Rap Culture In Bengal : বাংলা র‍্যাপে শহর কলকাতার চেয়েও এগিয়ে মফস্বলের মানুষ, অকপট Cizzy

আমি ঠিক স্ট্রাগল বলব না। মানুষের জীবনে অনেকগুলো ধাপ থাকে। আমার ক্ষেত্রেও শুরুতে তাই-ই ছিল। আজও তা-ই আছে। আমরা বিগত দশ বছর ধরে Sunday Cypher (Cypher Project) চালিয়ে আসছি যেখানে পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত ব়্যাপারকে এনে Weekly Jamming করি।

Rap Culture In Bengal : বাংলা র‍্যাপে শহর কলকাতার চেয়েও এগিয়ে মফস্বলের মানুষ, অকপট Cizzy
Follow Us:
| Updated on: Dec 27, 2021 | 1:04 PM

“রঙিন রঙিন এই জীবন মধুর মধুর প্রতিটি ক্ষণ”

না, লেখক হিসেবে তিনি একদমই ‘মধুর’ নন। সোজা সাপটা, ক্ষুরধার ইউথের ‘সিজ়িদা’। কিন্তু মানুষ হিসেবে রৌণক চক্রবর্তী ঠিক কতটা মধুর? কথার মাঝে উঠে এল সংঘর্ষের কথা। একজন র‍্যাপার নিজের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতে ঠিক কতটা আত্মত্যাগ করতে পারেন, তারও বেশ কিছুটা নিদর্শন পেতে পারেন র‍্যাপে উৎসাহী নবাগতরা। ‘কলকাতার রাস্তা’ থেকে উঠে আসা রৌণক চক্রবর্তী আজ ভাল নেই… না, না, সাম্প্রতিক সেনসেশন ‘মানুষ ভাল নেই’ গানে অনুপম রায়ের সহ-লেখক ও সহ-গায়কের কথা বলছি। তথাকথিত অনালোচিত, মিডিয়ার দৈনন্দিন কভারেজ থেকে আপাত-দূরত্বে থাকা বাংলা র‍্যাপ সিনে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে ‘সিজ়িদা’। আর ‘সিজ়িদা’র সেই সাফল্যের জার্নিকে যেন লেভেল-ক্রসিংয়ের এ পার থেকে দেখছেন রৌণক চক্রবর্তী।

যেখানে ছিলে আর আজ যেখানে পৌঁছেছ, তফাৎটা মাপকাঠিতে বলা যায় না ঠিকই… কিন্তু এই যে একটা সংঘর্ষ, কোথাও গিয়ে কি ওটাই লেখাগুলোকে আর লেখাগুলো পক্ষান্তরে তোমায় এগিয়ে দিল অনেকটা?

– আমি ঠিক স্ট্রাগল বলব না। মানুষের জীবনে অনেকগুলো ধাপ থাকে। আমার ক্ষেত্রেও শুরুতে তাই-ই ছিল। আজও তা-ই আছে। আমরা বিগত দশ বছর ধরে Sunday Cypher (Cypher Project) চালিয়ে আসছি যেখানে পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত ব়্যাপারকে এনে Weekly Jamming করি। সেখানে বাংলাদেশের এক ব়্যাপার আসে। আর আমি তখন ‘কলকাতার রাস্তা’ গেয়েছিলাম। তারপর সেই ভিডিয়ো বাংলাদেশে আর কলকাতায় প্রথম ভাইরাল হয়। সেখান থেকে আজ এখানে অনুপমদা (অনুপম রায়), রূপঙ্করদা (রূপঙ্কর বাগচী) আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তবে এখনও অনেকগুলো ধাপ ওঠা বাকি।

অনুপমদার সঙ্গে কীভাবে এগিয়েছিল পুরো পদ্ধতিটা? আলাপের শুরুটাই বা কীভাবে?

– আমাকে অনুপমদা প্রথম ফেসবুক মেসেঞ্জারে কল করেছিল। তবে সেটা একটা অন্য প্রজেক্টের ব্যাপারে। সেখানেই অনুপমদা জানিয়েছিল যে আমার গান ওঁর পছন্দ হয়েছে। সেটা শুনে আমি খুব ওভারহোয়েল্মড হয়েছিলাম। তার প্রায় ১ মাস বা তারও কম সময়ের ব্যবধানে অনুপমদা আবার যোগাযোগ করে। জানায়, একটা গান আছে। সেখানে আমি যে ধরনের লেখা লিখি, সেই ধরনের লেখা পেলে গানটা আরও পাওয়ারফুল হবে। তারপর সেই গানের খসড়া দেখে বুঝলাম দৃষ্টিভঙ্গিতে মিলটা অবশ্যই আছে। আমি নিজেকে একজন ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট হিসেবে দেখি। তাই-ই চারিদিকে যা ঘটছে, সেগুলোই তুলে ধরতে চাই বরাবর। এই ‘মানুষ ভাল নেই’ গানটার মধ্যেও সেটাই আছে বলে আমার মনে হয়েছিল। ভাল না থাকার মধ্যেই কোনওদিন হয়তো মানুষ ভাল থাকাটা খুঁজে নিতে পারবে। অনুপমদাও বেশ কিছুটা গাইড করে দেয়।

আজকের কলকাতার ব়্যাপ সিনটা Cypher Project শুরুর সময়ের চেয়ে কতটা আলাদা?

-অনেকটাই। তবে সেটা অবশ্যই সংখ্যার দিক দিয়ে। আগে মেন ফান্ডা ছিল আমরা প্রত্যেকেই নিজেদের থেকে শিখব, জানব। আসতে-আসতে যখন সবাই জানতে পারে তখন চন্দননগর, বাগনান, মুর্শিদাবাদ সব জায়গা থেকে লোকজন আসা শুরু করে। এখন পরিস্থিতি বেশ কিছুটা উন্নত হয়েছে। এফ চ্য়ানেলে হাত ধরে আমরা একটা প্রজেক্ট করতে পেরেছি। এ ছাড়াও ‘মরা গাঙে’র একটা রিমেক করি, যেটা মাদার টেরিজা ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের থিম সং হয়েছিল। মাদার টেরিজার বাড়ির সামনে আমাদের পারফর্ম্য়ান্সের লাইভ কভারেজ করে BBC। তবে এখন আমার মনে হয় অনেক মানুষই বেশ সারফেস লেভেলে র‍্যাপের প্রতি ভালবাসা নিয়ে আসছে। আর এটার বেশিরভাগটাই দেখা যায় কলকাতায়। র‍্যাপের গভীরতার দিক দিয়ে মফস্বল অনেকটা এগিয়ে আছে।

তুমি বিভিন্ন ধরণের কাজ করেছো… ‘চেঞ্জ হবে পুরো সিন’ কিংবা ‘মিডল ক্লাস পাঁচালি’। সেগুলোর থেকে ‘মানুষ ভালো নেই’-এ ‘সিজ়িদা’ কোথায় আলাদা বলে রৌণক চক্রবর্তীর মনে হয়?

– আমি সব সময়ই বিভিন্ন রকমভাবে মানুষের কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা করি। বিভিন্ন ধরনের মানুষের কাছে পৌঁছনোর জন্য বিভিন্ন ধরনের পাথেয় দরকার। নিজেকে প্রতিদিন আরেকটু বেটার করার চেষ্টা করি। ‘মিডল ক্লাস পাঁচালি’তেও বলেছি, ‘মানিব্যাগে তাও বেঁচে আছে বঙ্গলক্ষ্মী লটারি’, কারণ ওটাই আমার আশার প্রতীক। সেই আশার হাত ধরেই আমি বলি, হ্যাঁ, ‘চেঞ্জ হবে পুরো সিন’। আমার পুরনো গানেও এই কথাটাই ফিরে এসেছে, ‘কলকাতার রাস্তা, এখানে পাবি, যা চাস, তা।’ সবই পাওয়া যাবে এখানে, যদি আশাটাকে টিকিয়ে রাখা যায়।

ব়্যাপ করার জন্য কখনও টিপ্পনি শুনতে হয়নি? উত্তরে কি আরও কিছু লাইন ছুড়ে দেওয়ার চল ছিল?

– (অল্প হেসে) না, আমি কোনওদিনই সেভাবে লাইন ছুড়ে দিইনি। এমনটা হতেই পারে, কেউ কিছু আলাদা করলে তাকে নিয়ে সবার অনেক প্রশ্ন থাকে। আর আমার আগে বাংলায় সেভাবে বাংলা র‍্যাপ কেউ শুরু করেনি। আর সত্যি বলতে, আমি শুরু না করলে আমায় কেউ এসে যদি বলত কেউ একজন বাংলা র‍্যাপ করছে, আমারও অদ্ভুত লাগত। তাই সমালোচনাকে আমি পজিটিভলি নিয়েছি। যাতে সেই সীমাটা পেরিয়ে তাঁদেরকেও ভাল লাগাতে পারি।

বাংলা ব়্যাপ সিন বলো বা ব়্যাপ কালচার, কী মনে হয়? ভবিষ্যৎটা কোথায় দাঁড়িয়ে?

– ভবিষ্যতটা দাঁড়িয়ে আছে একটা ভাবনার ওপর। খিদেটা সবার মনের মধ্যে থাকাটা দরকার বলে আমার মনে হয়। আমার এখন যেটা মনে হয়, এই পশ্চিমবঙ্গের একটা নিজস্ব সাউন্ড, একটা আইডেন্টিটি তৈরি করা দরকার মিউজ়িকের ক্ষেত্রে। আমরা সবাই জানি, কলকাতার সঙ্গে মিউজ়িকে প্রায় সমার্থক। আমরা এখনও পুরনোটা আঁকড়ে বাঁচতে চাই। তবে পুরনোকে আঁকড়ে রেখেও নতুন একটা সাউন্ড খুঁজে পাওয়া যায়। আর সেটা খুব জরুরি বলে আমার মনে হয়।

একটা কথা তুমি প্রায়ই বলে থাকো, গল্পটা জানা খুব জরুরি। সেক্ষেত্রে, তোমার গল্পে তুমি তোমার পাশাপাশি বাকিদের থেকে সফল কোথায়? মানে, বাকিদের গল্পে খামতি থাকছে কোথাও?

– আমি মনে করি যদি উচ্চ ক্ষমতা না-ও থেকে থাকে, একটা বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে অনেককিছু করা যায়। ডেডিকেশন থাকলে তার ফলস্বরূপ কিছু না কিছু পাওয়া যায়ই যায়। হাল ছাড়লে চলবে না। আমি এই নিয়ে এখন ৬ নম্বর চাকরি করি। অনেকবার চাকরি জয়েন করেছি, আবার ছেড়ে দিয়েছি যখন খানিকটা টাকা জমিয়ে নিয়েছি। আসলে স্বপ্নটা জিইয়ে রাখাটা খুব দরকারি। (অল্প হেসে) এই জন্যেই একটা গানের লাইনে লিখেছিলাম, ‘ভেঙে পড়ছিস কেন ভাই? ফ্লাইওভার নাকি?’

মফস্বল আর শহর, সংঘর্ষের তুল্যমূল্যতেই কি ব়্য়াপের সাফল্য?

– আসলে আমার মনে হয় শহরের মানুষ একটু বেশি কনফিউজ়ড তাঁদের দাবি নিয়ে। কারণ খুব সহজেই অভিভূত হয়ে যাওয়ার মতো চাকচিক্য শহরে আছে। যেখানে এই ব্যাপারটা মফস্বলে বা গ্রামাঞ্চলে থাকলেও সেটা ছুঁয়ে দেখাটা হয়ে ওঠে না। আর তা-ই, খিদেটা বাড়তে থাকে। আর সেখানেই গল্পের সাফল্য। শহরে ‘যা চাই, তাই-ই পাই’ ব্যাপারটার জন্যই আর কী চাই সেই ভাবনাতে কনফিউশন এসে যায়। সবার ক্ষেত্রে না হলেও আমি অন্তত র‍্যাপ সিনে এটা দেখেছি। কীভাবে বলব আমার কথা—সেই জায়গাটায় মফস্বলের কিছু মানুষ শহরের চেয়ে অনেকখানি এগিয়ে।

তোমাদের নতুন চেষ্টা The Bridge…পরিকল্পনা কী? কতটা সাফল্য আসতে পারে বলে মনে করছো?

– এখনই কিছু বলা খুব কঠিন। তবে কলকাতায় এর আগে এরকম পডকাস্ট হয়নি। এটা হওয়াটা খুব জরুরি ছিল। আমার মনে হয়, এই মুহূর্তে না হলেও, আসতে-আসতে মানুষের এটা ভাল লাগবে। অনেকেই মনে করে র‍্যাপ ব্যাপারটা বিলিতি। আমরা সেই ভাবধারায় বদল আনতে চাই। ডিজে প্রিমিয়ার-এর কথায়, হিপহপের একটা আলাদা সাউন্ড হয় যা সাধারণ মানুষের জন্য নয়। এটা নিজের মধ্যেই একটা সমাজ, সংস্কৃতি গড়ে তোলে। এই যে আমরা সুর ছাড়া এত কথা বলে যাচ্ছি খুব জোরে, এটা সবার শ্রুতিমধুর লাগবে না। কিন্তু একবার এই বাউন্ডারিটা টপকে গেলে, একবার মানুষের ভাল লাগলে, এই সাউন্ডটা মানুষকে অনেককিছু দিতে পারবে বলে আমি মনে করি।

তোমার নিজস্ব কোনও উদ্যোগ এই ব়্য়াপ সিনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টায়? নতুনদের জন্য কিছু টিপস?

– এরকম একটা বিপ্লব একা আনা সম্ভব নয়। বাংলা রক ব্যান্ডের ক্ষেত্রেও সবাই দল বেঁধে একসঙ্গে আসার পরই ব্যাপারটা এগিয়েছিল। র‍্যাপের ক্ষেত্রেও আমার তাই-ই মনে হয়। যারা নতুন আসছে, তারা যদি নতুনত্ব কিছু নিয়ে আসতে পারে, তাহলে তাঁদের সাহায্যের চেষ্টা আমি বরাবর করেছি, আগামিতেও করব। আমি অনেক মানুষকেই স্টুডিওতে এনে রেকর্ডিং, মিক্সিং, মাস্টারিং করিয়েছি। এখন যেমন Bridge-এর মধ্যে দিয়ে অনেক নতুন র‍্যাপারের কাছাকাছি আসতে পারছি। এই সবকিছুর মধ্যে দিয়েই আমি চেয়েছি লড়াইটা যেন একার না হয়। আমার ডাক শুনে কেউ না এলেও, আমি একলা চলব না, সবাইকে নিয়েই চলব।

গ্র্যাফিক্স ও অলংকরণ- অভীক দেবনাথ