অ-মুসলিম পার্বত্য চট্টগ্রাম ভারতেরই অংশ! মাউন্টব্যাটনের ‘প্রতারণায়’ কীভাবে বাংলাদেশের হল, জানুন সেই গল্প

Bangladesh: একসময় ত্রিপুরার সঙ্গে যুক্ত ছিল এই পার্বত্য চট্টগ্রাম। সেই সময় থেকে ত্রিপুরা জনজাতির বাস রয়েছে। এছাড়াও বাস করে চাকমা, মারমা, মুরং-এর মতো জনজাতির মানুষ। এরা মূলত বৌদ্ধ ধর্ম অনুসরণ করেন।

অ-মুসলিম পার্বত্য চট্টগ্রাম ভারতেরই অংশ! মাউন্টব্যাটনের 'প্রতারণায়' কীভাবে বাংলাদেশের হল, জানুন সেই গল্প
Image Credit source: GFX- TV9 Bangla
Follow Us:
| Updated on: Dec 12, 2024 | 8:00 PM

আজ বাংলাদেশের অশান্তির আবহে শুধু নয়, প্রায়ই নানা কারণে শিরোনামে উঠে আসে পার্বত্য চট্টগ্রাম। বাংলাদেশে সরকারকেও বারবার উদ্বিগ্ন হতে হয়েছে এই পার্বত্য চট্টগ্রাম। অ-মুসলিম নাগরিকদের উপর অত্যাচারের ঘটনা সামনে আসে প্রায়ই। তবে এই অঞ্চল নিয়ে বিতর্ক আজকের নয়। সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই রয়েছে বিভ্রান্তি। আর দেশভাগের সময় কি ‘ভুল’ হয়ে গিয়েছিল? মুসলিম জনসংখ্যা কম থাকা সত্ত্বেও কীভাবে পাকিস্তানের হাতে চলে গেল ‘চট্টগ্রাম হিল ট্র্যাক্ট’?

পার্বত্য চট্টগ্রাম কোথায়? কারা থাকেন?

বাংলাদেশের চট্টগ্রামের একটা অংশ হল পার্বত্য চট্টগ্রাম। ভারতের সীমান্ত ঘেঁষে রয়েছে ওই অঞ্চল। রাঙামাটি, বান্দারবান, খাগড়াছড়ি নিয়ে গঠিত ওই অঞ্চল। পাহাড় আর বনভূমিতে ঘেরা পার্বত্য চট্টগ্রামে কান পাতলে শোনা যায় কর্ণফুলী নদীর পথচলার শব্দ।

একসময় ত্রিপুরার সঙ্গে যুক্ত ছিল এই পার্বত্য চট্টগ্রাম। সেই সময় থেকে ত্রিপুরা জনজাতির বাস রয়েছে। এছাড়াও বাস করে চাকমা, মারমা, মুরং-এর মতো জনজাতির মানুষ। এরা মূলত বৌদ্ধ ধর্ম অনুসরণ করেন। হিন্দু ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদেরও বাস রয়েছে সেখানে, তবে মুসলিম ধর্মের বাসিন্দার সংখ্যা খুবই কম। বর্তমানে পরিসংখ্যান বলছে, ওই অঞ্চলে, ৯৭ শতাংশ মানুষ অ-মুসলিম। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমন কল্যাণ লাহিড়ী জানান, ওই অঞ্চলের মানুষদের সঙ্গে বাকি বাংলাদেশের সংস্কৃতিক অনেক তফাৎ আছে। তাই আজও রয়ে গিয়েছে বিতর্ক।

অবিভক্ত ভারতে চট্টগ্রাম ছিল মূলত বাংলা প্রদেশের অন্তর্গত। ১৯৪৭ সালে এই এলাকা পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। পরে ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের পর বাংলাদেশের জেলা হিসেবে জায়গা করে নেয় পার্বত্য চট্টগ্রাম। কিন্তু প্রশ্ন হল, মুসলিম না থাকা সত্ত্বেও দেশভাগের সময় কেন পাকিস্তানের ভাগে পড়ল এই চট্টগ্রাম হিল ট্র্যাক্ট। ব্রিটিশদের ভুল? নাকি অন্য কোনও ছক ছিল এর পিছনে?

অ-মুসলিমদের উপর অত্যাচার, খুনের অভিযোগ

গত সেপ্টেম্বর মাসে খুন হন অন্তত ১০ জন অ-মুসলিম। পোড়ানো হয় ওই অঞ্চলে বসবাসকারী চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, কুকি, ব্রু এবং অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষের বাড়ি, ধর্মস্থান, দোকান, এমনকী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত। জারি হয় ১৪৪ ধারা। ওই এলাকার বাসিন্দারা অভিযোগ তোলেন, মহম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাদের আদিবাসী তকমা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ মনে করছেন, পরিকল্পনা করেই অন্তর্বর্তী সরকার হিংসা ছড়াচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের জনবিন্যাস বদলে দেওয়ার চেষ্টা চলছে বলেও অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে।

ভারতের হস্তক্ষেপও চেয়েছিলেন চাকমারা

পার্বত্য চট্টগ্রামে যে চাকমা জনজাতির বসবাস, তাদের সঙ্গে ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যের বাসিন্দাদের অনেক মিল আছে। ভারতের ওই অংশেও চাকমা জনজাতির বসবাস রয়েছে। তাই বাংলাদেশে যখন চাকমা তথা আদিবাসীদের ওপর হামলার অভিযোগ উঠছে, তখন গর্জে উঠেছিল ভারতের ওই অংশের বাসিন্দারাও। শুধু পথে নেমে প্রতিবাদই জানাননি তাঁরা, ভারত সরকারের শরণাপন্নও হয়েছিলেন তাঁরা।

নয়া দিল্লির কাছে তাদের আর্জি ছিল, চাকমাদের ওপর অত্যাচারের ঘটনায় হস্তক্ষেপ করুক ভারত। বাংলাদেশি সংখ্যাগুরুদের অত্যাচারেই চাকমাদের মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছিল সেই সময়।

পার্বত্য চট্টগ্রামের সঙ্গে শান্তি-চুক্তি করতে হয় বাংলাদেশ সরকারকে

বাংলাদেশের সব নাগরিককে বাঙালি হিসেবে চিহ্নিত করে সে দেশের সরকার। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ সেটার বিরোধিতা করে। এই নিয়ে অশান্তি ছিল দীর্ঘদিন ধরে। পরে ১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

এই চুক্তি অনুযায়ী, পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি ও আদিবাসীদের এক বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়। একটি আঞ্চলিক পরিষদ প্রতিষ্ঠা করা হয়। চাকমা, ত্রিপুরা, মুরাং, মারমা উপজাতির মানুষ এই পরিষদ গঠন করেন।

পার্বত্য চট্টগ্রাম পাবে ভারতই, এটা প্রায় নিশ্চিত ছিল

চাকমারা মনে করেন, আসলে পাকিস্তানের অংশ করে দিয়ে তাঁদের সঙ্গে অবিচার করা হয়েছিল। ১৯৪৭ সালের মার্চ মাসে ভারতে আসেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন। মাত্র ৬ মাসের মধ্যে শেষ হয় পার্টিশনের কাজ। ওই বছরের ৯ অগস্ট পেশ হয় র‌্যাডক্লিফ কমিশনের রিপোর্ট।

সেই রিপোর্টে যখন দেখা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাকিস্তানের অংশ করে দেওয়া হয়েছে, তখনই প্রবল ক্ষোভ প্রকাশ করেন সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল। তিনি মাউন্টব্যাটেনকে একটি কড়া চিঠি দেন। পরবর্তীতে মাউন্টব্যাটেন তাঁর আত্মজীবনীতে সেই পার্বত্য চট্টগ্রামের কথা উল্লেখ করেছিলেন।

আসলে পার্বত্য চট্টগ্রাম যে ভারতেরই অংশ হবে, তা অনুমানযোগ্যই ছিল। ওই এলাকার মানুষজনও সেটাই বিশ্বাস করতেন। কিন্তু মাউন্টব্যাটেনের সিদ্ধান্তে সবাই অবাক হয়ে যান। এমনকী বাউন্ডারি কমিশনের মুসলিম সদস্য মহম্মদ মুনীর পরবর্তীতে জানিয়েছিলেন, তিনিও বেশ অবাক হয়েছিলেন ওই সিদ্ধান্তে। তিনি বলেছিলেন, “আমি প্রথম থেকেই নিশ্চিত ছিলাম, চট্টগ্রাম হিল ট্র্যাক্ট ভারতকেই দেওয়া হবে।” সব নিয়ম-নীতির বিরুদ্ধে গিয়ে এটা করা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমন কল্যাণ লাহিড়ী বলছেন, “পার্টিশনের নীতি না মেনেই পার্বত্য চট্টগ্রাম পাকিস্তানকে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর ১৯৭১ সালে বহু বাঙালি এই চট্টগ্রামে হিল ট্র্যাক্টে ঢুকে যায়। বিশেষ করে যে সব বাঙালির জমি ছিল না, তাদের ওই পার্বত্য চট্টগ্রামে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।”

কেন এমন কাজ করেছিলেন মাউন্টব্যাটেন?

কেউ কেউ মনে করেন, চট্টগ্রাম হিল ট্র্যাক্টের যা অবস্থান তাতে ওই অঞ্চলকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের হাতে তুলে দেওয়া দরকার ছিল। আবার অনেকে মনে করেন, চট্টগ্রামের বন্দরটি যাতে পাকিস্তানের দিকে চলে যায়, সেই জন্যই ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মাউন্টব্যাটেন।

চাকমারা মানতে পারেন না আজও…

দেশভাগের পর যখন স্বাধীনতার পতাকা উড়ছে সর্বত্র, তখন চট্টগ্রামের চাকমা ও অন্যান্য মানুষজন ভারতের পতাকা উড়িয়েছিলেন, কারণ তাঁরা বিশ্বাস করতে পারেননি যে তাঁদের ওই অঞ্চল পাকিস্তানে যেতে পারে। পরবর্তীতে পাকিস্তানের সেনা গিয়ে পাক পতাকা ওড়ায়। ২০২০ সালেও দেখা গিয়েছে, চাকমা ন্যাশনাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া ‘কালা দিবস’ পালন করেছে। দেশভাগের সময় কেন পার্বত্য চট্টগ্রাম ভারতে রাখা হল না, তা নিয়ে আজও অসন্তোষ প্রকাশ করেন সেখানকার একাংশের মানুষ। আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারও চান তাঁরা।