EXPLAINED: শুধুই কি কথার কথা? কানাডাকে কেন আমেরিকায় যুক্ত করতে চান ট্রাম্প?
EXPLAINED: কানাডা উত্তর আমেরিকার একটি দেশ। দশটি প্রদেশ ও তিনটি টেরিটোরি নিয়ে গঠিত। আটলান্টিক মহাসাগর থেকে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত কানাডার সীমা। উত্তর দিকে রয়েছে আর্কটিক মহাসাগর। আয়তনের দিক থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। আমেরিকার সঙ্গে বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা আন্তর্জাতিক ভূমি সীমান্ত রয়েছে কানাডার। এই পরিস্থিতিতে কেন ডোনাল্ড ট্রাম্প কানাডাকে আমেরিকার অন্তর্ভুক্ত করতে চাইছেন? পড়ুন টিভি৯ বাংলার বিশেষ প্রতিবেদন...
ওয়াশিংটন: আর দিন দশেকও বাকি নেই। দ্বিতীয়বার আমেরিকার মসনদে বসতে চলেছেন তিনি। তার আগেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি মন্তব্য নিয়ে শোরগোল শুরু হয়েছে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয়বার শপথ নেওয়ার আগেই ট্রাম্প বলেছেন, প্রতিবেশী দেশ কানাডাকে আমেরিকার ৫১তম স্টেট করতে চান তিনি। তাঁর এই মন্তব্যকে কানাডা প্রথমে তামাসা বলে উড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু, তিনি যে মোটেই তামাসা করছেন না, সেকথা একাধিক বার্তায় বুঝিয়ে দিয়েছেন ট্রাম্প। হঠাৎ কেন প্রতিবেশী দেশকে আমেরিকার অন্তর্গত করতে চাইছেন ট্রাম্প? কী কারণ থাকতে পারে এর পিছনে? কূটনীতিকরা বলছেন, কানাডার বেশিরভাগ মানুষ ট্রাম্পের দল রিপাবলিকানকে সমর্থন করে না। তারপরও তাঁর এই মন্তব্যের কারণ কী?
নিজের মন্তব্যে অনড় ট্রাম্প-
একবার নয়। একাধিকবার কানাডাকে আমেরিকার ৫১তম স্টেট করার কথা জানিয়েছেন ট্রাম্প। এমনকি, আমেরিকার কোনও স্টেটের প্রধানকে যেভাবে গভর্নর বলা হয়, তেমনই কানাডার প্রধানমন্ত্রী ডাস্টিন ট্রুডোকেও কানাডার গভর্নর বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। একইসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, কানাডাকে সুরক্ষিত করতেই তাঁর এই পদক্ষেপ। বলছেন, “আসলে আমরা কানাডাকে সুরক্ষিত রাখতে চাইছি।”
এই খবরটিও পড়ুন
কানাডাকে আমেরিকার অন্তর্ভুক্ত করতে তিনি কতটা সিরিয়াস, তা সোশ্যাল মিডিয়া বার্তায়ও বুঝিয়ে দিয়েছেন ট্রাম্প। নিজের সমাজমাধ্যমে কৃত্রিম মেধা ব্যবহার করে একটি ছবি পোস্ট করেন। সেখানে দেখা যায়, কানাডার দিকে তাকিয়ে একটি টিলার উপর দাঁড়িয়ে রয়েছেন ট্রাম্প। পাশে উড়ছে কানাডার পতাকা। ছবিটির নিচে ‘ও কানাডা’ লেখা। কানাডার জাতীয় সঙ্গীয় শুরু হয় ‘ও কানাডা’ দিয়ে। ফলে ট্রাম্প কী বোঝাতে চাইছেন, তা স্পষ্ট।
কানাডার ভৌগোলিক অবস্থান-
ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই মন্তব্যের কারণ খতিয়ে দেখার আগে কানাডার ভৌগোলিক অবস্থান দেখে নেওয়া যাক। কানাডা উত্তর আমেরিকার একটি দেশ। দশটি প্রদেশ ও তিনটি টেরিটোরি রয়েছে। আটলান্টিক মহাসাগর থেকে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত কানাডার সীমা। উত্তর দিকে রয়েছে আর্কটিক মহাসাগর। আয়তনের দিক থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। আর বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা উপকূলরেখা রয়েছে কানাডায়। আমেরিকার সঙ্গে বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা আন্তর্জাতিক ভূমি সীমান্ত রয়েছে কানাডার। ৮ হাজার ৮৯১ কিমি। আয়তনের দিক থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ হলেও জনসংখ্যা খুব বেশি নয় কানাডায়। সেখানে জনসংখ্যা ৪ কোটির সামান্য বেশি।
ফ্রান্সরা দীর্ঘদিন এই দেশে রাজত্ব করেছে। তারপর এসেছে ইংরেজরা। ১৮১২ সালে উত্তর আমেরিকার দখল নিয়ে আমেরিকা ও তার সঙ্গীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছিল ব্রিটেন ও তার সঙ্গীরা। তারও অন্যতম কেন্দ্র ছিল কানাডা।
১৮৬৭ সালে তিনটি ব্রিটিশ উপনিবেশকে একত্রিত করে কানাডা গঠিত হয়। তবে কানাডার কূটনীতি ও প্রতিরক্ষা নীতির নিয়ন্ত্রণ ছিল ব্রিটিশের হাতে। ১৯২৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কানাডাকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। জানায়, কানাডা তার বিদেশনীতি নিজেই ঠিক করবে। ১৯৮২ সালের মার্চে কানাডা আইন অনুমোদন করে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট। কানাডা সম্পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করে।
আমেরিকা-কানাডা সম্পর্ক-
আমেরিকা ও কানাডার স্থল সীমান্ত বিশ্বের যেকোনও দুটি দেশের মধ্যে সবচেয়ে বড়। দুটি দেশের মধ্যে স্থল সীমান্ত ৮ হাজার ৮৯১ কিমি। দুটি দেশের নাগরিকই পরস্পরের দেশকে পছন্দের তালিকায় উপরে রাখে। প্রতিদিন প্রায় ৪ লক্ষ মানুষের দুই দেশের সীমান্ত পার হয়। আর প্রতিদিন ২.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য ও পরিষেবা সীমান্ত পার করে।
আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে কানাডায় পা রেখেছিলেন ওয়ারেন হার্ডিং। ১৯২১ সালে। তখনও অবশ্য ব্রিটিশদের প্রভাব ছিল কানাডায়।
১৯৩৮ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন তীব্র হচ্ছে, তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট এক জনসভায় বলেছিলেন, তৃতীয় কোনও শক্তি যদি কানাডায় আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে, তবে অলসের মতো বসে থাকবে না আমেরিকা। কূটনীতিকরা বলছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি যাতে কানাডায় আক্রমণ না করে, সেই হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন রুজভেল্ট।
কানাডার বর্তমান পরিস্থিতি-
প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়ার ঘোষণা করেছেন জাস্টিন ট্রুডো। লিবারেল পার্টির নেতৃত্ব থেকেও সরে দাঁড়াচ্ছেন। ট্রুডো জানিয়েছেন, দলের নতুন প্রধান নির্বাচিত হওয়ার আগে পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাবেন। আগামী ৯ মার্চ লিবারেল পার্টি নতুন নেতা নির্বাচন করবে জানা গিয়েছে।
এদিকে, মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্বের সঙ্গে লড়তে হচ্ছে কানাডাকে। তবে কানাডা কখনই আমেরিকার অংশ হবে না বলে ট্রাম্পকে পাল্টা জবাব দিয়েছেন ট্রুডো। তিনি বলেন, “তা কখনই হবে না। কানাডিয়ানরা কানাডিয়ান হিসেবে গর্বিত। আমাদের সহজ পরিচয়, আমরা আমেরিকান নই।” নরকেও কানাডা আমেরিকার অন্তর্ভুক্ত হবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
কানাডাকে কীভাবে আমেরিকার অন্তর্ভুক্ত করতে চান ট্রাম্প?
কানাডাকে শক্তি প্রয়োগ করে আমেরিকার অন্তর্ভুক্ত করতে চান না ট্রাম্প। এর জন্য অর্থনৈতিক সাহায্যকে হাতিয়ার করতে চান। কানাডার মানুষকে তিনি ভালবাসেন জানিয়ে ট্রাম্প বলেন, “আমি কানাডার মানুষকে ভালবাসি। তাঁরা খুবই ভাল। কিন্তু, আমরা প্রতি বছর তাঁদের নিরাপত্তার জন্য কয়েকশো বিলিয়ন ডলার খরচ করি। কেন আমরা প্রতি বছর ২০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করব কানাডাকে রক্ষা করতে? আমরা যদি তাদের ভর্তুকি না দিই, তবে কী হবে? আমাদের নিজেদের ৩৬ ট্রিলিয়ন ডলার ঋণ রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে তাদের সাহায্য না করার পুরো অধিকার আমাদের রয়েছে।”
জাস্টিন ট্রুডোকে কানাডার গভর্নর বলে সম্বোধন করে ট্রাম্প বলেন, “আমি গভর্নর ট্রুডোকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আমরা কেন কানাডাকে সাহায্য করছি? তাঁর জবাব ছিল, আমি সত্যিই জানি না। তিনি উত্তর দিতে পারেননি। কিন্তু, আমার কাছে উত্তর আছে। আমরা অভ্যাসের বশে এটা করছি। আমরা আমাদের প্রতিবেশীকে ভালবাসি। আমরা ভাল প্রতিবেশী। কিন্তু, এটা আমরা চিরকাল করে যেতে পারি না। এটা সত্যিই খুব বেশি অর্থ। কানাডা যদি আমেরিকার একটি স্টেট হয়, তাহলে এটা মানা যায়। কিন্তু, তারা আলাদা একটি দেশ।” কানাডা থেকে আমেরিকায় আসা সমস্ত পণ্যের উপর ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপানোর হুঁশিয়ারিও দেন ট্রাম্প।
কানাডা আমেরিকার অন্তর্ভুক্ত হলে কী লাভ হতে পারে ওয়াশিংটনের?
কানাডা থেকে প্রতি বছর কয়েকশো বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করে আমেরিকা। ২০২৩ সালের হিসেব বলছে, ওই বছর আমেরিকা কানাডা থেকে ৪১৪ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি করেছিল। কানাডা থেকে আমেরিকা সবচেয়ে বেশি আমদানি করে খনিজ জ্বালানি। ২০২৩ সালে ১২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের খনিজ জ্বালানি আমদানি করেছিল। এর পাশাপাশি যন্ত্রপাতি ও পরিবহণ সরঞ্জামও কেনে আমেরিকা। ২০২৩ সালে কানাডাকে ১০৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দিয়েছিল যন্ত্রপাতি ও পরিবহণ সরঞ্জাম কেনার জন্য। ২০২৩ সালে কানাডা থেকে ৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের শিল্পজাত পণ্য কিনেছিল আমেরিকা।
কূটনীতিকরা বলছেন, কানাডা আমেরিকার অংশ হলে, এসব আর কিনতে হবে না ওয়াশিংটনকে। তখন তাদের অর্থনীতি আরও গতি পাবে। শুধু তাই নয়, কাজাখস্তানের পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ইউরেনিয়াম উৎপাদনকারী দেশ কানাডা। পরমাণু হাতিয়ার তৈরিতে ব্য়বহৃত হয় অতি তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়াম। ফলে কানাডাকে আমেরিকার অন্তর্ভুক্ত করতে পারলে সামরিক শক্তিও বৃদ্ধি পাবে ওয়াশিংটনের।