Gig Work: ঝোঁক বাড়ছে ‘গিগ ওয়ার্কে’র, চাকরি-বাকরি ছেড়ে সবাই কী ডেলিভারিই করবে?
Gig Work: সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতায় খবরের বোঝা হাতে ছুটে চলা রানারের কথা তো সবাই জানা। খাবারের বোঝা হাতে যে রানাররা রোজ সমানে ছুটে চলেছেন। তাঁদের জন্য আমরা ঘরে বসে খাবার পাচ্ছি। হোটেল-রেস্তোরাঁর ব্যবসা ফুলে-ফেঁপে উঠছে। কিন্তু তাঁদের কথা কতটা জানে সবাই?
নয়া দিল্লি: শীতের এই সময়টা বাঙালির একটু ভাল-মন্দ খাওয়ার সময়। আর মুড ভাল থাকলে আমরা প্রায় সবাই কমবেশি বাইরের খাবার পছন্দ করে। সেজন্য এখন তো আবার রেস্তোরাঁয় যাওয়ারও দরকার নেই। ফোনে অর্ডার দিলে ঘরে বসে গরমা-গরম। আমাদের দেশে অনলাইন ফুড ডেলিভারিতে গতবছর প্রায় ৩ লক্ষ কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছে। হিসেব বলছে ২০৩০ সালে এটা বেড়ে দাঁড়াবে ৮ লক্ষ কোটি টাকা। বছরে প্রায় ৩০ শতাংশ গ্রোথ।
সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতায় খবরের বোঝা হাতে ছুটে চলা রানারের কথা তো সবাই জানা। খাবারের বোঝা হাতে যে রানাররা রোজ সমানে ছুটে চলেছেন। তাঁদের জন্য আমরা ঘরে বসে খাবার পাচ্ছি। হোটেল-রেস্তোরাঁর ব্যবসা ফুলে-ফেঁপে উঠছে। কিন্তু তাঁদের কথা কতটা জানে সবাই?
শুধু ফুড ডেলিভারি নয়। যিনি অ্যাপে বুক করা জিনিসপত্র বাড়িতে পৌঁছে দেন। বা ধরুন অ্যাপ-ক্যাবের ড্রাইভার, কিংবা যিনি অ্যাপ-বাইক চালান। ওঁদের সকলের জীবন এক তারে বাঁধা। ওঁরা সকলে আজ এক বৃহত্তর গিগ ইকনমির অঙ্গ। যে নতুন সিস্টেম ক্রমশ অর্থনীতির পরতে পরতে গেঁড়ে বসছে। এর প্রভাব সুদূর প্রসারী।
গিগ ইকনমি ব্যাপারটা কী? কেনই বা একজন ফুড ডেলিভারি বয়ের সঙ্গে ডাক হরকরার তুলনা? অ্যাপ ক্যাবের ড্রাইভার কিংবা অ্যাপ বাইকের চালককে কোম্পানি পার্টনার বা ক্যাপ্টেনের মতো নামে ডাকে। ভাবুন তো যে অ্যাপ ক্যাব সংস্থা দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে ব্যবসা করছে। তাদেরই পার্টনার হলেন কিনা আমার-আপনার প্রতিবেশি একজন ছাপোষা ড্রাইভার। যাঁকে রোজ হিসেব করে দিন চালাতে হয়। এটাই আসলে গিগ ইকনমি। যেখানে কেউ কোনও সংস্থার কর্মী নন। সকলেই বড় সংস্থার সহযোগী। ফলে একজন ঠিকাকর্মীর প্রতিও কোনও সংস্থার যে দায়বদ্ধতা থাকে। তা এই ফুড ডেলিভারি বয়েদের বা অ্যাপ ক্যাব চালকদের জন্য তাঁদের সংস্থার থাকে না।
কোম্পানি ভুল করেও এঁদের ওয়ার্কার কিংবা কন্ট্র্যাক্চুয়াল এমপ্লয়ি বলে না। কর্মী বলে মেনে নিলেই কিছু আইনি দায়বদ্ধতা তৈরি হয়ে যায়। তাই কর্মীর বদলে অন্যান্য গালভরা নাম। পার্টনার বা ক্যাপ্টেন। একজন ঠিকাকর্মীও মালিকের কাছে অভিযোগ জানাতে পারেন। কিন্তু এই গিগ ইকনমির কর্মীদের কাছে সে উপায় নেই। কারণ এখানে অফিস নেই। ম্যানেজার বা বসকে চোখের সামনে দেখা যায় না। কোম্পানির সঙ্গে যতটুকু যা কমিউনিকেশন সবই ফোনে। আর ফোনের উল্টো দিকে যিনি বসে তিনি শুধু হুকুম তামিল করা একজন নিচুতলার কর্মী। পার্টনার কোম্পানির পলিসি নিয়ে অভিযোগ জানালে তার সমাধান করার ক্ষমতা ওই ব্যক্তির নেই।
যাঁরা এরকম গিগ ইকনমির সমর্থক তাঁদের একটা যুক্তি আছে। এইখানে একজন কর্মী পুরোপুরি স্বাধীন। চাইলে কাজ করবেন। না চাইলে করবেন না। ছুটি চাইলেই ছুটি। বেশি রোজগার চাইলে বেশি কাজ। চয়েস আপনার হাতে। আবার একইসঙ্গে একজন একাধিক সংস্থার হয়ে কাজ করতে পারেন। ফোনে একাধিক সংস্থার অ্যাপ খুলে রাখলেই হল। যে বেশি রেট দেবে তার হয়ে কাজ করুন।
এই কথাগুলো শুনতে বিশ্বাসযোগ্য হলেও এর মধ্যে অনেক গ্রে লাইন আছে। একজন গিগ ইকনমির কর্মী পেমেন্টের বিষয়ে তাঁর কোম্পানির সঙ্গে দর কষাকষির জায়গাতেই নেই। গাড়িও আপনার। তেলও আপনার। পরিশ্রম আপনার। সবই আপনার। কোম্পানির তো কোনও দায়ই নেই। আছে শুধু একটা অ্যাপ চালানোর খরচ। ছোটো একটা অফিস হলেই হল। এই ব্যবসায় জমি লাগে না। ভারি মেশিন লাগে না। সবটাই তো মাছের তেলে মাছ ভাজা।
তবে গিগ ইকনমির ভাল দিক কি কিছু নেই? আছে। নেই মামার চেয়ে কানা মামা যদি ভালো হয়। নতুন এই সিস্টেমে কর্মসংস্থান হচ্ছে। কাজের মান যাই হোক না কেন। অল্প হলেও রোজগারের সুযোগ তো তৈরি হচ্ছে। যে বেকার ছেলেটির হাতে কাজ না থাকলেও চড়ার মত একটা বাইক ছিল। যে বাইকটার আসলে কাজের কাজ কিছু ছিল না। সেই বাইই আজ তাঁকে রোজগারের পথ দেখাচ্ছে। একজনের হাতে কাজ না থাকা তাঁর সমস্যা। আর যখন অনেকের হাতেই কাজ না থাকে তখন তা সামাজিক সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। কাজ না পেয়ে যুবসমাজ বিপথে যায়। ফলে গিগ ইকনমি তাদের হাতে কাজ তুলে দিয়ে সমাজের ভাল করতে পারে।
এইসব অ্যাপ-ভিত্তিক সংস্থাগুলোর ওপর সরকারি নজরদারি কতটা থাকা উচিত। আইনি সংস্থান আছে কী নেই। সহজ কথা হল বেসরকারি সংস্থা তার লাভ বুঝে নেবে। ফলে যেখানে শ্রমিকের জোগান বেশি। চাহিদা কম। সেখানে শোষণও চলবে। এতে লাগাম দেওয়া গেলেও তা পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব নয়। সারা দেশই যাতে গিগ ইকনমি হয়ে না যায়, তার জন্য নীতি নির্ধারকদের ভাবতে হবে। অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা যদি তাঁদের যোগ্যতার সঙ্গে মানানসই কাজ পেয়ে যান। তাহলে তাঁরা কনভেনশনাল জবই করবেন। গিগ ইকনমির শরিক হতে চাইবেন না।
নানা সমীক্ষায় এ তথ্য উঠে এসেছে। আর যখন ডেলিভারি বয়ের অভাব দেখা যাবে তখন কোম্পানিও অন্যভাবে ভাবতে বাধ্য হবে। মানে তখন গিগ ইকনমিও শ্রমিকের কথা না ভেবে পারবে না। এটাই বর্তমান ব্যবস্থায় একমাত্র সলিউশন হতে পারে। আর সরকারকেই তা খুঁজে বের করতে হবে।
সারা দেশটাই যদি গিগ ইকনমি হয়ে যায়। তা হলে মানুষের কাজের ব্যাপারটা একটা দিক। আরেকটা দিক হল আপনাকে যদি আর দোকানে যেতে না হয়। দোকানই যদি চলে আসে ঘরের দুয়ারে। তা হলে কী হবে। খোঁজ নিলে দেখবেন, আপনার পাড়ার মুদি দোকানদার কিংবা স্টেশনারি দোকানের মালিক আপনাকে বলবেন, বেচাকেনা কমে গিয়েছে। সবাই তো ঘরে বসে সব পেয়ে যাচ্ছে। লোকে দোকানে আর আসবে কেন।
দেশে কৃষির পর সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান হয় রিটেল ট্রেডে। ইট-কাঠ-কংক্রিটের যে দোকান। যাকে বলা হয় ব্রিক অ্যান্ড মর্টার শপ। সে দোকানের ভবিষ্যত কিন্তু ইতিমধ্যেই প্রশ্নের মুখে। ব্রিক অ্যান্ড মর্টার শপের সবচেয়ে বড় উদাহরণ বলতে পারেন ইউএস জায়ান্ট ওয়ালমার্ট। সেই তারাই এখন অনলাইনে কেনাবেচার ঠেলায় দোকান চালাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে।