‘ভাল মা’ হয়ে ওঠার দাবি ও ইচ্ছেয় নারীর ‘আমি’ কতটা? সেলেব-মা থেকে বিশেষজ্ঞরা যা বললেন…
Identity crisis of a woman: ‘ভাল মা’ হতে চাওয়ার এসকেলেটারে উঠে পড়া মেয়েটি ‘ভাল আমি’ হতে চাওয়ার ইচ্ছেকে নিজেই মেরে ফেলবে। তবুও ‘ভাল মা’ হতে চাওয়ার শেষ সিঁড়ির ধাপটায় পৌঁছনো হবে না তাঁর।
‘আমার বাবা ভোলে বাবা, ভাল বাবা নয়’—বাংলা ব্যান্ড ‘চন্দ্রবিন্দু’র উপলব্ধি। ২০২১-এর আম আদমি কোথাও সে উপলব্ধির ধারক ও বাহক। বাবা ততটা ভাল না হলেও যেন চলে যায় অনেকাংশে। সমাজের এক্সেল শিটে একটু কম ভাল বাবাদের মার্কস কি সত্যিই কমে যায়?
কিন্তু মা? ‘কুপুত্র যদি বা হয়, কুমাতা কদাপি নয়’—মহাভারতের সেই অমোঘ দর্শন থেকে ‘মা হওয়া কি মুখের কথা?’ গোছের আপ্তবাক্যের সেন্সর বোর্ড কাঁচি নিয়ে বসে রয়েছে মায়েদের জন্য। একটু এ দিক-ও দিক হলেই মায়ের নম্বর কাটা পড়বে। ‘ভাল মা’ হওয়া হয়ে উঠবে না।
‘ভাল মা’ হতে চাওয়ার এসকেলেটারে উঠে পড়া মেয়েটি ‘ভাল আমি’ হতে চাওয়ার ইচ্ছেকে নিজেই মেরে ফেলবে। তবুও ‘ভাল মা’ হতে চাওয়ার শেষ সিঁড়ির ধাপটায় পৌঁছনো হবে না তাঁর। আঁচলে হলুদের দাগ লেগে থাকা আটপৌরে-মা হোক বা কর্পোরেট মিটিং সামলে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরা আধুনিক-মা, নিরপেক্ষ জায়গা থেকে দেখলে ‘ভাল মা’ হয়ে ওঠার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপালন করতে গিয়ে ভাল থাকতে চাওয়া ‘আমি’টা যেন হারিয়ে যায় কবেই!
সন্তান জন্মের মুহূর্ত থেকেই মেয়েদের এক নতুন পরিচয় যোগ হয় সিভিতে। মা। ছোট্ট শব্দ। অভিঘাত অনেক বেশি। দায়িত্ব, আনন্দ, ভয়, উত্তেজনা—অনেকগুলো ইমোশন মিলেমিশে বসত করে। সন্তানকে একা হাতে বড় করেন অধিকাংশ মা। স্যাক্রিফাইস করেন নিজের পেশাদার সত্ত্বা, নিজের ‘আমি’ হয়ে ওঠার দিনগুলোকে। কোনও মা আবার সন্তানকে একটা বয়সের পর অন্য কারও দায়িত্বে রেখে ফিরে যান নিজের সত্ত্বার খোঁজে। দু’টোই একান্ত ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। তা দিয়ে মা-কে বিচার করার প্রশ্ন নেই। ঠিক যেমন কয়েকদিন আগে সদ্য মা হওয়া অভিনেত্রী মধুবনী গোস্বামী সোশ্যাল মিডিয়ায় এ বিষয়ে স্পষ্ট নিজের মত জানিয়েছেন। মধুবনী লিখেছেন, “আমি গর্বিত। আমরা কেশবের (মধুবনীর পুত্র সন্তান) জন্য কোনও আয়া রাখিনি। এটা রাজা (মধুবনীর স্বামী) এবং আমি কেশবের জন্মের কয়েক মাস আগে যৌথ ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। এর প্রধানত দু’টো কারণ। প্রথমত প্যানডেমিক। … দ্বিতীয়ত আমরা আমাদের ছেলেকে আয়ার কাছে রেখে মানুষ করতে চাই না। আমি এখন কাজেও ফিরব না। আমার কাছে টপ প্রায়োরিটি কেশব।”
মধুবনীর এই সিদ্ধান্ত একান্তই ব্যক্তিগত। কিন্তু এখানেই যেন প্রশ্ন ওঠে, যে মা এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তিনি নিজে ভাল থাকছেন তো? সদ্য মা হয়েছেন অভিনেত্রী প্রিয়ম চক্রবর্তী। তাঁর মতে, “কারও সাহায্য নিয়ে বাচ্চা মানুষ করাটা ভুল নয়। বাচ্চার জন্য কেরিয়ার স্যাক্রিফাইস করছি, যে দিনই মনে হবে, সে দিন আমি ভাল থাকব না, বাচ্চাকেও ভাল রাখতে পারব না। আমি নিজে মানসিকভাবে ঠিক না থাকলে, বাচ্চাকে ভাল রাখতে পারব না। আবার বাচ্চার জন্য সবটুকু স্যাক্রিফাইস অনেকেই করেন। সেটাও খারাপ নয়। এটা ব্যক্তি পছন্দ। আমার মা-ও কাজ করতেন। আমিও দিদিমার কাছে থাকতাম। অনেক সময় মাকে পাইনি। আবার আমার যখন সুন্দর ড্রেস দরকার, তখন কিন্তু মাকে হাত ধরে বলেছি, ‘এটা দরকার, কিনে দাও।’ মা দিয়েছে, তখন মাকে না পাওয়ার মুহূর্তগুলো ভুলেও গিয়েছি। অনেকে তো সেটাও পান না।”
সন্তানকে বড় করে তোলার প্রাথমিক দায়িত্ব এখনও যেন অনেকটাই মায়েদের, মেয়েদের। কো-পেরেন্টিংয়ের কথা বহুবার বহু আলোচনায় আসে বটে। তবে বাস্তবে এখনও যেন সন্তানের সিংহভাগ দায়িত্ব মায়েদেরই। আসলে সমাজের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে এই ভাবনা ঢুকে যায় শিশুর জন্ম মুহূর্ত থেকেই। এমনটাই মনে করেন মনোবিদ শতভিষা চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, “একজন অভিনেত্রী যদি অভিনয় জগৎ থেকে দূরে থেকে সন্তানকে মানুষ করতে চান, এটা তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতার বহিঃপ্রকাশ। তবুও একটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। সেটা বুঝতে গেলে জেন্ডার রোল (লিঙ্গ-ভূমিকা) নিয়ে বিতর্কটা বুঝতে হবে। একটি শিশু জন্মানোর পর তার লিঙ্গ নির্ধারণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে শ্রম-বিভাজনের মুখোমুখি হতে হয়। মেয়ের জন্য গোলাপি পোশাক আর খেলনা পুতুল। ছেলের জন্য নীল পোশাক আর খেলনা গাড়ি বা ব্যাট-বল। তখনই তাকে খেলাচ্ছলে তার প্রাপ্তবয়স্ত সত্ত্বার কাজকর্ম শেখাতে শুরু করা হয়। তখন থেকেই পুরুষের মধ্যে থাকা মাতৃসত্ত্বা, নমনীয়তাকে চাপা দিতেও শেখানো হয়।”
গোলাপি এবং নীল রঙের এই বিভাজন কিন্তু আজীবনের সঙ্গী। সে কারণেই সন্তান জন্মের পর সাধারণত বাবাদের লম্বা ছুটি নিতে দেখা যায় না। অথবা কবে ফের নতুন বাবা কাজে ফিরবেন, এ প্রশ্নও করা হয় না। ব্যক্তি অভিজ্ঞতায় এ কথা স্বীকার করলেন প্রিয়ম। তিনি শেয়ার করলেন, “আমাকে অনেকেই জিজ্ঞেস করছেন, এখনই ব্যাক করবি? বা পারবি? শুভজিৎকে (প্রিয়মের স্বামী তথা অভিনেতা) কেউ ছেলে হওয়ার পর কিন্তু জিজ্ঞেস করছে না।” একই অভিজ্ঞতা অভিনেত্রী তনুশ্রী ভট্টাচার্যের। তিনি মা হতে চলেছেন। তনুশ্রী বললেন, “যে মেয়েটি মা হতে চলেছেন, তিনি কিন্তু পার্টি করা ছেড়ে দেন, বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা ছেড়ে দেন। অথচ যে ছেলেটি বাবা হবেন, তিনি কিন্তু কিছুই ছাড়েন না। আমি হওয়ার পর আমার মা একটি নামি সংস্থায় চাকরি পান। সে সময় আমাকে কিন্তু যৌথ পরিবারে কেউ রাখতে চাননি। ফলে মাকে চাকরি ছাড়তে হয়। এটাও স্যাক্রিফাইস। মা হওয়ার পর মেয়েদের কাজে ফিরতে পরিবারের সমর্থন দরকার। স্বামীর সাহায্য দরকার।”
পরিবারের তথা স্বামীর সম্পূর্ণ সহযোগিতা পেয়েছেন বলেই সন্তানের জন্মের পর ফের অভিনয়ে ফিরতে পেরেছেন বলে জানালেন অভিনেত্রী পায়েল দে। তাঁর কথায়, “মেরাখ (পায়েলের পুত্র সন্তান) প্রথম সাড়ে পাঁচ মাস ব্রেস্ট ফিড-এ ছিল। প্রথম তিন মাস একটা ঘরের মধ্যেই ছিলাম আমি। যখন আমার চেক-আপের জন্য ডাক্তারের কাছে যাই, উনি প্রথম যে প্রশ্নটা করেন, তা হল: ‘তুই কি সারাক্ষণ একটা ঘরে বসে থাকিস?’ ডাক্তার আমাকে বলেছিলেন, ‘আইডেন্টিটি হারিয়ে ফেলছিস। এটা ভুলিস না। কাজ করবি, বাচ্চা সামলাবি—এটাই চ্যালেঞ্জ।’ আমার ক্ষেত্রে চয়েসটা আছে। আমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। মেরাখ দেখছে, মা সকালে যাচ্ছে কাজে, বাড়ি ফিরছে। বাড়ির ছোট-ছোট কাজ করছে। আবার আমাকেও দেখছে। সকালে কল টাইম থাকলে ওকে দেখতে না পেলে গিল্ট ফিলিং কাজ করে। কিন্তু আমার শ্বশুর, শাশুড়ি, গোগোল (পায়েলের স্বামী তথা অভিনেতা) খুব সাপোর্ট করে। তবে এটা মায়ের চয়েস। আমি ইন্ডিপেন্টেন্ড থাকতে চেয়েছি।”
এই ‘সাপোর্ট’ বা সহযোগিতা পাওয়ার ইচ্ছে বা দাবি, যা একান্তভাবে এবং পুরোদস্তুর সঙ্গত, প্রকারান্তরে কী মাকে বুঝিয়ে দেয়: নারী, তুমি স্বাধীন হয়েও এখনও অনেকাংশে পরনির্ভর কারণ তোমাকে ‘সাপোর্ট’ বা সহযোগিতা পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয়? এ প্রসঙ্গে কনসালটেন্ট ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট সুদীপা বসু বললেন, “সন্তান জন্মের পরে প্রথম কয়েক মাস বাবার থেকে মায়ের ভূমিকা অনেক বেশি। বায়োলজিক্যালি এটা অস্বীকার করতে পারি না আমরা। ফলে মায়ের উপর এক্সপেকটেশনের জায়গা অনেকটাই। এ বার হল সহযোগিতার বিষয়। এটার একটা অন্য দিকও রয়েছে। এখন আমাদের বেশিরভাগই নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি। একসঙ্গে থাকলে কেউ না কেউ দায়িত্ব নিয়ে নিতেন। মায়ের বাবা-মা অথবা বাবার বাবা-মা। নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি হওয়ায় অন্য জায়গা থেকে এসে কেউ সাপোর্ট করছেন। সেটাই বা কতটা করা যায়? মা কাজে চলে গেলে সন্তানকে দেখভাল করছেন যিনি, মাকে সাপোর্ট করছেন, তাঁদেরও তো বয়স হচ্ছে। কোথাও গিয়ে তাঁরা বার্ন আউট ফিল করেন।”
সন্তান পালনের দায়িত্ব এখনও মেয়েদের বেশি মেনে নিয়েও পেরেন্টিং কনসালটেন্ট পায়েল ঘোষ মনে করেন, সন্তানের জন্য ‘আর কাজে ফিরব না’—এই সিদ্ধান্তও যেন কোনও মা তাড়াহুড়ো করে না নেন। তিনি ব্যাখ্যা করলেন, “পেরেন্টিংয়ের ব্যাপারে বাবা-মা দু’জনের সমানভাবে দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন। প্রত্যেকটা জেন্ডারের ইনস্টিঙ্কট থাকে। মেয়েদের মধ্যে গুছিয়ে কাজ করার অভ্যেস বেশি। মেয়েরা অনেকগুলো পকেটকে একসঙ্গে ম্যানেজ করতে পারে। কর্পোরেট ক্ষেত্রেও, সংসারেও। ‘সন্তান প্রতিপালনের জন্য আমি কাজ ছেড়ে দিলাম’, সেই মুহূর্তটা যাপন করতে ভাল লাগছে বলে হয়তো বলা যায়। কিন্তু যিনি কাজ করেছেন, হঠাৎ করে ছেড়ে দিলে একটা সময়ের পর ‘আমিও তো করতে পারতাম’—এই নেগেটিভ ফিলিংটা আসতে পারে। যেটা মায়েদের জন্য খারাপ।”
তা হলে কে বেশি ভাল মা? সমাজের মাপকাঠিতে কোন মা বেশি নম্বর পেলেন? যিনি নিজের কাজ স্যাক্রিফাইস করে সন্তানকে একা হাতে মানুষ করছেন, নাকি যিনি সন্তানকে অন্য কারও দায়িত্বে রেখে নিজের পেশাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন? তর্কটা সেটা নিয়ে। শতভিষার ব্যখ্যায়, “এখানে একটা ভ্রান্তি, একটা অ্যাজ়ামশন থেকেই যাচ্ছে। যে মা পেশাকে প্রাধান্য দিচ্ছেন, তিনি যেন সন্তানকে তার প্রাপ্য, যোগ্য প্রাধান্যটা দিচ্ছেন না। এটা কিন্তু ভ্রান্ত ধারণা। উল্টে রিসার্চ দেখাচ্ছে, উপার্জনকারী মায়ের সন্তান অনেক বেশি স্বাধীন আর আত্মনির্ভর হয়। শুধু তাই-ই নয়, তাদের ফাস্ট্রেটেশন টলারেন্স অপেক্ষাকৃত বেশি হয়। ফলে যাঁরা পেশাগত দিক থেকে নিজেদের চর্চাটা চালিয়ে যান, তাঁরা কিন্তু জানেন, নিজের সময়টা বিভাজন করে সন্তানকে যখন দেন, তখন সেই সময়টা কীভাবে সুন্দর করে দিতে হয়।”
শতভিষার সঙ্গে সহমত পায়েল। তিনি বললেন, “বাচ্চা শুধু মায়ের কাছে বড় না হয়ে বিভিন্ন বয়সী মানুষের সান্নিধ্যে বড় হলে সেটা বাচ্চার জন্যও ভাল। কেয়ার গিভারের সঙ্গে থেকেও বাচ্চা যে সান্নিধ্য পাবে, তাতে তার সোশ্যাল অ্যাডপটেশন বা অ্যাডজাস্টমেন্ট করতে সুবিধে হবে। শুধু মায়ের কাছে বড় হলে অনেক বেশি ডিপেন্ডেড হতে পারে। মা চলে যাওয়া মানে সেপারেশন অ্যাংজ়াইটি তৈরি হবে। মায়ের ছোট হলেও কাজের জগৎ রয়েছে, ওই জায়গায় মাকে বিরক্ত করলে চলবে না, এটা বজায় রেখে বাচ্চার কাছে মাতৃত্ব শো-কেসিং করলে ভাল হয়। না হলে মা টেকেন ফর গ্রান্টেড হয়ে যান।”
গানের খাতায় ঝুল পড়ল। নাইট ডিউটি করে ভোররাতে বাড়ি ফেরা অথবা অফিস ট্যুরে বিদেশ যাওয়ায় লাল কালি। বরং সন্তানের স্কুলের হোয়াটস্অ্যাপ গ্রুপে প্রতি মুহূর্তে নজর রাখা, বড় হয়ে সন্তান পড়াশোনা করতে বিদেশ যেতে পারবে কি না, সেই টেনশনে দিন কাটানো মা কি কয়েক বছর পরে সত্যিই টেকন ফর গ্রান্টেড হয়ে যান? নিজের সত্ত্বাকে স্যাক্রিফাইস করে যিনি পুরো সময়টা দিয়ে সন্তানকে বড় করে তুললেন, তিনি কি হেরে গেলেন? শতভিষার কথায়, “না, তা-ও নয়। প্রশ্নটা সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে নয়। মায়ের ব্যক্তিসত্ত্বা নিয়ে। আমি কে? আমি একজন মানুষ। আমি অমুকের মা, অমুকের স্ত্রী, অমুকের মেয়ে। ফলস্বরূপ আমার আইডেনটিটি শুধু যদি একজন মা হিসেবে হয়ে যায়, তাহলে সন্তানটি মায়ের ব্যক্তিসত্ত্বার প্রকাশের মাধ্যম হয়ে যেতে পারে। বা সেই মা একটা সময়ের পর আইডেনটিটি ক্রাইসিসেও ভুগতে পারেন। মাথায় রাখতে হবে সব ক’টিই সম্ভবনা।”
তা হলে মায়েরা কী করবেন? কোন পথ বেছে নেবেন? সন্তানকে পুরো সময়টা দিতে না পারায় অপরাধবোধে ভুগবেন? নাকি সন্তানকে সময় দিতে গিয়ে নিজের পছন্দের কাজে আর ফেরা হল না, এই মন খারাপকে আজীবনের সঙ্গী করে নেবেন? শতভিষা জোর দিলেন ব্যালান্সের উপর। তিনি বললেন, “মা যেমনই হোন, তিনি যদি ব্যালেন্সটা ধরে রাখতে পারেন, যেখানে সন্তানকে মানুষ করার উদ্দেশ্য সন্তানকে স্বাধীন, স্বনির্ভর এবং নিজের বক্তব্য প্রকাশ করতে সক্ষম একটি মানুষ হিসেবে যদি তুলে ধরা যায়, তা হলে তিনি পেশাগত জগতে যান বা পুরো সময়টা সন্তানকে দিন—উভয় পক্ষেই সন্তান সুন্দরভাবে বড় হবে।” পায়েলের পরামর্শ, “চট করে বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ছোট-ছোট গোল সেট করে বাচ্চাকে বড় করুন। ছ’মাস দেখি, আমার সর্বক্ষণ বাচ্চার সঙ্গে থাকতে ভাল লাগছে কি না। তারপর চেষ্টা করি, ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালান্স করতে পারছি কি না। এ ভাবে এগোতে পারেন।” আবার প্রেগন্যান্সি-পর্বেই তনুশ্রী যেমন প্ল্যানিং করে ফেলেছেন। “আমি ভেবে রেখেছি, সন্তান জন্মের ছ’ মাস পর নিজেকে গ্রুম করা শুরু করব। তারপর আবার কাজে ফিরব। বাচ্চাকে সময় দিতে হবে বটেই। কিন্তু শুধুমাত্র বাচ্চাকে ঘিরে থাকা নয়। আমি অনুভব করি, আমি কাজে না ফিরলে, নিজের আমিটাকেই হারিয়ে ফেলব”, বললেন তিনি।
তবুও মেয়েদের দ্বন্দ্ব কি এতেই শেষ হবে? সমাজের প্রথাগত দাবি মেনে ‘ভাল মা’ হতে পারাটা যেন তুলনায় অনেক বেশি কৃতিত্বের। ‘ভাল’ আমি হওয়া যেন ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। মজ্জাগত এই জীবনবোধ, এই সামাজিক চাহিদা থেকে কি মেয়েরা বেরিয়ে আসতে পারবেন? উপায় বাতলে দিলেন শতভিষা। তিনি বললেন, “মহিলা হিসেবে এই দ্বন্দ্বটা থেকেই যায়। কোন সত্ত্বাটা তার নিজের পক্ষে বা সন্তানের পক্ষে ভাল হবে, সে জন্য যদি মা সন্তানকে আদর-যত্ন করার সঙ্গে সঙ্গে নিজের ব্যক্তিসত্ত্বার চর্চা কিছুদূর পর্যন্তও চালিয়ে যেতে পারেন, তা হলে বোধহয় এই দ্বন্দ্বের প্রয়োজন হয় না।” কিছুদূর বলছেন কেন? শতভিষা ব্যাখ্যা করলেন, “আমাদের সমাজে মাদার ব্লেমিংটা এত বেশি, মা নিজেও নিজেকে দোষারোপ করেন। ব্যক্তিসত্ত্বার চর্চাটা যতটা করার কথা, ততটা যদি না-ও করতে পারেন, সারাদিনে যদি পাঁচ মিনিটও নিজের জন্য বের করতে পারেন। এই পাঁচ মিনিট নিজেকে দিলেও অনেক সময় মা নিজেকে ব্লেম করেন। সেটা উপেক্ষা করেও যদি পাঁচ মিনিট বের করতে পারেন, প্রাথমিক ভাবে গিল্ট ফিলিং হলেও সেটা নিজের জন্য ভাল। সন্তানও ভাল থাকবেন। পাঁচ মিনিট নিজের জন্য বের করে গল্পের বই পড়লেও তো ক্ষতি হবে না।”
অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস