TV9 Explain: চিনের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হলে ইউক্রেনের মতো প্রতিরোধ করতে পারবে তাইওয়ান?
China-Taiwan conflict: ৮ মাসর বেশি সময় ধরে রুশ বাহিনীকে ঠেকিয়ে রেখেছে ইউক্রেন। চিন-তাইওয়ান যুদ্ধ বাধলে, তাইওয়ান কি একই রকম প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে?
তাইপেই: ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ থেকে ইউক্রেনে চলছে রুশ সামরিক অভিযান। প্রাথমিকভাবে রুশ বাহিনী বেশ কিছুটা সাফল্য পেলেও, বর্তমানে বেশ বেকায়দায় পড়েছে মস্কো। ইউক্রেনকে যুদ্ধাস্ত্র দিয়ে সহায়তা করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমী শক্তি। ইউক্রেনীয় প্রতিরোধের মুখে পড়ে পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছে রাশিয়া। পূর্ব ইউরোপে এই সংঘাতের মধ্যেই যুদ্ধের দামাম শোনা যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়াতেও। দীর্ঘদিন ধরেই তাইওয়ানকে তাদের দেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে দাবি করে চিন। এতদিন পর্যন্ত, তাইওয়ান দখল করার জন্য কোনও সামরিক পদক্ষেপ না করলেও, গত কয়েক মাসে বদলে গিয়েছে পরিস্থিতি। স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি-সহ একাধিক মার্কিন সরকারের শীর্ষ পদাধিকারীর পা পড়েছে তাইপেই শহরে। আর তারপর থেকেই, তাইওয়ানকে ঘিরে চলছে চিনের ‘শাস্তিমূলক’ সামরিক মহড়া। এই মহড়া যখন তখন সত্যিকারে যুদ্ধে বদলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই অবস্থায় উঠে আসছে একটা বড় প্রশ্ন, ইউক্রেন যেভাবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, তেমনটা কি করে দেখাতে পারবে তাইওয়ান?
সামরিক শক্তিতে কারা এগিয়ে, চিন না তাইওয়ান?
সামরিক শক্তির দিক থেকে চিনের সঙ্গে তাইওয়ানের তুলনাই হয় না। তাইওয়ানের সক্রিয় সেনা সদস্য ও আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যা যথাক্রমে ১,৭০,০০০ ও সাড়ে ১১,৫০০। আর চিনের সক্রিয় সেনা সদস্য ও আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যা যথাক্রমে ২০,০০,০০০ লক্ষ ও ৬,২৪,০০০। তবে, প্রশিক্ষিত ‘রিজার্ভ’ সেনাবাহিনীর দিক থেকে চিনকে পিছনে ফেলেছে তাইওয়ান। চিনের রিজার্ভ বাহিনীর সদস্য যেখানে ৫,১০,০০০, সেখানে তাইওয়ানের রিজার্ভ বাহিনীতে আছে ১৫,০০,০০০ সেনা।
বিমান বাহিনীর শক্তির দিক থেকেও তাইওয়ানকে অনেক পিছনে ফেলেছে চিন। যুদ্ধবিমান, হেলিকপ্টার, হামলাকারী হেলিকপ্টার মিলিয়ে তাইওয়ান বিমান বাহিনীর মোট এয়ারক্র্যাফ্টের সংখ্যা মাত্র ৭৪১। সেখানে চিনা বিমান বাহিনীর হাতে মোট সব মিলিয়ে ৩,২৮৫টি এয়ারক্র্যাফ্ট রয়েছে।
স্থল যুদ্ধের ক্ষেত্রে চিনের ৫,২৫০টি ট্যাঙ্কের জবাবে তাইওয়ানের রয়েছে মাত্র ১,১১০টি ট্যাঙ্ক। তাইওয়ানের কামান রয়েছে ২৫৭টি। চিনের ৪,১২০টি। সাঁজোয়া গাড়ির ক্ষেত্রে চিনের ৩৫,০০০টির বিপরীতে তাইওয়ানের রয়েছে ৩,৪৭২টি।
চিন গত কয়েক বছরে নৌবাহিনীতে বিপুল বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। তাদের বিশাল নৌ বহরে ৭৭৭টি রণতরী, ৭৯টি সাবমেরিন, ১৫২টি টহলদারী জাহাজ এবং ৩৬টি মাইন ওয়ারফেয়ার রয়েছে। অন্যদিকে, তাইওয়ানের নৌবাহিনীর হাতে আছে মাত্র ১১৭টি রণতরী, ৪৩টি টহলদারী জাহাজ, ১৪টি মাইন ওয়ারফেয়ার এবং ৪টি সাবমেরিন।
যুদ্ধ বাধলে চিন এবং তাইওয়ান কোন কোন দেশের সমর্থন পেতে পারে?
এখনও পর্যন্ত, শুধুমাত্র ১৫টি দেশ বা অঞ্চল তাইওয়ানকে পৃথক স্বীকৃতি দেয়। তবে, এগুলি বেশিরভাগই আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান বা দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় ছোট দেশ। অর্থনৈতিক সহায়তার জন্য তারা তাইপেইয়ের উপর নির্ভর করে। তবে, চিনা আগ্রাসন যত বাড়ছে, বিশ্বব্যাপী তাইওয়ানের পক্ষে সমর্থন তত বাড়ছে। আনুষ্ঠানিকভাবে তাইওয়ানকে স্বীকৃতি না দিলেও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই এখন তাইওয়ানের সবচেয়ে বড় ভরসা। চিন হামলা করলে আমেরিকা তার প্রতিরোধ করবে বলে সাফ জানিয়েছে।
এছাড়া, আছে জাপান, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশ, যারা চিন বিরোধিতার স্বার্থেই তাইওয়ানে পাশে দাঁড়াতে পারে। জাপান একাধিকবার বলেছে, তারা অবশ্যই তাইওয়ানকে রক্ষা করবে। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে চিনের বাণিজ্য বিবাদ সুবিদিত। সম্প্রতি চিনের কথা মাথায় রেখে ইংল্যান্ড, তাইওয়ান, ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তারা সামরিক মহড়াও দিয়েছে। জাপান অস্ট্রেলিয়ার মতোই চিনা আগ্রাসন থেকে রক্ষা পেতে দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন্স, ভিয়েতনামের মতো দক্ষিণ এশিয় দেশগুলিও তাইওয়ানের পক্ষ নিতে পারে। এছাড়া, কানাডা এবং যুক্তরাজ্য সহ আরও বেশ কিছু দেশ তাইওয়ান প্রণালীতে সামরিক জাহাজ পাঠিয়েছে। গত কয়েক বছরে চিনা আগ্রাসনের স্বাদ পেয়েছে ভারতও। তবে, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিজ্ঞতা বলছে, চিন-তাইওয়ান যুদ্ধের ক্ষেত্রেও ভারত সরকার নিরপেক্ষ অবস্থানই নিতে পারে।
অন্যদিকে যুদ্ধ হলে চিন সবথেকে বেশি সমর্থন পাবে রাশিয়ার দিক থেকে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পরপরই, তাইওয়ান প্রণালীতে চিনকে উসকানি দিচ্ছে আমেরিকা বলে অভিযোগ করেছিলেন ভ্লাদিমির পুতিন। তিনি খোলাখুলি বেজিং-এর ‘একক চিন’ নীতিকে সমর্থন জানিয়েছেন। মার্কিন হাউস অব রিপ্রেজ়েন্টেটিভস-এর স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরের তীব্র নিন্দাও করেছিল রাশিয়া। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল মায়ানমার এবং উত্তর কোরিয়াও। যুদ্ধ বাধলে এই তিন দেশই চিনের পাশে দাঁড়াবে বলে মনে করা হচ্ছে। এছাড়া, আরও ১০টি দেশ চিন ঘনিষ্ঠ হিসেবে নিজেদের অবস্থান জানিয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে ইরান, পাকিস্তানও।
তাইওয়ানের নাগরিকরা কি চাইছেন চিনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে?
গত বছর পর্যন্ত দেখা গিয়েছিল, তাইওয়ানের মানুষ সম্ভাব্য চিন-তাইওয়ান যুদ্ধ নিয়ে বিশেষ উদ্বিগ্ন নয়। ২০২১ সালের অক্টোবরে তাইওয়ান পাবলিক ওপিনিয়ন ফাউন্ডেশনের করা সমীক্ষায় তাইওয়ানের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ জনগণ জানিয়েছিল, চিনের সঙ্গে সরাসরি সামরিক সংঘাত হবে বলে তারা মনে করেন না। তবে চলতি বছরের সমীক্ষায় ৩৯ শতাংশ জানিয়েছেন, যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। তাইওয়ানের ন্যাশনাল চেংচি ইউনিভার্সিটির পরিচালিত একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষায় প্রায় এক-পঞ্চমাংশ জানিয়েছেন, তাঁরা সম্পূর্ণরূপে যুদ্ধের বিরোধী। তবে, ৩২.২ শতাংশ জানিয়েছেন, যুদ্ধে ৫০,০০০-এর বেশি মৃত্যু হলেও চিনকে প্রতিরোধ করবেন তাঁরা। স্পষ্টতই, চিনের সঙ্গে যুদ্ধের বিষয়ে তাইওয়ানে এখনও ঐক্যমত্য গঠিত হয়নি। তবে ইতিমধ্যেই যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন সেই দেশের জনগণ। অনেকে সামরিক প্রশিক্ষণও নিতে শুরু করেছেন।
রাশিয়ার মতো আগ্রাসী ভূমিকা নেওয়ার ক্ষেত্রে কোথায় প্রতিবন্ধকতা রয়েছে চিনের ?
রাশিয়া যতটা সহজে ইউক্রেনে হামলা চালাতে পেরেছে, চিনের পক্ষে তাইওয়ানে হামলা চালানো ততটা সহজ হবে না। বেশ কিছু ভৌগলিক এবং কৌশলগত সমস্যা রয়েছে। প্রথমত, তাইওয়ান চারদিক থেকে সমুদ্র-বেষ্টিত এবং চিনের মূল ভূখন্ড থেকে প্রায় ১৬১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। অর্থাৎ, তাইওয়ানে হামলা করতে গেলে জল ও স্থল দুই ক্ষেত্র মিলিয়ে উভচর আক্রমণ চালাতে হবে চিনকে। ইউক্রেনে রুশ বাহিনী সহজেই সীমান্ত অতিক্রম করে হামলা চালানোর সুযোগ পেয়েছে। এই ধরনের উভচর আক্রমণ অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং এর গতি-প্রকৃতি আগে থেকে বোঝা কঠিন। ২০১৯ সালে পেন্টাগনের রিপোর্টে জানানো হয়েছিল, তাইওয়ানের উপর সরাসরি আক্রমণের জন্য যে বৃহৎ উভচর হামলাকারী জাহাজের প্রয়োজন, চিনের হাতে তা নেই।
এর পাশাপাশি তাইওয়ানে হামলা চালালে, চিনকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুখোমুখি যুদ্ধে নামতে হবে। ইউক্রেনকে রক্ষা করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনও দায় নেই। কিন্তু, তাইওয়ানের সঙ্গে আমেরিকা ১৯৫৪ সালে প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই তাইওয়ানের প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয়, তাইওয়ানে হামলা চালালে, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া এবং ফ্রান্সের মতো আমেরিকার সহযোগী দেশগুলিরও মোকাবিলা করতে হবে বেজিংকে। তাইওয়ানে চিনা আগ্রাসন ঠেকানোর জন্য, জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যেই একটি বিস্তৃত পরিকল্পনা তৈরি করেছে।
চিন-তাইওয়ানের সঙ্গে যুদ্ধ বাধলে ভারতের অবস্থান কী হতে পারে?
চিন-তাইওয়ান যুদ্ধে ভারতের প্রতিক্রিয়া নির্ভর করবে মার্কিন প্রতিক্রিয়ার শক্তি এবং চিনা আগ্রাসনের মাত্রা উপর। ইতিমধ্য়েই ভারত অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চিনা নির্ভরতা কাটানোর চেষ্টা করছে। তাইওয়ানের যুদ্ধ পরিস্থিতি যত খারাপ হবে, ভারতের পক্ষে আরও বেশি বিদেশি বিনিয়োগ টানার সুযোগ আসবে। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের ক্ষেত্রে সম্ভবত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেই অনুসরণ করবে নয়া দিল্লি। তবে, ফার্মাসিউটিক্যালস, পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি, অটোমোবাইলের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে চিন নির্ভরতা না কাটিয়ে ওঠা পর্যন্ত বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা কিন্তু ভারতের প্রতিকূল হতে পারে। কূটনৈতিকভাবে, ভারত সম্ভবত একট কৌশলগত অবস্থান নেবে। একদিকে, চিনা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রসঙ্ঘ এবং অন্যান্য বহুদেশীয় ফোরামে চিনের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারে। অন্যদিকে, সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন বা ব্রিকসের মতো গোষ্ঠীতে চিনের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে থেকে যাবে। তবে, ভারতের সামরিক ক্ষেত্রে সবচেয়ে সীমিত পদক্ষেপ করবে ভারত, এমনটাই মনে করা হচ্ছে । সরাসরি যুদ্ধে অংশ না নিলেও, ভারত মহাসাগরে ক্রমবর্ধমান চিনা উপস্থিতির মোকাবিলায় নৌশক্তির অধিকাংশ মোতায়েন করতে পারে। তবে, তারা শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ভারত মহাসাগর থেকে সামরিক সম্পদ স্থানান্তর করতে সহায়তা করবে বলে মনে করা হচ্ছে।