Keir Starmer: ম্লান ঋষির ‘হিন্দুত্ব’, ব্রিটিশ-ভারতীয়দের মন জিতে নিলেন এই ‘গরিবের ছেলে’

United Kingdom Polls 2024: ভারতীয়রা ব্রিটেনের সবথেকে বড় উদ্বাস্তু সম্প্রদায়। সেখানকার রাজনীতিতে ক্রমে প্রভাব বাড়ছে ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের। এই পরিস্থিতিতে, ব্রিটিশ-ভারতীয় সম্প্রদায়ের ভোট ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঋষি সুনকেরই পাওয়ার কথা ছিল। ব্রিটেনে হিন্দুত্বের পোস্টার বয়। কিন্তু, কার্যক্ষেত্রে তা হয়নি। কে এই কিয়ার স্টারমার?

Keir Starmer: ম্লান ঋষির 'হিন্দুত্ব', ব্রিটিশ-ভারতীয়দের মন জিতে নিলেন এই 'গরিবের ছেলে'
বাপস স্বামীনারায়ণ মন্দিরে গিয়েছিলেন সুনক ও স্টারমার দুজনেইImage Credit source: AFP
Follow Us:
| Updated on: Jul 05, 2024 | 12:07 PM

লন্ডন: নির্বাচনী প্রচার পর্বের একেবারে শেষ দিন, লন্ডনের বাপস স্বামীনারায়ণ মন্দিরে গিয়েছিলেন বিদায়ী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনক এবং তাঁর স্ত্রী অক্ষতা মূর্তি। সেখান থেকেই ব্রিটিশ-ভারতীয় সম্প্রদায়ের ভোট চেয়েছিলেন তিনি। একেবারে শুরু থেকেই কখনও নিজের হিন্দু পরিচয় গোপন করার তো চেষ্টা করেননি তিনি। বরং, মন্দিরে-মন্দিরে ঘুরে, নিজের হিন্দু পরিচয়ের একপ্রকার বিজ্ঞাপন দিয়ে এসেছেন ঋষি। তাঁকে বলা হল ব্রিটেনে হিন্দুত্বের পোস্টার বয়। এবারের নির্বাচনে তাঁকেই সিংহাসনচ্যুত করে ক্ষমতায় আসছেন লেবার পার্টির নেতা কিয়ার স্টারমার। ভোটে বিপুল জয় পেতে চলেছে লেবার পার্টি। ভারতীয়রা ব্রিটেনের সবথেকে বড় উদ্বাস্তু সম্প্রদায়। সেখানকার রাজনীতিতে ক্রমে প্রভাব বাড়ছে ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের। এই পরিস্থিতিতে, ব্রিটিশ-ভারতীয় সম্প্রদায়ের ভোট ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঋষি সুনকেরই পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু, কার্যক্ষেত্রে তা হয়নি। কে এই কিয়ার স্টারমার? কীভাবে ‘ব্রিটেনে হিন্দুত্বের পোস্টার বয়’কে পিছনে ফেললেন তিনি?

দুই সন্তানের বাবা, কিয়ার স্টারমারের বয়স এখন ৬১ বছর। পেশায় তিনি একজন আইনজীবী। ২০০৮ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে তিনি ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের প্রধান প্রসিকিউটরের পদে ছিলেন। তবে, তিনি এসেছেন একেবারে সাধারণ ঘর থেকে। সোনার চামচ মুখে নিয়ে না জন্মালেও, ঋষি সুনক ছিলেন এক বড় ব্যাঙ্কার। বিয়ে করেছেন এক ধনকুবেরের মেয়েকে। সেখানে স্টারমারের বাবা ছিলেন একজন সাধারণ কারিগর। আর তাঁর মা ছিলেন নার্স। লেবার পার্টির প্রথম নেতা কেয়ার হার্ডির নামানুসারেই তাঁর নামকরণ করেছিলেন তাঁর বাবা-মা। লন্ডনের বাইরে এক ছোট শহরে বড় হয়েছেন তিনি। ছোটবেলাটা বেশ অভাবেই কেটেছিল তাঁর। প্রচার পর্বে সেই অতীতকে বারংবার তুলে ধরেছিলেন স্টারমার। প্রথম বক্তৃতাতেই তিনি বলেছিলেন, “বেশ কঠিন সময় ছিল। আমি জানি মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে কী অবস্থা হয়। জীবনযাত্রার ব্যয় ক্রমে বাড়তে থাকে। পোস্টম্যান এলেই ভয় করে, আরও কোনও বিল এল নাকি?”

তার পরিবার থেকে স্টারমারই প্রথম কলেজে গিয়েছিলেন। তিনি ভাল বেহালাও বাজান। ফুটবল ভালোবাসেন তিনি, আর্সেনাল দলের ভক্ত। বয়স ৫০ পেরোনোর পর, তিনি রাজনীতির জগতে এসেছিলেন। ২০১৫ সালে তিনি প্রথমবার সাংসদ হয়েছিলেন। দলের মধ্যে প্রথম থেকেই তিনি দলের নেতা জেরেমি করবিনের বিরোধী ছিলেন। একবার দলও ছাড়তে উদ্যত হয়েছিলেন। তবে, ২০১৭ এবং ২০১৯-এ করবিনের নেতৃত্বে লেবার পার্টির ভরাডুবির পর, লেবার পার্টি তাদের শীর্ষনেতা হিসেবে বেছে নিয়েছিল স্টারমারকে। করবিনের কট্টর সমাজতান্তিক পথ থেকে তিনি লেবার পার্টিকে মধ্য-বামপন্থার দিকে টেনে আনেন। কনজারভেটিভ পার্টির অন্দরে যখন নেতৃত্ব নিয়ে টালমাাল অবস্থা চলছে, সেই সময় অভ্যন্তরীণ লড়াইয়ের জন্য পরিচিত লেবার পার্টিতে শৃঙ্খলা এনেছিলেন তিনি।

করবিনের কট্টর সমাজতান্ত্রিক নীতিগুলিকে বাদ দিয়েছিলেন তিনি। ইহুদি-বিদ্বেষের জন্য ক্ষমা চেয়েছিলেন। মন্ত্র দিয়েছিলেন, “দলের আগে দেশ”। ব্রেক্সিটের বিরোধিতা করেও জানিয়েছিলেন, লেবার পার্টি ক্ষমতায় আসলে ব্রেক্সিটের সিদ্ধান্ত উল্টানো হবে না। লেবার পার্টির সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। একই সঙ্গে তিনি চিহ্নিত করেছিলেন, ব্রিটেনের রাজনীতিতে প্রায় নির্ণায়ক শক্তি হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে লেবার পার্টি থেকে অনেকটাই দূরে সরে গিয়েছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা। এর জন্য মূলত দায়ী ছিল জেরেমি করবিনের বেশ কিছু সিদ্ধান্ত। কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত-বিরোধী অবস্থান নিয়েছিলেন করবিন। সমর্থন করেছিলেন পাকিস্তানকে।

২০১৯-এ ভারতের ৩৭০ ধারা বাতিলের পর, কাশ্মীরের উপর একটি জরুরি প্রস্তাব পাশ করেছিল লেবার পার্টি। করবিন বলেছিলেন, কাশ্মীরে বড় মানবিক সংকট চলছে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের ওই অঞ্চলে যাওয়া উচিত। কাশ্মীরের অসামরিক নাগরিকদের গায়েব করে দেওয়া হচ্ছে। মূলধারার রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক কর্মীদের গৃহবন্দী বা জেলবন্দি করা হচ্ছে। কাশ্মীরের জনগণকে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দেওয়া উচিত বলে দাবি করেছিলেন তিনি। ব্রিটিশ-ভারতীয়দের মধ্যে এর বিশাল প্রতিক্রিয়ার তৈরি হয়েছিল। চাপে পড়ে করবিন বলেছিলেন, কাশ্মীর, ভারত ও পাকিস্তানের “দ্বিপাক্ষিক বিষয়”। তবে, তাতেও কাজ হয়নি। ২০১৯-এ বড় পরাজয় হয়েছিল লেবারদের।

করবিনের ভুল পদক্ষেপগুলিও স্বীকার করে নিয়েছিলেন স্টারমার। এবারের নির্বাচনে ভারতীয় বংশোদ্ভূত অনেককে প্রার্থীও করেছে লেবার পার্টি। সেই সঙ্গে স্টারমার ঘোষণা করেছিলেন, ভারত এবং ব্রিটিশ-ভারতীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখতে চায় লেবার পার্টি। হিন্দু বিদ্বেষের বিরুদ্ধেও কড়া অবস্থান নিয়েছেন তিনি। গত শুক্রবার, স্বামীনারায়ণ মন্দিরে গিয়েছিলেন স্টারমারও। সেই সময় তিনি বলেছিলেন, “ব্রিটেনে হিন্দু-বিদ্বেষের কোনও জায়গা নেই। ভারতের সঙ্গে এক নতুন কৌশলগত অংশীদারিত্ব গড়ে তুলবে লেবার পার্টি।” হিন্দু মূল্যবোধের প্রশংসা করেছিলেন। ব্রিটেনের অর্থনীতিতে ভারতীয়দের অবদান তুলে ধরেছিলেন। শুধু মুখের কথা নয়, গত এপ্রিলে লেবার পার্টির শিখ কাউন্সিলর, পারবিন্দর কওরের বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ তদন্ত শুরু করেছিল। খালিস্তানি সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী এবং সন্ত্রাসবাদীদের সমর্থনে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করতেন পারবিন্দর। গত সেপ্টেম্বরে, ভারতীয় বংশোদ্ভূত ছায়া-মন্ত্রী, প্রীত কৌর গিলকেও খালিস্তানিপন্থীদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার দায়ে পদচ্যুত করেছে লেবার পার্টি।

এছাড়াও, স্টারমার ঘোষণা করেছিলেন, নির্বাচনে জিতলে, ভারতের সঙ্গে এফটিএ চুক্তি করতে তৈরি তারা। জুনের শেষে, লেবার পার্টির ছায়া বিদেশ মন্ত্রী, ডেভিড ল্যামি ভারতীয় বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করকে তাঁর “বন্ধু” বলে উল্লেখ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন এবং বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গোয়েলের কাছে আমার বার্তা, লেবার পার্টি এফটিএ চুক্তি করতে প্রস্তুত। আসুন অবশেষে আমাদের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিটি সম্পন্ন করি।” মজার বিষয় হল, সুনক তাঁর ভারতীয় অতীতের কারণে, প্রকাশ্যে ভারতের প্রতি পক্ষপাত প্রদর্শনের বিষয়ে অতিরিক্ত সতর্ক ছিলেন। স্টারমার কিন্তু অবাধে ভারতের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখিয়েছেন। আর এভাবেই হিন্দুত্বের পোস্টার বয়, ঋষিকে পিছনে ফেলে দিয়েছেন তিনি।