EXCLUSIVE-Cannes: বলুন তো আমার ছবি ছাড়া কোন ইন্ডিপেন্ডেন্ট ছবির হোর্ডিং পড়েছে কলকাতার রাস্তায়?: অনীক চৌধুরী

Aneek Chaudhuri: TV9 বাংলার সঙ্গে খোলামেলা  সাক্ষাৎকারে পরিচালক অনীক চৌধুরী। বাংলার ভাবলেশহীনতা দেখে মুখ খুলেছেন শ্রীলেখা মিত্র ও অনীক দত্তর মতো বিখ্যাত বাঙালিরা। 

EXCLUSIVE-Cannes: বলুন তো আমার ছবি ছাড়া কোন ইন্ডিপেন্ডেন্ট ছবির হোর্ডিং পড়েছে কলকাতার রাস্তায়?: অনীক চৌধুরী
পরিচালক অনীক চৌধুরী।
Follow Us:
| Updated on: May 11, 2022 | 6:08 PM

স্নেহা সেনগুপ্ত

আগামী ১৯ মে কানে দেখানো হবে বাঙালি পরিচালক অনীক চৌধুরীর ছবি ‘দ্য টেল অফ স্যান্টা অ্যান্ড হিজ় মথ’। এটা প্রথমবার নয়। এর আগেও তাঁর পরিচালনায় তৈরি হওয়া ছবি কানে গিয়েছে। একটি ছবি রয়েছে অস্কার কমিটির আর্কাইভে। কিন্তু অনীককে কেউ চেনেন না। সাধারণ মানুষ তো দূর, বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কাছেও তিনি একজন অজানা মানুষ। এমনটা কেন? কেন কোনও হেলদোল নেই কারও? এ দিকে সুদূর মুম্বই থেকে করিনা কাপুর খান শুভেচ্ছা পাঠান অনীককে। ছবি প্রেজ়েন্ট করতে এগিয়ে আসে দক্ষিণ ভারত। কিন্তু বাংলা চুপ! বিষয়টি নিয়ে TV9 বাংলার সঙ্গে খোলামেলা  সাক্ষাৎকারে পরিচালক অনীক চৌধুরী। বাংলার ভাবলেশহীনতা দেখে মুখ খুলেছেন শ্রীলেখা মিত্র ও অনীক দত্তর মতো বিখ্যাত বাঙালিরা।  

করিনা কাপুর খান শুভেচ্ছা জানিয়েছেন ‘দ্য টেল অফ স্যান্টা অ্যান্ড হিজ় মথ’ নিয়ে, বাংলার নামিরা কিছু বলেননি?

অবশ্যই শ্রীলেখাদি (অভিনেত্রী শ্রীলেখা মিত্র) বলেছেন। তিনি আমাকে খুবই উৎসাহ দেন। তিনি জানেন ছবিগুলি কখন, কোন জায়গায় থাকে। আমি দিদির সঙ্গে ছবি নিয়ে অনেক কিছু আলোচনা করি।

আর কেউ?

সে রকমভাবে না।

কী কারণে এটা হচ্ছে?

আসলে কানে তো বিভিন্ন বিভাগ রয়েছে। ‘মার্চ দু ফিল্ম’ মার্কেট সেগমেন্ট। অফিশিয়াল সিলেকশনের বিভিন্ন বিভাগ হয়। অনেকে আবার বিভিন্ন সেগমেন্টের ব্যাপারে জানেনও না। আমি কেন সাপোর্ট পাচ্ছি না, তার কারণ বলা খুব সহজ। আমি যে ধরনের ছবি তৈরি করি, সেই ছবির বিনিময়ে মানুষ কী পাবেন, মানিটারি (আর্থিক) বিষয়টা তো প্রযোজকরা গুছিয়েই নেবেন, তাই না!

কিন্তু এটা তো টাকাপয়সার ব্যাপারই নয়। এটা তো বাংলা চলচ্চিত্র জগতের কাছে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনেক সম্মানের বিষয়… কানের মতো ফেস্টিভ্যালে দেখানো হচ্ছে ছবিটা!

এই তালিকায় কিন্তু কেবল আমি নেই। অনেকেই আছেন। খুব ভাল-ভাল পরিচালক আছেন। যেমন ধরুন আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্ত। ওঁর ছবি ‘ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন ক্যালকাটা’ ভেনিসে গিয়েছে। বৌদ্ধায়ন মুখোপাধ্যায়ের প্রযোজনা ও অভিনন্দন বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত ছবি এবারের কানে দেখানো হচ্ছে। ছবিটার নাম ‘মানিকবাবুর মেঘ’।

‘মানিকবাবুর মেঘ’ তো এবারের আন্তর্জাতিক কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালেও ছিল। কিন্তু আপনার ছবি দেখানো হল না কেন?

কারণ আমাদের ছবিটা তখনও তৈরিই হয়নি।

না হলে দেখানো হত?

(হাসি) জানি না ঠিক কী হত!

আপনার খারাপ লাগে না ভেবে, যে আপনার মতো একজন পরিচালককে বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কেউই সেভাবে চেনেন না?

খারাপ লাগে না হয়তো। আসলে আমার কাজ হল ভাল-ভাল সিনেমা তৈরি করা। বিষয়টা আসলে একজন পরিচালকের উপর নির্ভর করে—তিনি কোথায় জায়গা পেতে চান। তিনি কি খবরের কাগজে জায়গা পেতে চান নাকি জায়গা পেতে চান ইতিহাসের পাতায়? ইতিহাসের পাতায় জায়গা পাওয়ার যাত্রাপথ অনেকটা লম্বা।

তা হলে ধরে নেব যে আপনি ইতিহাস তৈরি করতে চান?

আসলে আমি সেরকমই কিছু কাজ করতে চাইব, যা নিয়ে আমার চলে যাওয়ার পরও লোকে আলোচনা করবে।

ঋত্বিক ঘটকের মতো?

উনি অনেক মহান ব্যক্তি। অনেক বাঙালির মতো উনি আমারও অত্যন্ত প্রিয় একজন পরিচালক। যাঁরা একটু অন্য ধরনের কাজ করতে চাইছেন কিংবা করে চলেছেন, তাঁদের সকলেরই এই ব্যাপারটা রয়েছে। আমার ছবি তো তা-ও বিভিন্ন মাধ্যমে প্রোমোট করা হচ্ছে। অনেক পরিচালকের অনেক ভাল-ভাল ছবি আসে, যার প্রচারই হচ্ছে না এক্কেবারে।  কেবল বাংলায় নয়, গোটা ভারতবর্ষেই।

এরকম কেন হচ্ছে?

কারণ অবশ্যই টাকা। প্রচারের জন্য অনেক কিছু হয়। আমাকে মনে করে বলুন তো আমার ছবি ছাড়া কোন ইন্ডিপেন্ডেন্ট ছবির হোর্ডিং পড়েছে কলকাতার রাস্তায়। একটাও না… আমি তো ভাগ্যক্রমে স্পনসর পেয়ে গিয়েছি।

বাংলার যে-যে বড়-বড় প্রযোজনা সংস্থা রয়েছে, তারা এগিয়ে এসেছে আপনার কাছে কোনওদিনও?

কোনওদিনও এরকম হয়নি। আমিও যাইনি, তাঁরাও আমার কাছে আসেননি।

ওঁরা তো এলেন না বুঝলাম, কিন্তু আপনি কেন গেলেন না?

কারণ, ওঁদের ছবি করার ধরনটা এক্কেবারে আলাদা। সেটা আমি সম্মান করি। আমার ছবি করার ধরন আলাদা। প্যাটার্নের ফারাক আসলে। ওঁরা যদি আমার ছবি তৈরি করে টাকা না কামাতে পারেন, তা হলে কেন তৈরি করবেন? ওরা তো ব্যবসায়ী…

আপনি তা হলে ধরেই নিয়েছেন আপনার ছবি দেখালে ব্যবসা হবে না?

সাধারণ মানুষ যেটা হলে এসে টাকা দিয়ে টিকিট কিনে দেখে, সেরকম ছবি আমি তৈরি করি না। আমার ছবির বিষয় খুব সিরিয়াস। চারপাশের গুরুগম্ভীর বিষয় সারাদিন ধরে দেখেন মানুষ। হলে এসে সেই গুরুগম্ভীর বিষয়টা তাঁরা ফের কেন গ্রহণ করবেন, বলতে পারেন?

দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ তো সিরিয়াস ছবি… সেটা কেন চলল?

এই ছবির ন্যারেটিভটা আলাদা। আমার ছবিতে মোনোটনি (একঘেয়েমি) ও মেল্যানকোলি (দুঃখ) রয়েছে। আমার ছবি মনি কল, তারকভস্কির অনুপ্রেরণায় তৈরি।

এবার বলুন তো, বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কোন পরিচালকের কাজ আপনার ভাল লাগে?

সাম্প্রতিককালে একটি ছবি দেখলাম ‘শহরের উপকথা’। বাপ্পার ছবি। আমার বেশ ভাল লেগেছে। এছাড়া কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়কে আমার খুবই ভাল লাগে। ওঁর দিকে সকলে তাকিয়ে থাকেন। ওঁর তৈরি করা টেলিফিল্ম দেখেই তো বড় হয়েছি।

কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা হয়? উনি চেনেন আপনাকে?

সেই ভাবে না। সকলের সঙ্গে কথা হয়ে ওঠে না। সকলেই সকলের মতো কাজে ব্যস্ত থাকেন।

শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, সৃজিত মুখোপাধ্যায়.. এদের ছবি আপনার কেমন লাগে?

শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কিন্তু খুব সৎ একজন পরিচালক। উনি যেটা তৈরি করতে চান, সেটাই তৈরি করেন, সেটাই দেখান। সেটা করতে কিন্তু সাহস লাগে। সৃজিত মুখোধ্যায়ের ‘নির্বাক’ ছবিটি আমার ভাল লেগেছিল। ‘অটোগ্রাফ’ও। আমি সৃজিতের বিশাল ভক্ত নই।

আর অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মধ্যে কাকে ভাল লাগে বাংলায়?

আবারও কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম নেব। ঋত্বিক চক্রবর্তীর নাম নেব। অভিনেত্রীদের মধ্যে অমৃতা চট্টোপাধ্যায়কে ভাল লাগে। অনন্যা চট্টোপাধ্যায়কেও ভাল লাগে।

মিমি, নুসরত, দেব, জিৎ… এদের কেমন লাগে অভিনেতা হিসেবে?

মিমি ও নুসরতের কাজ আমি সেইভাবে দেখিনি। সকলেই হয়তো নিজের-নিজের কাজে ভালই হবেন। না হলে এতদিনে টিকে থাকতে পারতেন না। দেব খুবই সৎ একজন অভিনেতা। প্রচণ্ড উন্নতি হচ্ছে ওঁর। দেবকে নিয়ে ভবিষ্যতে কাজ করতে আমি আগ্রহী। ‘বুনো হাঁস’-এ ভাল অভিনয় করেছিল।

কিন্তু এঁরা তো কেউই আপনাকে চেনেন না!

কী করে চিনবেন? আমাদের রাস্তা তো আলাদা।

কী করে আলাদা? আপনি তো একজন বাঙালি পরিচালক… তার উপর বছর-বছর আপনার ছবি কানের মতো উৎসবে যাচ্ছে, অস্কার কমিটির কাছে আর্কাইভ হচ্ছে। এর কি কোনও মূল্য নেই?

আসলে আমি তো এই ইন্ডাস্ট্রিটার কেউ নই।

তা কেন?

আমি তো এই ইন্ডাস্ট্রিটার হয়ে কোনও কাজ করছি না।

কিন্তু দিনের শেষে আপনি তো একজন বাঙালি?

সেটা তো বটেই। কী করা যাবে। আমি ভাবলেশহীন হয়েই থাকতে চাই। আর নিজের কাজটা মন দিয়ে করতে চাই।

এবারে কানে দক্ষিণ ভারতের দু’টি ছেলে আপনার ছবি ‘দ্য টেল অফ স্যান্টা অ্যান্ড হিজ় মথ’ প্রেজেন্ট করছে। এটা তো বাংলা থেকেও হতে পারত?

দক্ষিণ ভারত থেকে প্রবীণ জেমস (কেরালা) বলে একজন আমাকে মেসেজ করেন। তিনি বলেন যে, তিনি আমাকে চেনেন। কুয়েতে ওঁরা একটি ফেস্টিভ্যাল অর্গানাইজ় করছিলেন, সেখানে পাঠাতে চেয়েছিলেন আমার ছবিটা। সেই সময় ছবিটা শেষ করার জন্য আমার টাকার খুব দরকার ছিল। বিষয়টা আমি প্রবীণকে জানাই। পার্টনারের সঙ্গে কনফারেন্সিং করায়। আলোচনা শুরু করি। অবাক কাণ্ড, ৭-১০ দিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যায়, আমার ছবিটাকে ওঁরা বিশ্বের সবক’টি ফেস্টিভ্যালে নিয়ে যাবেন। আমাদের কিন্তু কোনওদিনও সামনাসামনি দেখাও হয়নি। তা সত্ত্বেও ওঁরা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। ওঁরাই ছবিটা নিয়ে গোটা ইউরোপ ঘুরবেন বলেছেন। কান ছাড়াও ফ্রান্স, পোল্যান্ড, ভিয়েনাতে নিয়ে যাচ্ছেন আমার ‘দ্য টেল অফ স্যান্টা অ্যান্ড হিজ় মথ’কে। এই দুই দক্ষিণী আমাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করেন। আমিই ওঁদের ‘বস’। আমিই সব সিদ্ধান্ত নিই। সবকিছু আমার হাতেই আছে। আমি ওঁদের গাইড করি। আর ওঁরা তৈরি থাকেন।

এটা থেকে ওঁদের আর্থিক মুনাথা হয় কি?

এখানেই মজার ব্যাপার। দক্ষিণীরা ফেস্টিভ্যাল সার্কিটকে ব্রাশ আপ করতে চাইছে। বুঝতে চাইছে। ওঁরা কিন্তু টাকার ব্যাপারে একেবারে ভাবছেনই না।

সেই ব্রাশ আপটা কলকাতার কেউ করতে চাইতে পারতেন অনায়াসে… আপনার পাশে দাঁড়াতে পারতেন…

মনে হয় না।

এই কারণগুলোর জন্যই কি দক্ষিণী ছবির তুলনায় কলকাতা পিছিয়ে যাচ্ছে?

দক্ষিণ ভারতে থিয়েটারের দর্শক অনেক বেশি। ওখানকার দর্শক কিন্তু নিয়ম করে হলে গিয়ে ওঁদের ভাষার ছবি দেখেন। এটা জায়গাটা বাংলা হারিয়েছে।

১৯ মে এই বছরের কানে দেখানো হবে পরিচালক অনীক চৌধুরীর ছবি ‘দ্য টেল অফ স্যান্টা অ্যান্ড হিজ় মথ’।

গ্র্যাফিক্স: অভীক দেবনাথ।