Micael Chakma: ওরা খিদে পেলে না খাইয়ে রাখবে, ঘুমোলে করবে অত্যাচার…

Michael Chakma Aynaghar: সেই কালো কাপড়ের ফালির মধ্য দিয়ে দেখেছিলেন সূর্য উঠছে। প্রথম ভোরের আলো। পাঁচ বছর পর, সেই প্রথমবার আলো দেখেছিলেন তিনি। এর কিছু পরই, সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ তাঁকে চট্টগ্রামের এক রাস্তার ধারে চোখ বাঁধা অবস্থাতেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তি পেয়েছিলেন মাইকেল চাকমা। তখনও তিনি জানতেন না, তার একদিন আগেই প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে বাংলাদেশ ছেড়েছেন শেখ হাসিনা।

Micael Chakma: ওরা খিদে পেলে না খাইয়ে রাখবে, ঘুমোলে করবে অত্যাচার...
৫ বছর পর আয়নাঘর থেকে বাইরে এসেছেন মাইকেল চাকমা Image Credit source: TV9 Bangla
Follow Us:
| Updated on: Aug 21, 2024 | 10:10 PM

২০২৪ সালের ৬ অগস্ট ভোর ৩টেয় ঘুম থেকে জাগানো হয়েছিল তাঁকে। চোখ বেঁধে দেওয়া হয়েছিল কালো কাপড় দিয়ে। তার উপরে ছিল আবার একটা কালো কাপড়ের ঠুলি। তারপর, তোলা হয় একটি গাড়িতে। গত কয়েক বছরে তাঁকে বেশ কয়েকবার এইভাবে চোখ বেঁধে-হাত বেঁধে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। তাই বিষয়টা মাইকেল চাকমার কাছে নতুন ছিল না। তবে, অন্যান্যবারের মতো আঁটসাঁটো করে চোখ বাঁধা হয়নি। তাই, মুখটা উঁচু করে একটু হলেও বাইরেটা অনুভব করতে পারছিলেন তিনি। সেদিন, প্রথমবার মৃত্যুভয় পেয়েছিলেন মাইকেল চাকমা। মনে করেছিলেন, তাঁকে এবার মেরে ফেলা হবে। হয়তো দেখানো হবে বেআইনি অস্ত্র পাওয়া গিয়েছে তাঁর কাছ থেকে, বা কোনও অন্য মামলা। অনেকটা যাওয়ার পর শুনেছিলেন আজানের ধ্বনি। ততক্ষণে চোখের আলগা বাঁধন, গাড়ির সিটে ঘসে ঘসে আরও কিছুটা সরিয়ে ফেলেছেন তিনি। সেই কালো কাপড়ের ফালির মধ্য দিয়ে দেখেছিলেন সূর্য উঠছে। প্রথম ভোরের আলো। পাঁচ বছর পর, সেই প্রথমবার আলো দেখেছিলেন তিনি। এর কিছু পরই, সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ তাঁকে চট্টগ্রামের এক রাস্তার ধারে চোখ বাঁধা অবস্থাতেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তি পেয়েছিলেন মাইকেল চাকমা। তখনও তিনি জানতেন না, তার একদিন আগেই প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে বাংলাদেশ ছেড়েছেন শেখ হাসিনা।

তিনি বাংলাদেশের এক উপজাতি অধিকার কর্মী। পার্বত্য চট্টগ্রামে ইউপিডিএফ নামে এক রাজনৈতিক দল তৈরি করেছিলেন মাইকেল চাকমা। তবে, ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল থেকেই তাঁর আর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। পূত্র শোকে মৃত্যু হয় তাঁর বৃদ্ধ বাবার। তিনি আর জীবিত নেই বলেই ধরে নিয়েছিল তাঁর পরিবারের লোকজন। তাই, তাঁর শেষকৃত্যও করা গিয়েছিল। ফিরে আসার পর মাইকেল নিজেই বলেছেন, “আমার প্রত্যাবর্তন আমার কাছে যেমন মর্মান্তিক তেমনই তাদের জন্য এটা অলৌকিক। আমার সত্যিই মনে হয় যেন নতুন পূনর্জীবন পেয়েছি। তবে, অনেকেই আশঙ্কা করতেন, বাংলাদেশের আরও অনেকের মতো তাঁকেও হয়তো ‘আয়নাঘরে’ আটকে রাখা হয়েছে।

আয়নাঘর, অর্থাৎ, শেখ হাসিনার আমলে তৈরি বাংলাদেশের সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের গোপন গুমখানা। শুধু মাইকেল চাকমা নয়, শেখ হাসিনার সময় তাঁর মতো হাসিনা বিরোধী আরও অনেক রাজনৈতিক নেতা, কর্মী, মানবাধিকার কর্মী, লেখক, আইনজীবী, সাংবাদিক, ব্লগারদের এই গুপ্ত গুমঘরে আটকে রাখা হত। হাসিনার বিদায়ের পর, তাঁদের অধিকাংশকেই ফিরে পেয়েছে তাঁদের পরিবার। আর অনেকেই আয়না ঘরে সামরিক গোয়েন্দাদের ‘ভালবাসা’ সহ্য করতে না পেরে নিহত হয়েছেন বলে আশঙ্কা করা হয়। এই গুপ্তঘর সম্পর্কে অনেক কল্পিত ধারণা ছড়িয়ে রয়েছে। আসলে কেমন ছিল আয়নাঘরের জীবন? মুক্তির পর অনেক কথাই জানিয়েছেন মাইকেল চাকমা।

২০১৯-এর ৯ এপ্রিল, নারায়নগঞ্জে এক দলীয় কর্মসূচি সেরে ঢাকায় ফিরেছিলেন মাইকেল চাকমা। তিনি জানিয়েছেন, ঢাকার শ্যামলি থেকে সাদা পোশাকের কয়েকজন ব্যক্তি তাঁকে একটি গাড়িতে করে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। ওই দিনই প্রথম কালো কাপড়ে চোখ বাঁধা এবং হাত বাঁধা শুরু হয়েছিল তাঁর। একটি ওয়াকিটকি দেখে তিনি বুঝেছিলেন, তাঁকে যারা তুলে নিয়ে যাচ্ছে, তারা বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর লোক। অথচ, তিনি নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পর, এক পুলিশ কর্তা বলেছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে অনেকগুলি গুরুতর অভিযোগের রয়েছে। গ্রেফতারি এড়াতে সম্ভবত আত্মগোপন করেছেন মাইকেল। স্পষ্টতই বেআইনিভাবেই আটক করা হয়েছিল তাঁকে।

তবে, আয়নাঘরের বন্দিদের যতটা শারীরিক অত্যাচার করা হয় বলে, শোনা যায়, মাইকেল চাকমার অভিজ্ঞতা সেই রকম ছিল না। শুরুর দিকে নিয়মিত জেরা করা হত। চেয়ারে বসিয়ে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় তাঁকে ২৪০ ভোল্টের বৈদ্যুতিক শক দেওয়ার ভয় দেখানো হয়েছে। তবে, কখনও মারধর করা হয়নি। তবে, বাকিদের ভাগ্য ততটা প্রসন্ন ছিল না। সহবন্দিদের অনেকেরই কান্নার শব্দ শুনেছেন মাইকেল। জাকির নামে তাঁর পাশের সেলে বন্দি এক ব্যক্তি একবার প্রবল মার খেয়েছিল। সেলে ফিরে তিনি বলেছিলেন, “আমাকে আজকে অনেক মারধর করেছে। ওহ পারছি না। আমার জ্বর উঠছে।”

শারীরিক নির্যাতন না হলেও, বন্দিত্বের ৫ বছরে মাইকেল চাকমাকে ভয়ঙ্কর মানসিক নির্যাতনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। এই গোপন কারাগারকে তাঁর ‘কবর’ বলে মনে হয়েছিল। তিনি জানিয়েছেন, দীর্ঘ ৫ বছরে তাঁকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ৪-৫টি গোপন বন্দিশালায় রাখা হয়েছিল। তাঁর মতো আরও অনেক মানুষকে সেই সব জায়গায় আটকে রাখা হয়েছিল। তাদের তিনি দেখতে পেতেন না। তবে, তাদের কথা শুনতে পেতেন। কখনও কখনও স্নান করাতে নিয়ে যাওয়ার সময়, তাদের অবয়বটা দেখতে পেতেন। মুখ ঢাকা থাকত, তাই মুখ দেখার উপায় ছিল না। কেই ছিলেন পাঁকা চুলের, কেউ কম বয়সী, কারও বয়স হয়ত পঞ্চাশ-পঁয়তাল্লিশ, কেউ কেউ ষাটের উপরে, আবার কেউ একদম তরুণ।

কয়েদখানার কক্ষগুলি ছিল কোনোটা সাত ফুট বাই এগারো ফুট, কোনোটা আট ফুট বাই এগারো বা বারো ফুট – এই রকম ছোট ছোট। ভিতরে একটা তিন ফুট বাই সাত ফুটের লোহার বা কাঠের খাট থাকত। ঘরে আলো-বাতাস আসার কোনও উপায় ছিল না। জানালা ছিল না। ছিল একসঙ্গে দুটি স্তরের দরজা। ভিতরের স্তরে কাঠের দরজা, বাইরেরটা লোহার। কাঠের দরজাটা মাঝে মাঝে খোলা থাকলেও, তা দিয়ে দেখার কিছু ছিল না। সামনে ছিল একটা একই ধরনের দেখতে দেওয়াল। সারাক্ষণ বড় বড় একজস্ট ফ্যান চলত। অবিরাম সেই আওয়াজ শুনতে হত। তার মধ্য দিয়েই কাছাকাছির কক্ষগুলি থেকে সহবন্দিদের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসত।

সারাদিন ফ্যান চললেও, গরমের দিনে, কক্ষের ভিতরগুলিতে তীব্র গরম থাকত। গোটা গা ভিজে যেত ঘামে। আর বন্দিদের জন্য পরিস্থিতিটা আরও অসহনীয় করে তোলার জন্য ঘুরিয়ে দেওয়া হত এগজস্ট ফ্যানগুলিতে। যার ফলে, বাইরের গরম হাওয়া ঢুকত আয়নাঘরের ভিতরে। আবার শীতকালে যাতে বাইরে থেকে ঠান্ডা বাতাস ঢোকে, তার ব্যবস্থা করা হত। মাইকেল চাকমা জানিয়েছেন, “তারা নিরলসভাবে এই কাজগুলো করে যেত। আপনি শান্তিতে ঘুমোচ্ছেন লক্ষ্য করলে তারা আপনাকে জাগিয়ে তুলবেই। যদি দেখে আপনি ক্ষুধার্ত, তাহলে তারা খাবার বন্ধ করে দেবে।”

দিনে তিনবার খেতে দেওয়া হত। সকালে জলখাবার, আর দুবেলা ভাত। সঙ্গে রোজই মাছ মাংস থাকত। তবে, মাঝে-মাঝেই খাবারে ইচ্ছা করে এত ঝাল দেওয়া হত, যে সেই খাবার মুখে তোলা যেত না। কখনও ডাল পচা থাকত, ফেনা উঠে যাওয়া। কখনও পচা মাংস বা মাছ দেওয়া হত। আয়নাঘরের যাপন সম্পর্কে এই উপজাতি নেতা বলেছেন, “যেভাবে তারা রাখে তা তো অত্যন্ত অমানবিক। এটা মানুষের বসবাসের জায়গা না। মানুষ এভাবে বাঁচে না। এটা কবরের মতো। গুহার মতো। গুহায় বা কবরে থাকলে মানুষ যেমন কিছুই দেখতে পায় না, ঠিক সেই রকম। এটা তো মানুষের বাঁচার মতো কোনও জায়গা না। কোনও জানলা নাই, একদম কোনো আলো ঢোকে না, বাতাস ঢোকে না। শুধু চারিদিকে দেওয়াল।”

মাইকেল চাকমা জানিয়েছেন, তিনি সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যুক্ত সন্দেহে তাঁকে ধরা হয়েছিল। তিনি কোথায় অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছেন, সেই সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। ভয় পেলেও তিনি সত্যি কথাই বলেছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, তিনি কোনোদিন বন্দুক ধরেননি। গোলবারুদের রাজনীতি তিনি করেন না। এরপরই তাঁকে বৈদ্যুতিক শক দেওয়ার ভয় দেখানো হয়েছিল। জেরাকারী বলেছিলেন, প্রশ্নের ঠিক-ঠিক জবাব না দিলেই তিনি পুড়ে ছাই হয়ে যাবেন। তবে সেটা নেহাতই ভয় দেখানো ছিল। প্রথম কয়েক মাস জেরা করার পর তাঁকে আর ঘাঁটানো হয়নি। তবে আটকে রাখা হয়েছিল। সেই সঙ্গে চলত ওই মানসিক নির্যাতন। মাইকেল চাকমা জানিয়েছেন, তাঁর পরিবারের কথা খুব মনে পড়ত।

বাবার চোখের সমস্যা ছিল। ভাবতেন পরিবারের সদস্যরা নিশ্চয় তাঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কখনও থানায় দৌড়চ্ছে, কখনও আদালতে। তাঁর সঙ্গে একই কক্ষে দুবার দুজনকে রাখা হয়েছিল। একজনের নাম সাইদুল, অপরজন এরশাদ। প্রথম জনের বাড়ি রংপুরে, অপরজনের ঢাকায়। সহবন্দি হলেও, তাদের নিজেদের মধ্যে কথা বলার অনুমতি ছিল না। কোনো কারণে গার্ডরা কাঠের দরজাটা বন্ধ রাখলে, তবেই কথা বলতে পারতেন। সাইদুলকে যেদিন সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয়, সেদিন মাইকেল তাঁকে তাঁর বোনের ফোন নম্বর দিয়েছিলেন। সুযোগ পেলে, তাঁর বাড়িতে একটা খবর দিতে বলেছিলেন। কিন্তু পরে বুঝেছিলেন, মোবাইল নম্বরের শেষের একটা সংখ্যা তিনি ভুল বলেছিলেন। একটা সময় ধরেই নিয়েছিলেন, আর কোনও দিন পরিবারের সঙ্গে দেখা হবে না। দিনের আলো চোখে পড়বে না। তিনি বলেছেন, “যে গার্ড আমায় শৌচাগারে নিয়ে যেত, আমি প্রায়ই তাঁকে অনুরোধ করতাম আমায় গুলি করে মেরে ফেলার জন্য।”

শেষ পর্যন্ত, হাসিনার বিদায়ের পর, আরও অনেকের মতো আয়নাঘর থেকে বেরিয়ে দিনের আলো দেখেছেন মাইকেল চাকমা। তবে, আয়নাঘরকে এখনও তাঁকে পিছনে টেনে ধরছে। মাইকেল চাকমা জানিয়েছেন, মুক্ত জীবনে তাঁকে ঘিরে ধরছে দুঃস্বপ্ন এবং মানসিক উদ্বেগ। কোনও শব্দ হলেই আঁতকে উঠছেন। নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারছেন না। ভুলেই গিয়েছেন নিশ্চিন্তে ঘুমোনো যায়। তিনি বলেছেন, “বাইরের পৃথিবীর সবকিছুই আমার কাছে খুব ভীতিকর মনে হচ্ছে।”