Explain: কেন ঘনিয়ে উঠছে চিন-তাইওয়ান যুদ্ধ? বেজিং জিতলে ভারতের সর্বনাশ
China-Taiwan conflict: কেন তাইওয়ানকে তাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করে চিন? যদি বেজিং তাইওয়ান দখল করে নেয় তাহলে কতটা চাপে পড়বে ভারত?
তাইপেই: রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের আবহে এশিয়া মহাদেশেও দেখা যাচ্ছে যুদ্ধের ছায়া। তাইওয়ানকে দীর্ঘদিন ধরেই তাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে দাবি করলেও, সামরিক অভিযানের রাস্তায় হাঁটেনি চিন। তবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যত তাইওয়ানের দিকে সহায়তার হাত প্রসারিত করছে, ততই দাঁত-নখ বার করছে বেজিং। কিন্তু, কেন হঠাৎ গণতান্ত্রিক একটি দেশকে চিন তাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে দাবি করে? যদি শেষ পর্যন্ত চিনের দখলে চলে যায় তাইওয়ান, বৈশ্বিক কূটনীতিতে কী পরিবর্তন আসবে? ভারতেরই বা কী হবে?
কেন চিন তাইওয়ানকে তাদের দেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করে?
এই প্রশ্নের উত্তর বুঝতে গেলে, উঁকি মারতে হবে ইতিহাসে। তাইওয়ান চিনের মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপ। সপ্তদশ শতকে চিনে কিং রাজবংশের শাসনকালে প্রথমবার এই দ্বীপটি চিনের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে এসেছিল। ১৮৯৫ সালে, প্রথম চিন-জাপান যুদ্ধে পরাজয় হয়েছিল চিনের। সেই সময় দ্বীপটির দখল নিয়েছিল জাপানিরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর, ১৯৪৫ সালে চিন ফের তাইওয়ানের দখল নিয়েছিল। কিন্তু, এরপরই চিয়াং কাই-শেকের নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী চিন সরকার এবং মাও সেতুং-এর কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে চিনের মূল ভূখন্ডে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল। ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্টরা জয়লাভ করার পর, চিয়াং কাই-শেক এবং তাঁর জাতীয়তাবাদী দল, কুওমিনতাং-এর বাকি নেতারা পালিয়ে গিয়ে তাইওয়ানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পরবর্তী কয়েক দশক কুওমিনতাং, তাইওয়ান শাসন করেছিল তারা। এই ইতিহাস তুলে ধরেই চিন দাবি করে, তাইওয়ান বরাবরই চিনের একটি প্রদেশ ছিল।
তাইওয়ান কী মনে করে?
একই ইতিহাসের উল্লেখ করে, তাইওয়ান যুক্তি দেয় যে, তারা কখনই আধুনিক চিন রাষ্ট্রের অংশ ছিল না। ১৯১১ সালের বিপ্লবের পরে যে চিন রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল, তারও অংশ ছিল না। ১৯৪৯ সালে মাওয়ের নেতৃত্বে যে গণপ্রজাতন্ত্রী চিন রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল, তারও নয়। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, তাইওয়ানের বেশিরভাগ নাগরিকই চিন-তাইওয়ান সমস্যা বিষয়ে বর্তমান “স্থিতিশীলতা” বজায় রাখতে চান। বেজিং যদি আক্রমণ না করে, সেই ক্ষেত্রে অবশ্য অধিকাংশই চিনের থেকে স্বাধীন হতে চান। আসলে তাইওয়ানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণই চিনের সঙ্গে তাদের দেশের একীকরণের বিরোধী। ৭০ শতাংশ জনগণ মনে করে, তাদের দেশ একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র, যার সরকারি নাম ‘চিন প্রজাতন্ত্র’। তাই চিনের থেকে আলাদা করে স্বাধীনতা প্রাপ্তির কিছু নেই।
তাইওয়ান-চিনের ব্যবসায়িক সম্পর্ক
চিন-তাইওয়ান রাজনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্যেও, বাণিজ্যিক দিক থেকে দুই অর্থনীতিই একে অপরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে, তাইওয়ানের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার হল চিনের মূল ভূখন্ড। অন্যদিকে, চিনের মূল ভূখন্ডের সঙ্গে যে হাতো গোনা কয়েকটি দেশের ট্রেড সারপ্লাস বা বাণিজ্য উদ্বৃত্ত রয়েছে, তার একটি হল তাইওয়ান।
২০১৪ সাল থেকেই তাইওয়ানের সবচেয়ে বড় পণ্য সরবরাহকারী হল চিনা মূল ভূখন্ড। ২০২১ সালে, তাইওয়ানের মোট রফতানির ২৮.২১ শতাংশই হয়েছিল মূল ভূখন্ডে। বিভিন্ন যন্ত্র, যন্ত্রাংশ, প্লাস্টিক, রবার এবং রাসায়নিক পণ্যের পাশাপাশি, গত বছর তাইওয়ানে উৎপাদিত ইন্টিগ্রেটেড সার্কিটের ৬২ শতাংশই রফতানি করা হয়েছিল মূল ভূখণ্ডে। তবে, বিভিন্ন ফল, তাজা এবং হিমায়িত মাছ-সহ তাইওয়ানের বেশ কয়েকটি পণ্যের , উপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। আবার তাইওয়ানে সবচেয়ে বেশি আমদানিও করা হয় চিনের মূল ভূখণ্ড থেকেই। ২০২১-এ তাইওয়ানের মোট আমদানীর ২১.৬২ শতাংশই এসেছিল চিনের মূল ভূখণ্ড থেকে। গত বছর দ্বীপরাষ্ট্রটি ২০০০ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের চিপ কিনেছিল বেজিং থেকে। ২০১৭ থেকে ২০২১-এর মধ্যে, মূল ভূখণ্ড থেকে আমদানির পরিমাণ ৬৪.৮২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাণিজ্য বৃদ্ধি পেলেও, গত এক দশকে দুই অর্থনীতির মধ্যে পারস্পরিক বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ২০২১ সালে চিনের মূল ভূখণ্ডে তাইওয়ানের বিনিয়োগের বার্ষিক মূল্য দাঁড়িয়েছে ৫৮৬ কোটি মার্কিন ডলার। ২০১০ সালের তুলনায় প্রায় ৬০ শতাংশ কম। অন্যদিকে, ২০২১-এ দ্বীপরাষ্ট্রে, চিনা মূল ভূখণ্ডের বিনিয়োগ ছিল মাত্র ১১ কোটি ৬২ লক্ষের মতো। যা ২০১৩ সালের বিনিয়োগের তুলনায় ৬৬.৭৩ শতাংশ কম।
চিন-তাইওয়ানের ভৌগলিক-সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় সম্পর্ক
তাইওয়ান দ্বীপ চিনের মূল ভূখণ্ডের থেকে আনুমানিক ১০০ মাইল দূরে অবস্থিত। মূল ভূখণ্ড থেকে দ্বীপটিকে পৃথক করেছে তাইওয়ান প্রণালী। তবে, দ্বীপরাষ্ট্রটির সংস্কৃতি মূলত চিনের মূল ভূখণ্ড দ্বারাই প্রভাবিত। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে থাকে পরিবার। তবে, তাইওয়ানের সংস্কৃতি ঐতিহ্যগত জাপানি সংস্কৃতির দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছে। যা ছিল আরও শ্রেণিবিভক্ত এবং সামন্ততান্ত্রিক। এছাড়া, তাইওয়ানের সংস্কৃতি, উরজাতি সংস্কৃতি দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছে। ১৯৪৫ সালের পর তাইওয়ান থেকে জাপানি সাংস্কৃতিক উপাদানগুলিকে নির্মূল করার পাশাপাশি চিনা সংস্কৃতির প্রচারের প্রচেষ্টা করা হয়েছিল। বর্তমানে, রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যেও, মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সাংস্কৃতিক, ধর্মীও আদানপ্রদানের রাস্তা খোলা রয়েছে। দুই দেশের পণ্ডিত এবং শিক্ষাবিদরা প্রায়শই অন্য দেশের প্রতিষ্ঠানগুলি পরিদর্শন করেন। উভয় পক্ষের প্রকাশিত বইগুলি নিয়মিতভাবে অন্য পক্ষে পুনঃপ্রকাশিত হয়। তাইওয়ানের শিক্ষার্থীরা চিনা মূল ভূখন্ডে উচ্চ শিক্ষার প্রবেশিকা পরীক্ষায় বিশেষ ছাড় পায়। ধর্মীয় আদানপ্রদানও চলে ঘন ঘন। মাতসু উপাসক এবং বৌদ্ধ সন্নাসীরা একে অপরের প্রতিষ্ঠানগুলি পরিদর্শন করে থাকেন।
চিন-তাইওয়ান নিয়ে বিশ্ব-কূটনীতি
বর্তমানে চিন-তাইওয়ান বর্তমানে বৈশ্বিক কূটনীতির ফোকাসে রয়েছে। ইন্দো-প্রশান্তমহাসাগরীয় অঞ্চলে চিনা আধিপত্য নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি তাইওয়ানের অর্থনীতিও বাকি বিশ্বের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফোন থেকে ল্যাপটপ, ঘড়ি, গেম কনসোল – বিশ্বের বেশিরভাগ দৈনন্দিন ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম চলে তাইওয়ানে তৈরি কম্পিউটার চিপ দিয়ে। তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি বা টিএসএমসি – এই একটি সংস্থাই যে পরিমাণ চিপ তৈরি করে, তা গোটা বিশ্বের বাজারের অর্ধেকেরও বেশি! কাজেই চিন যদি তাইওয়ান দখল করে নেয়, সেই ক্ষেত্রে বেজিং বর্তমান বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিল্পের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠবে। পাশাপাশি, ইন্দো-প্রশান্তমহাসাগরীয় অঞ্চলে মুক্ত ও অবাধ বাণিজ্যের পরিবেশ বজায় রাখার জন্যও, তাইওয়ানের চিনা দখল মুক্ত থাকা আবশ্যক বলে মনে করা হয়। এই কারণেই আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, কানাডার মতো বহু দেশ, তাইওয়ানকে মুক্ত রাখার বিষয়ে চিনের উপর চাপ তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে।
চিন-তাইওয়ান দখল করলে কীভাবে পাল্টে যাবে প্রশান্ত মহাসগারীয় কূটনৈতিক সম্পর্ক?
যদি তাইওয়ান দখল করে নেয় চিন, সেই ক্ষেত্রে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন আধিপত্যের অবসান ঘটবে। বদলে যাবে এই অঞ্চলের ক্ষমতার সমীকরণ। রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট ইতিমধ্যেই আমেরিকার বিশ্বনেতা হিসেবে গোটা বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করার অবস্থানকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তাইওয়ানও মার্কিন নেতৃত্বের পক্ষে আরেকটি চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে। চিনের কাছে তাইওয়ান হারানো মানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক ও নিরাপত্তা স্বার্থ বড়সড় হুমকির মুখে পড়বে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের মতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি তাদের গণতান্ত্রিক মিত্রশক্তিদের পাশে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়, সেই ক্ষেত্রে শুধুমাত্র তাদের কর্তৃত্বই হুমকির মুখে পড়বে না, আমেরিকার বিশ্বাসযোগ্যতা এবং বৈশ্বিক প্রভাবও দারুণভাবে ক্ষুণ্ণ হবে।
শুধু তাই নয়, তাইওয়ান ফিলিপাইন সাগরের প্রবেশদ্বারও বটে। কাজেই, চিন তাইওয়ান দখল করে নেওয়া মানে, জাপান, ফিলিপাইন্স এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলির সুরক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হুমকি তৈরি হওয়া। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের মতে, অতীতে সোভিয়েত রাশিয়া যেমন অন্যান্য দেশগুলিকে তাদের অর্থনীতির চাকা হিসেবে ব্যবহার করত, দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলিও বেজিং-এর অর্থনৈতিক ক্রীতদাসে পরিণত হবে। পাশাপাশি, পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে বেজিং-এর কর্তৃত্ব প্রসারিত হবে।
চিন, তাইওয়ান দখল করলে ভারত কতটা চাপে পড়বে?
তাইওয়ান যদি চিনের দখলে চলে যায়, এশিয়ার বেশিরভাগ অংশেই চিনা আধিপত্য কায়েম হবে। আমেরিকার মতোই হুমকির মুখে পড়বে ভারতের স্বার্থ। তবে, চিনের থেকে আমেরিকা অনেক দূরে। ভারত কিন্তু একেবারে দোরগোড়ায় রয়েছে। চিন-পাকিস্তান অক্ষের তীব্র চাপের মুখে পড়বে নয়া দিল্লি। বস্তুত, অনেকে মনে করেন ভারত মহাসাগরে সামরিক উপস্থিতি বাড়ানোর লক্ষ্যেই তাইওয়ান দখল করতে মরিয়া চিন। একবার তাইওয়ান দখল হয়ে গেলেই ভারত মহাসাগরে চিনের সামরিক উপস্থিতি বাড়বে। যা ভারতের নিরাপত্তা জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে।