে। সেই সঙ্গে বাংলার ৪২ লোকসভা আসনে ১৮টি পেয়ে কার্যত তৃণমূলের ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে তারা। সেখানে সংগঠন স্তরে মুকুল রায়ের কাজে একরকম মুগ্ধই হন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। ফলস্বরূপ মুকুল জায়গা পান দলের কেন্দ্রীয় স্তরে। তাঁর এবার ভোট রাজনীতিতে অ্যাসিড টেস্ট।

গত ভোটে কী ফলাফল ছিল কৃষ্ণনগর উত্তর কেন্দ্রে?

২০১৬-র বিধানসভা ৪৪ শতাংশের বেশি ভোট নিয়ে এই কেন্দ্র থেকে জয় পান তৃণমূলের অবনী মোহন জোয়ারদার। সেই ভোটে বিজেপির চঞ্চকুমার বিশ্বাস পান মাত্র ১৪ শতাংশ ভোট।

কিন্তু উনিশের লোকসভা ভোটে খেলা বদলে যায়। এই আসনে ৫৩ হাজারের বেশি ভোট পায় বিজেপি। শতাংশের বিচারে ৫৯ শতাংশ! অন্যদিকে তৃণমূল প্রার্থী পান মাত্র ৩২ শতাংশ ভোট। বাকি ১.২ শতাংশ ভোট যোগ হয় কংগ্রেসের ভোটবাক্সে।

প্রসঙ্গত, কৃষ্ণনগর উত্তর কেন্দ্রে তফশিলি ভোট রয়েছে ২৯ শতাংশ। তফশিলি উপজাতি ভোট ৩ শতাংশ এবং মুসলিম ভোট রয়েছে ৬ শতাংশ।

হাবড়া:

একুশের ভোটযুদ্ধে আরও একটি বড় যুদ্ধ হতে চলেছে হাবড়া বিধানসভা আসনে। বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি রাহুল সিনবা এবার এই কেন্দ্রের প্রার্থী। তাঁর বিপরীতে রয়েছেন মমতার ক্যাবিনেট মন্ত্রী তথা হেভিওয়েট প্রার্থী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক।

২০১১, ২০১৬, পরপর দুই বিধানসভা ভোটে এই কেন্দ্র থেকে জয়ী প্রার্থী জ্যোতিপ্রিয়র এবার হ্য়াট্রিকের সুযোগ। অন্যদিকে ভোট রাজনীতিতে এখনও পর্যন্ত সফল না হওয়া রাহুল সিনহা। ‘১৬ সালের বিধানসভা ভোটে ৫৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন জ্যোতিপ্রিয়। বাম প্রার্থী পেয়েছিলেন ৩০ শতাংশ ভোট। আর বিজেপি প্রার্থী গোবিন্দ দাস পান সাকুল্যে ১২ শতাংশ ভোট।

তবে কৃষ্ণনগর উত্তরের মতো এই কেন্দ্রেও উনিশের লোকসভা ভোটে চোখ ধাঁধানো ফল করে বিজেপি। ৫১ শতাংশ ভোট পায় গেরুয়া শিবির। অন্যদিকে তৃণমূল পায় ৪০ শতাংশ ভোট। বিধানসবা ভোটে দ্বিতীয় স্থানে থাকা বামেরা মাত্র ৫ শতাংশ আর কংগ্রেসের ভোটবাক্সে যায় ২ শতাংশ ভোট শেয়ার।

সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এই কেন্দ্রে মুসলিম রয়েছে ১৭ শতাংশ। তফশিলি জাতি ও উপজাতি ভোটার রয়েছেন যথাক্রমে ৩০ এবং ২ শতাংশ। যাদের মধ্যে রয়েছে মতুয়া সম্প্রদায়।

বারাকপুর:

উত্তর ২৪ পরগনার আর এক গুরুত্বপূর্ণ আসন বারাকপুর। একদিকে এই কেন্দ্রে তৃণমূলের তারকা প্রার্থী রাজ চক্রবর্তী। যিনি আবার একসময় কাঁচড়াপাড়ার বাসিন্দা ছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী ঘনিষ্ঠ রাজ জেতার ব্যাপারে ১০০ শতাংশ আত্মবিশ্বাসী বলে জানিয়েছেন। অন্যদিকে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী করেছে ডাঃ চন্দ্রমণী শুক্লাকে।

গত দু’বছর ধরে বারবার খবরের শিরোনামে উঠে এসেছে বারাকপুর, যখন থেকে অর্জুন সিংহ তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে গিয়েছেন। তৃণমূলের প্রাক্তন বিধায়ক অর্জুন লোকসভা ভোটে বিজেপির হয়ে লড়ে এখন বারাকপুরের সাংসদ। এর মধ্যে বারবার বারাকপুরের শিল্পাঞ্চল এলাকার ভাটপাড়া, জগদ্দল ইত্যাদিতে অশান্তি হয়েছে। যা নিয়ে একে অন্যের দিকে আঙুল তুলেছে তৃণমূল ও বিজেপি।

এদিকে ২০১৬ সালে এই বারাকপুর বিধানসভা কেন্দ্রে জয় পান তৃণমূলের শীলভদ্র দত্ত। ভোট মার্জিন ছিল ৭ হাজার ৩১৯। দ্বিতীয় স্থানে থাকা সিপিএম প্রার্থী দেবাশিস ভৌমিক পেয়েছিলেন ৩৫ শতাংশ ভোট। আর বিজেপির অমিতাভ রায় পেয়েছিলেন মাত্র ২০ শতাংশ ভোট।

কিন্তু উনিশের লোকসভা ভোটে বারাকপুরে হাওয়া যায় বিজেপির পালে। এই আসনে সাড়ে তি হাজার ভোটের লিড রয়েছে বিজেপির। এদিকে লোকসবা ভোটে যে দীনেশ ত্রিবেদীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন অর্জুন, তিনিও এখন বিজেপিতে। বারাকপুর বিধানসভা এলাকায় সংখ্যালঘু ভোট রয়েছে ১৮ শতাংশ। এছাড়া তফশিলি জাতি ও উপজাতির ভোট রয়েছে আট এবং এক শতাংশ।

দমদম উত্তর:

এই কেন্দ্রে এবার তৃণমূলের প্রার্থী মুখ্যমন্ত্রী ঘনিষ্ঠ মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। তাঁর বিপরীতে বিজেপি প্রার্থী অর্চনা মজুমদার। যদিও গত বিধানসভা ভোটে সাড়ে ছয় হাজার ভোটে এই আসন থেকে বিধায়ক হন বাম প্রার্থী তন্ময় ভট্টাচার্য। তাঁর ভোট শেয়ার ছিল ৪৬ শতাংশ। অন্যদিকে তৃণমূল পেয়েছিল ৪৩ শতাংশ এবং বিজেপি আট শতাংশ ভোট।

উনিশের লোকসভা ভোটে আবার তৃণমূল প্রার্থী সৌগত রায় ৪১ শতাংশ ভোট পেয়ে এই লোকসভা আসন থেকে জয়ী হন। বিজেপি প্রার্থী শমীক ভট্টাচার্য পান ৩৮ শতাংশ ভোট। লোকসভা ভোটে তৃণমূলের সাড়ে পাঁচ হাজার ভোট রয়েছে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রে। দমদম উত্তরে তফশিলি ভোটারের সংখ্যা ২০ শতাংশ এবং মুসলিম ভোটার রয়েছেন ৫ শতাংশ।

রায়গঞ্জ:

ষষ্ঠ দফা ভোটে আর একটি যে কেন্দ্রে সবার চোখ থাকবে তা হল উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জ আসন। এখানে তৃণমূল প্রার্থী কানাইয়ালাল আগরওয়াল। বিজেপি প্রার্থী করেছে কৃষ্ণ কল্যাণীকে। এবং কংগ্রেস প্রভাবিত এই আসনে সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থীর নাম মোহিত সেনগুপ্ত। যিনি বিদায়ী বিধায়কও বটে।

প্রয়াত কংগ্রেস নেতা তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির গড় বলা হত রায়গঞ্জকে। ২০১৬-র বিধানসভা ভোটে এই কেন্দ্রে মোহিত ৫১ হাজার ২৪৭ ভোটে জয়লাভ করেন। শতাংশের বিচারে ৫৯। অন্যদিকে তৃণমূল পেয়েছিল ২৫ শতাংশ ভোট এবং বিজেপি ৪ শতাংশ।

কিন্তু এই আসনেও উনিশের লোকসভা ভোটে অভাবনীয় ফল করে বিজেপি। ৫৬ শতাংশ এবং ৪২ হাজারের বেশি ভোটে রায়গঞ্জ থেকে জয়ী হন বিজেপির দেবশ্রী চৌধুরী। তৃণমূল প্রার্থী কানাইয়ালাল আগরওয়াল পান তাঁর অর্ধেক শতাংশ ভোট। আর প্রয়াত প্রিয়রঞ্জনের পত্নী দীপা দাশমুন্সি পেয়েছিলেন সাকুল্যে ৭ শতাংশ ভোট!

মুসলিম অধ্যুষিত রায়গঞ্জে সংখ্যালঘু ভোটার রয়েছেন ৩০ শতাংশ। তফশিলি জাতি ও উপজাতির ভোট রয়েছে যথাক্রমে ২৪ এবং ২ শতাংশ।