In Depth: ‘আমার সোনার বাংলা…’, কীভাবে হল বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত? ভারতের চাপে?

Bangladesh national anthem: বিভিন্ন সময়ে জাতীয় সঙ্গীতের বিরোধিতা দেখা গিয়েছে পদ্মাপারে। কখনও বলা হয়েছে, এই গানে বাংলার কথা বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নয়। কখনও বলা হয়েছে, এই গান ইসলামি মূল্যবোধ ও চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কিন্তু, সত্যিই কি বাংলাদেশের বর্তমান জাতীয় সঙ্গীত ভারতের চাপিয়ে দেওয়া? কীভাবে 'আমার সোনার বাংলা' জাতীয় সঙ্গীত হয়ে উঠল বাংলাদেশের?

In Depth: 'আমার সোনার বাংলা...', কীভাবে হল বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত? ভারতের চাপে?
এই গান শুনলেই কেঁদে ফেলতেন বঙ্গবন্ধু, বিতর্কে 'আমার সোনার বাংলা...'Image Credit source: TV9 Bangla
Follow Us:
| Updated on: Sep 18, 2024 | 5:43 PM

“১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গ-রদ করার জন্য রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। এই জাতীয় সঙ্গীত দুই বাংলা এক করার জন্য জাতীয় সঙ্গীত। আমরা কি দুই বাংলা এক হতে চাচ্ছি? আমরা কি স্বাধীন বাংলাদেশ রাখতে চাই, নাকি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অঙ্গীভূত রাজ্য হতে চাই? আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ চেয়েছি, স্বাধীন বাংলাদেশ থাকতে চাই। এই জাতীয় সঙ্গীত আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের পরিপন্থি। আমি জোর দাবি জানাচ্ছি, আমাদের নতুন জাতীয় সঙ্গীত তৈরি করা হোক।” সম্প্রতি, এক সাংবাদিক সম্মেলনে নির্দ্বিধায় এই কথা বলেছেন বাংলাদেশ সেনার প্রাক্তন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আজমি। তাঁর আরও এক পরিচয়, তিনি বাংলাদেশের জামাতে ইসলামি দলের প্রাক্তন আমির তথা একাত্তরে গণহত্যার দায়ে সাজাপ্রাপ্ত গোলাম আজমের ছেলে। এখানেই থামেননি জেনারেল আজমি। তাঁর আরও দাবি, ১৯৭১ সালে ভারতের চাপে নাকি বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার এই সঙ্গীতকে গ্রহণ করেছিল।

তবে শুধু তিনি একাই নন, শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের একটা বড় অংশই মনে করছে, তাদের জাতীয় সঙ্গীত বদলের প্রয়োজন। কারণ ‘আমার সোনার বাংলা’ নাকি ভারতের চাপিয়ে দেওয়া। বাংলাদেশের মধ্য থেকেই এই পরিকল্পনার প্রতিবাদ হয়েছে। চাপের মুখে বাংলাদেশ সরকার জানিয়েছে, জাতীয় সঙ্গীত বদলানো হবে না। তবে, মহম্মদ ইউনুসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে ইসলামি মৌলবাদীদের প্রভাব যেভাবে বাড়ছে, তাতে তিনি এই কথা কতটা রাখতে পারবেন, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। আর বাংলাদেশে রবি ঠাকুরের লেখা জাতীয় সঙ্গীত বদলানোর দাবি এই প্রথম নয়, ২০০২ সালেও একবার একই চেষ্টা করেছিল জামাতে ইসলামি। তারপর থেকে বিভিন্ন সময়ে জাতীয় সঙ্গীতের বিরোধিতা দেখা গিয়েছে পদ্মাপারে। কখনও বলা হয়েছে, এই গানে বাংলার কথা বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নয়। কখনও বলা হয়েছে, এই গান ইসলামি মূল্যবোধ ও চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কিন্তু, সত্যিই কি বাংলাদেশের বর্তমান জাতীয় সঙ্গীত ভারতের চাপিয়ে দেওয়া? কীভাবে ‘আমার সোনার বাংলা’ জাতীয় সঙ্গীত হয়ে উঠল বাংলাদেশের?

আমার সোনার বাংলা – গানের ইতিহাস

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আজমি ঠিকই বলেছেন। আমার সোনার বাংলা গানটি রচিত হয়েছিলো ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে। গানটির পাণ্ডুলিপি নেই। তাই এর সঠিক রচনাকাল জানা যায় না। কবি সত্যেন রায়ের লেখায় রয়েছে, ১৯০৫-এর ৭ অগস্ট কলকাতার টাউন হলে আয়োজিত এক প্রতিবাদ সভায় প্রথমবার এই গানটি গাওয়া হয়েছিল। রবীন্দ্রজীবনীকার প্রশান্তকুমার পালের অবশ্য দাবি, ২৫ অগস্ট কলকাতার টাউন হলে প্রথম গাওয়া হয়েছিল গানটি। ওই বছরেরই ৭ সেপ্টেম্বর ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকায় গানটি ছাপা হয়েছিল। ওই বছরের বঙ্গদর্শন পত্রিকার আশ্বিন সংখ্যাতেও গানটি ছাপা হয়েছিল। গানটির সুর দেওয়া হয়েছিল ডাকপিয়ন গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাব তারে’ গানের সুরে।

মুক্তি যুদ্ধের আগে বাংলাদেশে ‘আমার সোনার…’

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ ঠেকানো গেলেও, ১৯৪৭ সালে তা আটকানো যায়নি। পূর্ববঙ্গ যুক্ত হয়েছিল পাকিস্তানে, নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান। ইসলামি মৌলবাদীদের মূল সমস্যা তো এই গানটি নয়, বরং ধর্মনিরপেক্ষ, মুক্তমনা, আধুনিক চেতনার কবি রবীন্দ্রনাথ। আজ নয়, সেই পূর্ব পাকিস্তানের সময় থেকেই। পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্রচর্চা কার্যত নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু, সেই সময়ও বাঙালির মুখে প্রতিবাদের ভাষা জুগিয়েছিল রবি ঠাকুরের এই গানটিই। ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে নিহতদের স্মরণে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদ। সেই অনুষ্ঠানেও ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি গাওয়া হয়েছিল। এই গান গাওয়ার জন্য ছাত্রদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নিয়েছিল কলেজ কর্তৃপক্ষ। তারপরও ১৯৫৩-১৯৫৪ সালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের অভিষেক অনুষ্ঠানে এই গান গাওয়া হয়েছিল।

১৯৫৬ সালে ঢাকায় পকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশন বসেছিল। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা সংসদ সদস্যদের সম্মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে এক অনুষ্ঠান হয়েছিল। সেখানে পশ্চিম পাকিস্তানের গণপরিষদ সদস্যদের সামনে বাঙালি সংস্কৃতি তুলে ধরতে চেয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, কাজি নজরুল ইসলামের গানের পাশাপাশি বাংলা লোকগান গাওয়া হয়েছিল সেই অনুষ্ঠানে। সেই অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র সঙ্গীতশিল্পী সনজীদা খাতুনকে ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইতে বলেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। পরের এক সাক্ষাৎকারে সনজীদা জানিয়েছিলেন, এই গান বাঙালি জাতিকে কতটা আবেগ তাড়িত করে, তা পাকিস্তানিদের বোঝাতেই তিনি ওইদিন গানটি গাইতে বলেছিলেন।

১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি করেছিলেন পাক রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান। অসাম্প্রদায়িকতা, রবীন্দ্র সাহিত্য ও শিল্পকলা এবং বাঙালি সংস্কৃতির চর্চাকে রাষ্ট্রীয় চেতনার পরিপন্থী হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন তিনি। ১৯৬৭ সালে রাষ্ট্রীয় রেডিয়োয় রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করা হয়। প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিল বাংলাদেশ বা তখনকার পূর্ব পাকিস্তান। প্রতিবাদের চাপে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছিল। ১৯৬৯ সালে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের আয়োজিত এক জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, “আমরা রবীন্দ্রনাথের বই পড়িবই, আমরা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাহিবই।” ক্রমে মুক্তিযুদ্ধের আগে, শাসকদের বিরুদ্ধে যেকোনও আন্দোলন ও প্রতিবাদে আমার সোনার বাংলা গানটি ব্যবহার করা শুরু করেছিল পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ।

মুক্তিযুদ্ধে ‘আমার সোনার বাংলা…’

একাত্তরে পাক হানাদারদের বর্বরতার বিরুদ্ধে বাঙালি জাতিকে জাগ্রত করতে এবং স্বাধীনতার যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করতে রবীন্দ্রনাথের গান হয়ে ওঠে পাথেয় ও প্রেরণা। ১৯৭০ সালের গোড়ায় জাহিদুর রহিমকে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের রের্কড প্রকাশের দায়িত্ব দিয়েছিলেন শেখ মুজিব। অসহযোগ আন্দোলনের সময় দিকে-দিকে বেজেছিল এই গান। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে রেডিয়ো-টিভিতে সোনার বাংলা গানের রের্কড বেজেছিল। ধীরে ধীরে মুক্তিযুদ্ধের সময় দিকে দিকে স্বাধীনতাকামী মানুষ গাইতে শুরু করেছিলেন ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি। ১৯৭১-এর ৩ জানুয়ারি, ঢাকার পল্টন ময়দানে ছাত্রলিগ ও শ্রমিক লিগ আয়োজিত এক জনসভার শেষে দুটি গান গাওয়া হয়েছিল। একটি ছিল ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ এবং অন্যটি ‘আমার সোনার বাংলা’। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি জাতীয় সংগীত হিসেবে গাওয়া হয়েছিল। তবে তখনও এই গন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে পাকা হয়নি। এর পিছনে রয়েছে এক আকর্ষণীয় কাহিনি।

বঙ্গবন্ধুর চোখে জল

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বিমানে লন্ডন থেকে বাংলাদেশে ফিরেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই যাত্রায় বঙ্গবন্ধুর সফর সঙ্গী হয়েছিলেন ভারতীয় কুটনীতিক শশাঙ্কশেখর বন্দ্যোপাধ্যায়। পরে, ‘বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় সঙ্গীত’ নাম একটি বই লিখেছিলেন শশাঙ্কশেখর। সেই বইয়ে তিনি লিখেছেন, “১৯৭২ সালের ৯ জানুয়ারি লন্ডন হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে ছেড়ে মধ্যপ্রাচ্য থেকে জ্বালানি নিয়ে বিমানটি উড়ছে। বঙ্গবন্ধু জানালা দিয়ে শ্বেতশুভ্র মেঘের দিকে অপলক তাকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পর গাইতে লাগলেন, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’ তাঁর চোখে জল। তিনি বললেন ব্যানার্জি, আপনিও ধরুন। রিহার্সেল দিয়ে নেই। এরপর আমাকে অবাক করে দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলে উঠলেন, এ গানটি হবে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। কেমন হবে বলেন তো?”শশাঙ্ক উত্তর দিয়েছিলেন, “ইতিহাসে তাহলে প্রথমবারের মতো দুটি দেশের জাতীয় সঙ্গীতের লেখক হবেন একই ব্যক্তি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।” জীবনের ভেলায় ভেলায়’ বইয়ে সনজীদা খাতুনও লিখেছেন, “বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি এ গানটি যখন শুনতেন তখন কেঁদে ফেলতেন।”

জাতীয় সঙ্গীত ও জাতীয় গীত

১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফেরার পর মন্ত্রিসভার প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়। সেই বৈঠকেই মুক্তযুদ্ধে গানটির ভূমিকা বিবেচনা করে, ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের প্রথম দশটি পঙক্তি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে নির্বাচিত হয়। আর দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখা ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা’ গানটিকে জাতীয় গীত হিসেবে গ্রহণ করে বাংলাদেশ। সেই বৈঠকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “যে সুর গেয়ে এদেশ স্বাধীন হয়েছে, সে সুরেই আমাদের জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হবে। সেটিই জাতীয় সঙ্গীতের সুর।”

সোনার বাংলার বিরোধিতা

বাংলাদেশে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা’কে বাতিল করার আনুষ্ঠানিক দাবি প্রথম তুলেছিলেন জামাতে ইসলামীর প্রাক্তন আমীর মতিউর রহমান নিজামি। ২০০২ সালে বিএনপি-জামাত সরকারে তিনি ছিলেন শিল্পমন্ত্রী। তাঁর সঙ্গে গলা মিলিয়েছিলেন সেই সময়ের সমাজকল্যাণমন্ত্রী তথা আরেক জামাত নেতা, আলি আহসান মুজাহিদ। তাঁদের দাবি ছিল, ইসলামি মূল্যবোধ ও চেতনার আলোয় জাতীয় সঙ্গীত সংশোধন করতে হবে। তৎকালীন প্রধামন্ত্রী খালেদা জিয়ার কাছে তাঁরা এক যৌথ সুপারিশপত্রও জমা দিয়েছিলেন। তবে পরে খালেদা জিয়ার মন্ত্রীসভা সেই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছিল। ২০১৯ সালে, সারেগামাপা খ্যাত বাংলাদেশি গায়ক মইনুল আহসান নোবেল আবার বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ বাংলাদেশ যতটা না প্রকাশ পায়, তার থেকে কয়েক হাজার গুণ বেশি প্রকাশ হয়েছে প্রিন্স মাহমুদের লেখা ‘বাংলাদেশ’ গানে। তাঁর এই মন্তব্য নিয়ে দুই বাংলাতেই বিতর্ক হয়েছিল। পরে এই মন্তব্যের জন্য ক্ষমাও চান নোবেল। এবার আবার উঠেছে জাতীয় সঙ্গীত বদলের ডাক। কিন্তু, একটা গোটা জাতির মননে গেঁথে থাকা এই গান কি চাইলেই উপরে ফেলা যাবে?