TV9 Explained: ‘গরিবের প্রধানমন্ত্রী’ হয়ে উঠতে পারবেন ঋষি সুনক? চরম দারিদ্রে তলিয়ে যাবে না তো ব্রিটেন?

Rishi Sunak Economic Policy: সদ্য যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন ঋষি সুনক। কিন্তু, তাঁর সামনের রাস্তাটা অত্যন্ত কাঁটা বিছানো। পাহাড় প্রমাণ সমস্যায় রয়েছে ব্রিটেনের অর্থনীতি।

TV9 Explained: 'গরিবের প্রধানমন্ত্রী' হয়ে উঠতে পারবেন ঋষি সুনক? চরম দারিদ্রে তলিয়ে যাবে না তো ব্রিটেন?
চ্যান্সেলর হিসেবে আয়করে ছাড় দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ঋষি
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Nov 01, 2022 | 3:00 PM

লন্ডন: সদ্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন ঋষি সুনক। কিন্তু, তাঁর সামনের রাস্তা অত্যন্ত কাঁটা বিছানো। পাহাড় প্রমাণ সমস্যায় জর্জরিত ব্রিটেনের অর্থনীতি। মাত্র কয়েক মাস আগে পর্যন্ত চ্যান্সেলর বা ব্রিটেনের অর্থমন্ত্রীর পদে ছিলেন তিনি। এবার তিনি শীর্ষপদে। সিংহাসনে বসেও অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রকাশের সময় পিছতে বাধ্য হয়েছেন সুনক। তাঁর সরকার জানিয়েছে, “সঠিক সিদ্ধান্ত” নেওয়ার জন্য তাদের আরও সময় চাই। ১৭ নভেম্বর প্রথম অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রকাশ করবে তারা। কিন্তু, কেমন হবে সেই পরিকল্পনা? গরিবদের প্রধানমন্ত্রী হয়ে উঠতে পারবেন ঋষি সুনক? নাকি যে বৃত্তে দাঁড়িয়ে একদা অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ঠিক করেছিলেন, তার ছাপই পড়তে চলেছে নতুন পরিকল্পনায়?

গভীর অর্থনৈতিক সঙ্কট

বর্তমানে, ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ব্রিটেন। মন্দা অনিবার্য বলে মনে করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব আঁচ পড়েছে ব্রিটেনেও। কোভিড-১৯ মহামারির পর যে পরিমাণ অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রত্যাশিত ছিল, তা করে দেখাতে পারেনি ব্রিটেন। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তীব্র জ্বালানি সঙ্কট। ব্রিটিশ পাউন্ডের মূল্যের নাটকীয় পতন বিপদ আরও বাড়িয়ে তুলেছে। ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির জেরে ব্রিটেনে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনযাত্রার মান পড়ছে। ‘আসদা ইনকাম ট্র্যাকারের’ তথ্য অনুসারে, গত ৯ মাসে প্রায় কোনও আয় নেই এমন পরিবারের সংখ্যা ২০ শতাংশ থেকে দ্বিগুণ হয়েছে। সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ব্রিটেনের মধ্যবিত্তরা। একদিকে আয় বাড়েনি, অন্যদিকে প্রতিদিনই বেড়েছে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম। জীবনযাত্রার খরচ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আরও গরিব হয়েছেন তাঁরা। কোভিড মহামারীর সময় কোনও পোক্ত সমাধান দেখাতে পারেননি তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ঋষি সুনক।

ট্রাসের পর ঋষি

ব্রিটেনের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার কেন্দ্রেও ছিল এই আকাশচুম্বী মূল্যবৃদ্ধির মোকাবিলা করার প্রশ্ন। ট্রাস সরকার মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কল্যাণমূলক সুবিধা বাড়ানোর বিষয়ে চিন্তা করছিল। যা প্রায় ৩ কোটি মানুষকে কিছুটা স্বস্তি দিতে পারত। কিন্তু, তার জেরে ব্যাপক ভাবে বেড়েছে দেশের রাজস্ব ঘাটতি। এবার, ঋষি সুনকের সরকার কী করবে? লিজ ট্রাসের সঙ্গে নির্বাচনী লড়াইয়ের প্রচার পর্বে ঋষি সুনক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলে তিনি জ্বালানি ক্ষেত্রের ক্রমবর্ধমান খরচের মোকাবিলায় সহায়তা প্রদানের জন্য আরও অর্থ প্রদান করবেন। নির্বাচনে জয় পাননি তিনি। বস্তুত, কীভাবে ব্রিটেনের অর্থনৈতিক সঙ্কটের মোকাবিলা করবেন, তার কোনও রূপরেখা না দেখিয়েই, নির্বাচনে পরাজিত হওয়া সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন তিনি। তাই সুনকের আগামী পদক্ষেপ নিয়ে ধোঁয়াশায় রয়েছেন ব্রিটেনের নাগরিকরা। এর আগে ব্রিটেনের চ্যান্সেলর বা অর্থমন্ত্রী ছিলেন তিনি। গত বসন্তেই মিনি বাজেট পেশ করেছিলেন। কেমন ছিল সেটি?

সুনকের মিনি বাজেট

জীবনযাত্রার ব্যয় কমাতে, তৎকালীন চ্যান্সেলর জানিয়েছিলেন জ্বালানি শুল্ক কমানোর কথা। এছাড়া সোলার প্যানেল, হিট পাম্প বা ইনসুলেশন ইনস্টল করার জন্য ‘ভ্যাট’ তুলে নিয়েছিলেন। এছাড়া, সরকারের তরফে হাউসহোল্ড সাপোর্ট তহবিল দ্বিগুণ করেছিলেন। আগেই সুনক জাতীয় বিমা অবদান ১.২৫ শতাংশ-পয়েন্ট বৃদ্ধি করেছিলেন। বিরোধীদের প্রবল দাবির মধ্যেও মিনি বাজেটে তা কমাননি। তবে, জাতীয় বিমা অবদানের থ্রেশোল্ড অনেকটা বাড়িয়েছিলেন। এই পদক্ষেপকে তিনি ৩ কোটি মানুষের জন্য সর্বাধিক ব্যক্তিগত কর ছাড়ের সমান বলে দাবি করেছিলেন।

এছাড়া, ২০২৪ সালে আয়করের মূল হার ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৯ শতাংশ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সুনক বলেছিলেন, “কর ছাড়কে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে মানানসই করতে হবে।” অন্যদিকে, ব্রিটেনের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে ব্যবসায়িক বিনিয়োগের জন্য ছাড় বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সুনক। জানিয়েছিলেন, শরৎকালীন বাজেটে ব্যবসায় বিনিয়োগের ওপর করের হার কমিয়ে দেওয়া হবে। পাশাপাশি, ছোট ব্যবসার জন্য কর্মসংস্থান ভাতা বাড়িয়েছিলেন।

ব্যর্থ ঋষি?

এই মিনি বাজেটের পর, বিরোধীরা, অর্থনীতিবিদরা, এমনকি তাঁর নিজের দলের লোকজনও বলেছিলেন, ঋষি সুনক ব্রিটেনের সবচেয়ে দরিদ্র পরিবারগুলিকে অর্থনৈতিক ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করে বলেছিলেন, ব্রিটেনে চরম দারিদ্রের থাকা মানুষের সংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়তে চলেছে। চ্যান্সেলর এই মানুষদের সাহায্য করার জন্য আরও কিছু করতে পারতেন। তাঁর বাজেটের সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই।

ব্রিটেনের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ পল জনসনের মতে, সুনক একই সঙ্গে জাতীয় বীমা ১.২৫ শতাংশ পয়েন্ট বৃদ্ধি করেছেন এবং ভবিষ্যতে আয়কর কমানোর কথা ঘোষণা করেছেন। এটা অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিভ্রান্তিকর। তবে, এর পিছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে। তাঁর মিনি বাজেট করের বোঝা বৃদ্ধি রোখার জন্য যথেষ্ট নয়।” তাঁর মতে, ঋষি সুনক নিম্ন এবং মধ্য আয়ের পরিবারগুলির সমর্থন আদায়ের জন্য তাঁর ‘কর-কাটার’ ভাবমূর্তির পুনর্নির্মাণকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন।

বিরোধী লেবার পার্টি বলেছিল, সুনক গত ৭০ বছরের মধ্যে করের বোঝাকে সর্বোচ্চ স্তরে নিয়ে যাচ্ছেন। সমাজের সবচেয়ে দরিদ্রতম অংশকে সাহায্য করার জন্য তিনি প্রায় কিছুই করেননি। ট্রেজারির শ্যাডো মুখ্য সচিব, প্যাট ম্যাকফ্যাডেন বলেন, “এই সিদ্ধান্তগুলি আগামী বছরে জীবনযাত্রার সঙ্কটকে আরও বাড়িয়ে তুলবে।” কনজারভেটিভ দলের সাংসদ লি অ্যান্ডারসন বলেছিলেন, “যে পরিমাণ জ্বালানী শুল্ক কমানো হয়েছে, তা সমুদ্র থেকে এক ফোটা জল সরানোর মতো। কারণ এতে পেট্রোলের দাম কমে, গত সপ্তাহের দামে পৌঁছেছে মাত্র।” এমনকি, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন নিজেই স্বীকার করেছিলেন, সুনকের নেওয়া ব্যবস্থাগুলি যথেষ্ট নয়। বলেছিলেন, “আমাদের আরও কিছু করতে হবে। জীবনযাত্রার ব্যয় কমানোটাই আমাদের অগ্রাধিকার।”

এরপর কী?

সুনক অবশ্য দাবি করেছিলেন, প্রতিটি সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। তবে, জ্বালানী শুল্ক হ্রাস, জাতীয় বিমার থ্রেশোল্ড বৃদ্ধি এবং আয় কর ছাড়ের প্রতিশ্রুতির মতো পদক্ষেপগুলি দুই বছরের মধ্যেই পার্থক্য গড়ে দেবে। এবার, তিনিই প্রধানমন্ত্রী। অর্থনৈতিক পরিকল্পনা এখনও প্রকাশ না করলেও, শোনা যাচ্ছে আপাতত দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির পরিকল্পনা আপাতত মাথা থেকে সরিয়ে ফেলছেন সুনক। ক্রমবর্ধমান সুদের হার, দুরন্ত মুদ্রাস্ফীতি এবং সম্ভাব্য মন্দার কারণে তৈরি হওয়া সরকারি কোষাগারের বড় সড় ফাঁক তৈরি হয়েছে। সেই ফাঁক ভরাটের দিকে মনোনিবেশ করবেন তিনি। সূত্রের খবর, অর্থনীতিকে উদ্দীপ্ত করার জন্য উপলব্ধ সংস্থান নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে। এই অবস্থায় চরম দারিদ্রে তলিয়ে যাওয়া ব্রিটিশ জনগণকে কি তিনি উদ্ধার করতে পারবেন? করলে কীভাবে? দলের সমর্থন পাবেন তিনি? এখন এগুলোই দেখার।