ভবানীপুর ছেড়ে নন্দীগ্রামের ‘কুরুক্ষেত্রে’ কেন এলেন মমতা?

কীভাবে এবং কোথায় কোথায় কাজ করতে পারে শুভেন্দু ফ্যাক্টর? ওয়াকিবহাল মহলের মতে, জঙ্গলমহল-সহ দুই মেদিনীপুরই অধিকারীদের আস্তানা বলেই পরিচিত। কাঁথির সাংসদ শুভেন্দুর বাবা শিশির অধিকারী ও তাঁর বড় ভাই দিব্যেন্দু অধিকারী তমলুকের সাংসদ যিনি প্রায় ৬০ শতাংশ ভোটে জয়লাভ করেন। ছোট ভাই সৌমেন্দু, কাঁথি পুরসভার চেয়ারম্যান সদ্যই বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন।

ভবানীপুর ছেড়ে নন্দীগ্রামের 'কুরুক্ষেত্রে' কেন এলেন মমতা?
মমতার দেওয়া ম্যানমেড তত্ত্ব ওড়ালেন শুভেন্দু। অলঙ্করণ: অভীক দেবনাথ
Follow Us:
| Updated on: Apr 01, 2021 | 4:03 PM

পূর্ব মেদিনীপুর: এ জমি থেকেই লড়াই শুরু করেছিলেন বাম বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee)। সে দিন মমতার পাশে ছিলেন তরুণ নেতা শুভেন্দু অধিকারী (Suvendu Adhikari)। সেই জমি নন্দীগ্রাম (Nandigram) ফের আরও একবার ‘প্রেস্টিজ ফাইট’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, যুযুধান প্রতিপক্ষ মমতা এবং তাঁর একদা সহযোদ্ধা শুভেন্দু। বিনা যুদ্ধে সূচগ্র মেদিনী ছাড়তে নারাজ দুজনেই। একদা গুরু-শিষ্যের লড়াইয়ে রাজনীতির ভরকেন্দ্র হয়ে উঠেছে নন্দীগ্রাম।

আজ থেকে ঠিক ১৪ বছর আগে কলকাতা (Kolkata) থেকে প্রায় ১৩২ কিলোমিটার দূরে পূর্ব মেদিনীপুরের এই ছোট্ট একটি অখ্যাত গ্রাম রাতারাতি খবরের শিরোনামে চলে আসে। ১৪ জন নিরীহ গ্রামবাসীর উপরে নির্বিচারে চলেছিল গুলি। বেঘোরে প্রাণ গিয়েছিল তাদের। তা দেখে শিহরিত হয়ে উঠেছিল গোটা দেশ।

সাল ২০০৭। সালেম গোষ্ঠীর ক্যামিক্যাল হাব তৈরির জন্য নন্দীগ্রামে ১০ হাজার একর জমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় তৎকালীন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর সরকার। ‘অনিচ্ছুক’ কৃষকরা অবশ্য রুখে দাঁড়াতে পারেননি। আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এর ফলে আটকে গিয়েছিল সালেম গোষ্ঠীর কেমিক্যাল হাব তৈরির পরিকল্পনা। অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে নন্দীগ্রাম, খেজুরি-সহ পূর্ব মেদিনীপুরের একাধিক এলাকা। বাম সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে এবং গ্রামবাসীদের পাশে দাঁড়াতে সেই সময় নন্দীগ্রামেও ছুটে এসেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গী ছিলেন শুভেন্দু অধিকারী। তাঁদের পাশে পেয়ে গ্রামবাসীদের ক্ষোভ জমাট বাঁধতে শুরু করে। বছর পঁয়ত্রিশের তরুণ, সদ্য কংগ্রেস থেকে আসা, ফুরফুরে মেজাজের শুভেন্দুকে মনে ধরেছিল মমতার। নেত্রীর নির্দেশে ততদিনে নন্দীগ্রামে শুভেন্দু তৈরি করে ফেলেছিলেন ভূমি উচ্ছেদ কমিটি।

তার আগে জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে শুরু হয় সিঙ্গুর আন্দোলন (Singur Protest)। বাধ্য হয়ে ২০০৮ সালে গাড়ি কারখানা না করে পিছু হটে টাটা গোষ্ঠী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষমতা আসার পিছন নন্দীগ্রাম ও সিঙ্গুর আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে বলে মনে করা হয়। ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসে তৃণমূল। তবে, ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীকে নন্দীগ্রামে দাঁড় করান মমতা। রেকর্ড মার্জিনে নির্বাচনে জয়লাভ করেন শুভেন্দু। প্রায় ৬৬.৮ শতাংশ ভোট পায় তৃণমূল। তাঁর বিপরীতে ছিলেন সিপিএম প্রার্থী আব্দুল কবীর শেখ। পদ্মফুল তখন ৫.৩২ শতাংশে আটকে। বিধানসভায় জয়লাভের পরেই শুভেন্দুর উপর সাংগঠনিক দায়িত্ব বাড়াতে থাকেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জঙ্গলমহল-সহ ধীরে ধীরে একাধিক জেলার পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব পান অধিকারী পুত্র।

কিন্তু, ২০১৯-এ লোকসভায় অনেক আসন হাতছাড়া হয় তৃণমূলের (TMC)। তারপর থেকেই ক্রমশ শুভেন্দু-তৃণমূল সম্পর্কে ক্রমশ শীতলতা বাড়তে থাকে। বেসুরো বাজতে শুরু করেন শুভেন্দুও। ধীরে ধীরে মন্ত্রিসভা ত্যাগ, সমস্ত সাংগঠনিক পদত্যাগ করে দলত্যাগ করেন শুভেন্দু। গত ডিসেম্বরে, তৃণমূলের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে বিজেপিতে (BJP) যোগ দেন ‘নন্দীগ্রামের নায়ক’। কিন্তু, নির্বাচন আবহে কেন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল? কেনই বা নন্দীগ্রামে তৃণমূলের তরফে মমতা ও বিজেপির তরফে শুভেন্দু প্রার্থী হলেন?

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, মমতার সংগঠনের একরকম মেরুদণ্ড ছিল শুভেন্দু। তৃণমূল কংগ্রেসের মুখ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর কেউ যদি তৃণমূলের হাল ধরার ক্ষমতা রাখতেন তবে অবশ্যই তা শুভেন্দু। কিন্তু, শুভেন্দু দলত্যাগ করায় তৃণমূলের ভিত খানিকটা নড়বড়ে হয়েছে বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ।

কীভাবে এবং কোথায় কোথায় কাজ করতে পারে শুভেন্দু ফ্যাক্টর? ওয়াকিবহাল মহলের মতে, জঙ্গলমহল-সহ দুই মেদিনীপুরই অধিকারীদের আস্তানা বলেই পরিচিত। কাঁথির সাংসদ শুভেন্দুর বাবা শিশির অধিকারী ও তাঁর বড় ভাই দিব্যেন্দু অধিকারী তমলুকের সাংসদ যিনি প্রায় ৬০ শতাংশ ভোটে জয়লাভ করেন। ছোট ভাই সৌমেন্দু, কাঁথি পুরসভার চেয়ারম্যান সদ্যই বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। শুধু মেদিনীপুর, জঙ্গলমহল নয়, সুদূর মালদা জেলারও দক্ষ সংগঠক শুভেন্দুর প্রভাব রয়েছে। সমীক্ষা বলছে, কংগ্রেসের গড়েও ছাপ ফেলতে পারে শুভেন্দু ফ্যাক্টর। ২০১১-র আদমসুমারি অনুযায়ী মুর্শিদাবাদে প্রায় ৬৬ শতাংশ মুসলিম জনগোষ্ঠী। এই জনগোষ্ঠীর উপর শুভেন্দুর ফ্যাক্টর কতটা কাজ করবে সেটা এখন দেখার।

নিজের কেন্দ্র ভবানীপুরের আসনটি ত্যাগ করে নন্দীগ্রামকেই কেন বেছে নিলেন তৃণমূল সুপ্রিমো? কারণ, নন্দীগ্রাম থেকেই একদিন মমতা-শুভেন্দু যৌথভাবে লড়াই শুরু করেছিলেন। শুভেন্দু দল ছেড়ে দেওয়ায়, বিজেপির প্রতিপক্ষ হিসেবে এবং নিজের হাতে দলের রাশ টানতেই মমতা নিজেকে নন্দীগ্রামের প্রার্থী ঘোষণা করলেন। শুধু তাই নয়, এতে আরও স্পষ্ট হল, নন্দীগ্রামে বিজেপির বিরুদ্ধে বিশেষ করে ‘অধিকারী গড়’-এর বিরুদ্ধে কেউ যদি লড়াই করতে পারেন তা একমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

প্রশ্ন হল, শুভেন্দু কি পারবেন এর যোগ্য উত্তর দিতে? যদিও এর উত্তর সময়সাপেক্ষ। তবে, দল পরিবর্তন করেও সফল থেকেছেন এমন নেতৃত্বের অভাব নেই। অসমের হেমন্ত বিশ্ব শর্মা কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেন এবং নির্বাচনে জয়ী হন। উদয়ন রাজা ভোঁশলে যিনি মধ্য প্রদেশের সাতারার সাংসদ ছিলেন। তিনি ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেন। কিন্তু, ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির তরফে জয়যুক্ত হতে পারেননি।

উল্লেখ্য, নন্দীগ্রামে মোট জনসংখ্যার ৭৭ শতাংশ হিন্দু এবং ২৩ শতাংশ মুসলিম। শুভেন্দু হিন্দু ভোট কিছুটা একত্রীভূত করতে পারলেও মুসলিম ভোট কতটা পাবেন তা নিয়ে সন্দেহ আছে। আর এই জয়ের উপরেই নির্ভর করছে বাংলার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ।

আরও পড়ুন: রসগোল্লা খাবে, রস ছাড়া! ৩০-এর মধ্যে নাকি ২৬ পাবে: মমতা