Gaza Strip: ‘বিশ্বের সবথেকে বড় মুক্ত কারাগার’ গাজা ভূখণ্ড কি এবার ‘নরকে’ পরিণত হবে?
Gaza Strip: গাজা ভূখণ্প্রডকে বলা হয় 'বিশ্বের সবথেকে বড় মুক্ত কারাগার'। কিন্তু, সম্প্রতি গাজায় সম্পূর্ণ অবরোধ ঘোষণা করেছে ইজরায়েল। যার জেরে বুধবার রাত থেকে বিদ্যুৎ নেই গাজায়। কেন গাজা ভূখণ্ডকে মুক্ত কারাগার বলা হয়? তার থেকেও বড় প্রশ্ন, এবার কি গাজা ভূখণ্ড 'পৃথিবীর বুকে নরকে' পরিণত হবে?
গাজা সিটি: বুধবার (১১ অক্টোবর), অন্ধকারে ঢেকেছে গাজা ভূখণ্ড। ইজরায়েল হামাস যোদ্ধাদের অতর্কিত হামলার পর, সোমবার থেকেই গাজা ভূখণ্ডে সম্পূর্ণ অবরোধ জারির নির্দেশ দিয়েছিল ইজরায়েল সরকার। বিদ্যুৎ, খাবার, জল, জ্বালানি – সব সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বুধবার পর্যন্ত গাজা ভূখণ্ডের একমাত্র বিদ্যুৎকেন্দ্রটি কাজ করছিল। এদিন, জ্বালানির অভাবে সেটি বন্ধ করে দিতে হয়েছে। এর ফলে, প্রশ্ন উঠে গিয়েছে ‘বিশ্বের সবথেকে বড় মুক্ত কারাগার’ গাজা ভূখণ্ড কি এবার ‘পৃথিবীর বুকে নরকে’ পরিণত হবে? প্রথমে জেনে নেওয়া যাক, কেন গাজা ভূখণ্ডকে ‘বিশ্বের সবথেকে বড় মুক্ত কারাগার’ বলা হয়। এর জন্য প্রথমে একটু গাজা ভূখণ্ডের ভূগোল-ইতিহাস জেনে নিতে হবে।
ভূগোল
গাজার উত্তর ও পূর্বে রয়েছে ইজরায়েল আর দক্ষিণে রয়েছে মিশর, পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর। দৈর্ঘ্যে গাজা ভূখণ্ড ৪১ কিলোমিটার, আর চওড়ায় ১২ কিলোমিটার। ১৯৯৪ সালে, গাজা সীমান্তে ৬০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি প্রাচীর দিয়েছিল ইজরায়েল। তারপর থেকে বেশ কয়েকবার এই প্রাচীরকে অত্যাধুনিক সুরক্ষা ব্যবস্থায় সজ্জিত করা হয়েছে। সীমান্ত এলাকায় সুড়ঙ্গ খুঁড়েও যাতে কেউ গাজা থেকে ইজরায়েলে ঢুকতে না পারে, তার জন্য মাটিরক নীচেও সেন্সর দেওয়া প্রাচীর দিয়েছে ইজরায়েল। গাজার দক্ষিণ সীমান্তেও মার্কিন সহায়তায় ১৪ কিলোমিটার লম্বা প্রাচীর দিয়েছে মিশর। তারাও ভূগর্ভস্থ প্রাচীর দিয়েছে। পশ্চিমে, সমুদ্রপথও নিয়ন্ত্রণ করে ইজরায়েল। কাজেই সেই দিক দিয়েও গাজার মানুষ চলাচল বা পণ্য স্থানান্তরের উপায় নেই। গাজার সঙ্গে বহির্বিশ্বের যোগাযোগের মাত্র তিনটি পথ আছে। কারেম আবু সালেম ক্রসিং এবং ইরেজ ক্রসিং নিয়ন্ত্রণ করে ইজরায়েল। আর দক্ষিণের রাফাহ ক্রসিংয়ের নিয়ন্ত্রণ আছে মিশরের হাতে। ইজরাইলের হাতে থাকা ক্রসিংগুলি দিয়ে কোনও পরিস্থতিতেই ওই পাড়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয় না। একমাত্র রাফাহ সীমান্ত দিয়ে ব্যক্তি এবং পণ্য চলাচল হয়, তবে তার উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ রাখে মিশর।
ইতিহাস
১৯৬৭ সাল থেকেই সামরিক দখলে রয়েছে গজা ভূখণ্ড। ছয় দিনের যুদ্ধে, মিশরের থেকে গাজা দখল করেছিল ইজরায়েল। সেই সময় থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে গাজায় ২১টি বসতি নির্মাণ করেছিল ইসরায়েল। ছলে-বলে গাজা থেকে বহু সংখ্যক প্যালেস্টাইনিদের বিতাড়িত করেছিল। ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তির পর, গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহার করা শুরু করে ইজরায়েল। গাজার উপর প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ পায় প্যালেস্টাইনি কর্তৃপক্ষ। ২০০৫-এ সেনা প্রত্যাহার সম্পূর্ণ হয় এবং ২০০৬ সালে নির্বাচন হয়। ইজরায়েলি অবরোধের মধ্যেই ভোট হয়। যোদ্ধা গোষ্ঠী হামাস সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। এরপর, আরেক ইজরায়েলি গোষ্ঠী ফাতাহর সঙ্গে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল হামাসের। যাইহোক, গাজার নিয়ন্ত্রণ হামাসের হাতে যেতেই ইসরাইল স্থায়ীভাবে গাজায় অবরোধ শুরু করে। মিশরও একই পথে হাঁটে। ফলে, সেই সময় থেকে গাজার অধিকাংশ লোকই গাজার বাইরে যেতে পারেন না। পণ্য ও সহায়তা চলাচলেও অনেক কড়াকড়ি রয়েছে।
উন্মুক্ত কারাগার
সেই সময় থেকেই ৩৬৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় বাস করেন ২০ লক্ষেরও বেশি গাজাবাসী। স্বাভাবিকভাবেই এটা বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। তার উপর, খাবার, জল, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, ওষুধ – সবের জন্যই ইজরাইলের উপর নির্ভর করতে হয় গাজাকে। রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবিক বিষয়ক বিভাগের গত বছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গাজার জনসংখ্যার প্রায় ৬১ শতাংশেরই খাদ্য সহায়তার প্রয়োজন। ৩১ শতাংশ পরিবার আর্থিক সংস্থানের অভাবে টিউশন ফি দিতে পারে না এবং বই কেনার ক্ষমতা নেই। তাই, শিক্ষারও অভাব রয়েছে। বেকারত্বের হার ৪৬ শতাংশের বেশি। সেই সঙ্গে রয়েছে, চরম বিদ্যুতের ঘাটতি। প্রায় গোটা গাজা ভূখণ্ডেই প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১১ ঘন্টা করে বিদ্যুৎ সংযোগ থাকে না। প্যালেস্টাইনের ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক এলাকায় যাওয়ার কোনও উপায় নেই গাজাবাসীর। এই কারণেই প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন, মার্কিন অর্থনীতিবিদ নোয়াম চমস্কি-সহ বহু মানুষ গাজা ভূখণ্ডকে ‘বিশ্বের সবথেকে বড় উন্মুক্ত কারাগার’ বলে উল্লেখ করেছেন।
পৃথিবীর বুকে নরক
এরই মধ্যে সোমবার গাজাকে ‘সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ’ করার কথা ঘোষণা করেছে। ইতিমধ্যেই অবরুদ্ধ অঞ্চলে জল, খাবার, বিদ্যুৎ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। যা গাজা ভূখণ্ডের সাধারণ মানুষের জীবনে আরও সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
জল
অবরোধ ঘোষণার আগে থেকেই গাজায় জলের ঘাটতি ছিল। গাজা জলাধার, ইসরায়েল থেকে আমদানি কর জল এবং আমদানি করা জ্বালানির সাহায্যে চালানো ছোট ডিস্যালিনেশন প্ল্যান্ট – এই তিনটিই গাজার জলের উৎস। ৭৮ শতাংশ কলের জলই নোনতা এবং দূষিত। পান করা যায় না, ব্যবহারের অনুপযুক্ত। তাও, ওই জলেই স্নান, জামাকাপড় কাচাকাচি করতে বাধ্য হয় গাজার মানুষ। পানীয় এবং রান্নার জন্য তাদের জল কিনতে হয়। অতিরিক্ত নিষ্কাশনের ফলে ভূগর্ভস্থ জলের গুণমান বছর বছর খারাপ হয়েছে। এর মধ্যে জলের সরবরাহ বন্ধ করে দিলে, গাজাবাসীর জীবনই ঝুঁকির মুখে পড়বে।
খাদ্য
খাবারের বিষয়ে গাজার বহির্বিশ্বের উপর নির্ভরতা আরও বেশি। বেঁচে থাকার জন্য যেটুকু খাবারের দরকার, তার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশই গাজায় আসে বাইরে থেকে। এর মধ্যে রয়েছে গম, চাল, ভোজ্য তেল, ডাল, চিনি, দুগ্ধজাত পণ্য, মাংস এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার। গাজার কিছু কিছু জায়গায় অল্প কিছু ফল, সবজি, জলপাই তেল এবং সামুদ্রিক খাবার উৎপাদন হয়। কিন্তু তা গাজাবাসীর চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়। উর্বর জমি থাকলেও, বড় আকারের চাষের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ এবং পরিকাঠামো নেই। ২০০৭-এ অবরোধ শুরুর আগে এই অঞ্চলে বছরে ৪ লক্ষ টন খাদ্য আমদানি করত। অবরোধ শুরুর পর থেকে নিয়মিত নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রীর ঘাটতি থাকে। সম্পূর্ণ অবরোধের ফলে, বহু গাজাবাসীকে হয়তো অনাহারে থাকতে হবে।
বিদ্যুৎ
গাজায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকাঠামো নেই। একমাত্র গাজা পাওয়ার প্ল্যান্টে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। তবে জ্বালানির অভাবে ১২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতাসম্পন্ন কেন্দ্রটিতে মাত্র ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উত্পাদন করা যায়। এদিকে গাজার বিদ্যুতের চাহিদা প্রায় ৪০০ মেগাওয়াট। তাই, ইসরায়েল থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করতে বাধ্য গাজা। তবে, ইজরায়েলও দেয় মাত্র ১২০ মেগাওয়াট। ফলে, প্রায় ৫০ শতাংশ বিদ্যুতের ঘাটতি থাকে। এই ঘাটতির কারণে প্রায়ই ব্ল্যাকআউট জরি করতে হয়। প্রতিদিন মাত্র ১১ ঘণ্টা করে বিদ্যুৎ সংযোগ থাকে। মাঝে মাঝেই স্বাস্থ্য, নিকাশি, শিক্ষার মতো পরিষেবা বিকল হয়ে যায়। বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্পূর্ণ বন্ধের অর্থ গাজায় পুরো অন্ধকার নেমে আসা। বুধবার যা দেখা গিয়েছে।
পণ্য উৎপাদন
গাজায় কোনও পণ্য উত্পাদন হয় না বললেই চলে। কয়েক দশকের ইজরায়েলি দখলদারি এবং মানুষ ও পণ্যের চলাচলে বিধিনিষেধের ফলে শিল্পের বিকাশ ঘটেনি। দক্ষ শ্রম, পরিকাঠামো এবং রফতানি বাজারের অভাব রয়েছে। উৎপাদন খাত থেকে গাজার মাত্র ৫-৭% জিডিপি আসে। গৃহস্থালীর পণ্য, জামাকাপড়, আসবাবপত্র, যন্ত্রপাতি এবং ইলেকট্রনিক্সের মতো পণ্য ইজরায়েল থেকে বা মিশর থেকে সুড়ঙ্গের মাধ্যমে আমদানি করতে হয়। তাই পণ্যের দামও বেশি। স্থানীয় স্তরে কিছু আসবাবপত্র এবং বস্ত্র উত্পাদন করা হয়। তবে, তাতে বাণিজ্যিক প্রয়োজনে মেটে না।
ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম
ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামের ক্ষেত্রে গাজা প্রায় সম্পূর্ণভাবে আমদানির উপর নির্ভরশীল। দেশীয় কোনও ওষুধ তৈরি বা বায়োমেডিকেল শিল্প নেই। ডায়াগনস্টিকস, সার্জারি, কেমোথেরাপি, ডায়ালিসিস বা অন্য চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আমদানি করাও অত্যন্ত কঠিন। ২০১৬ সালে দেখা গিয়েছিল, গাজার প্রধান হাসপাতালে ৫০ শতাংশ প্রয়োজনীয় ওষুধই নেই। চিকিৎসা সরঞ্জামেরও ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। এই কারণে, গাজাবাসীকে প্রায়শই উন্নত চিকিৎসার জন্য বাইরে যেতে হয়। নয়া অবরোধের মধ্যে তা অসম্ভব। একদিকে বিদ্যুতের অভাব, অন্যদিকে ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম না থাকলে, স্বাস্থ্য পরিষেবা সম্পূর্ণ বিকল হয়ে যাবে।
কাজেই, এতদিন যা ছিল ‘সবথেকে বড় মুক্ত কারাগার’, তা এখন ‘পৃথিবীর বুকে নরক’ হওয়া সময়ের অপেক্ষা বললেই চলে।