মহালয়ার অপেক্ষায় ‘রেডিয়োর বৃদ্ধাশ্রমে’ একলা কারিগর অমিত রঞ্জন কর্মকার

অনেক দিন আগে এলোমেলো ইথার তরঙ্গগুলোকে ঠিকঠাক করার খেলাটা রীতিমত মারধর খেয়ে রপ্ত করেছিলেন গুরু নরেশ সিকদারের কাছ থেকে। আর তারপর খেলার মাঠ তাঁকে দিয়েছে পেটের অন্ন, মুখের ভাত।

মহালয়ার অপেক্ষায় 'রেডিয়োর বৃদ্ধাশ্রমে' একলা কারিগর অমিত রঞ্জন কর্মকার
একা-একান্তে
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Aug 06, 2021 | 7:35 AM

নন্দন পাল: কুমোরটুলির বনমালি সরকার স্ট্রিটে রেডিয়োর দোকান বললে এক ডাকে যে কেউ দেখিয়ে দেবে ৮ ফুট বাই ৪ ফুটের একটা দোকান। এখানেই বিগত ৪৫ বছর ধরে বিভিন্ন মডেলের রেডিয়ো সারিয়ে আসছেন অমিত রঞ্জন কর্মকার। প্রতিমা শিল্পী রাখাল পালের ষ্টুডিও পার করে পথটা যেই বাঁ দিকে বেঁকেছে, সেখানেই মৃৎশিল্পী সমন্বয় কমিটির অফিস। আর ওই রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়ালেই কানে ভেসে আসবে ইথার তরঙ্গের এলোমেলো শব্দ। আর পাঁচটা মানুষ যেভাবে অলঙ্কার নিয়ে অহংকার করেন, অমিতের কাছে তেমনই বেতার ট্রানজিস্টারগুলো। ১৯৪৪-এ হল্যান্ডে তৈরি ফিলিপস কিংবা ১৯৫৪-র ইংল্যান্ডের ন্যাশনাল ইকো বা হিজ মাস্টার ভয়েস (HMV) লন্ডনের রেকর্ড প্লেয়ার বা ১৯৬৪-র জিইসি র ডিসি কারেন্টে চলা সেটগুলো আজ না চললেও তারা খুবই যত্নে থাকে বনমালি সরকার স্ট্রিটের দোকানটায়। অনেকেই সরাই করতে দিয়ে আর ফেরত নিয়ে যায়নি পুরানো রেডিয়ো। সেগুলোকে আগলে রেখে সংরক্ষণ করেছেন অমিত রঞ্জন কর্মকার।

খেলার মাঠের নেশা আর অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর খবরের টানে রেডিয়োর প্রতি অমোঘ আকর্ষণ গড়ে ওঠে তরুণ অমিতের। সেই সময়ে আকাশবাণীর সংবাদ বিভাগ আলো করে ছিলেন নীলিমা সান্যাল, ইভা নাগ, অনিল মুখোপাধ্যায়, প্রশান্ত মুখোপাধ্যায়রা। অতীত ওই সময়ের কথা মনে করে মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েন অমিত রঞ্জন কর্মকার। গড়গড় করে বলে চলেন তার পরবর্তী প্রজন্মের সংবাদ পাঠক দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, তরুণ চক্রবর্তী, বরুন দাসদের কথা। বাংলাদশের মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযুদ্ধের কণ্ঠ সৈনিক দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মশ্রী’ খেতাব পাওয়ার কথা স্মরণ করে চকচক করে ওঠে অমিত রঞ্জন কর্মকারের দু’টো চোখ। অতীত দিনের রেডিয়ো সেটগুলো একা সাক্ষী হয়ে থাকে এই সংলাপের।

বনমালি সরকার স্ট্রিটের সেই দোকানে…

অনেক দিন আগে এলোমেলো ইথার তরঙ্গগুলোকে ঠিকঠাক করার খেলাটা রীতিমত মারধর খেয়ে রপ্ত করেছিলেন গুরু নরেশ সিকদারের কাছ থেকে। আর তারপর খেলার মাঠ তাঁকে দিয়েছে পেটের অন্ন, মুখের ভাত। কুমোরটুলির মূর্তির কারিগরেরা খেলার ধারা-বিবরণী শুনতেন। আর সেই সব রেডিয়ো সেটগুলো সারাতেন অমিত রঞ্জন। মোহনবাগান ,ইস্টবেঙ্গল, উয়ারী, কুমোরটুলি পোর্ট-এর খেলা থাকলে তার আগে রেডিয়ো সারানোর ভিড় বাড়ত। কলকাতা ময়দানে তখন খেলা হত। তাই-ই রেডিয়োতে ধারা-বিবরণীও হত। ছিল বহু টুর্নামেন্ট যা আজ কালের নিয়মে বন্ধ। এখন শুধু এক গ্যালারি-শূন্যতা নিয়ে পড়ে আছে ফাঁকা ময়দান।

কুমোরটুলির মৃৎশিল্পী, হোসিয়ারি কারখানা আর প্লাস্টিক কারখানার শ্রমিকেরা কাজ করতে-করতেই রেডিয়োর বিভিন্ন অনুষ্ঠানের গান শুনতেন। ‘অনুরোধের আসর’, ‘জয়মালা’, ‘আপকে ফরমায়েশ’, ‘মন চাহে গীত’, ‘হাওয়া মহল’, ‘বিনাকা গীতমালা’,’মনোরঞ্জন’-এর দিন এখন অতীত। এখন স্তব্ধ হয়ে থাকা রেডিয়ো সেটগুলো নাড়াচাড়া করেন, ঝাড়পোঁছ করেন অমিত আর ভাবেন পরবর্তী প্রজন্মের কেউ আর আসবে না এই পেশায়। আক্ষেপের সুরে দৃঢ় প্রত্যয়ে বলেন, “চাকরি করবে, হাজারো একটা কাজ করবে, মুদিখানার দোকান করবে। কিন্তু এই পেশায় আসবে না।”

স্তব্ধ হয়ে থাকা রেডিয়ো সেটগুলো নাড়াচাড়া করেন, ঝাড়পোঁছ করেন অমিত

তবু এখনও বর্ষা শেষে মন নেচে ওঠে অমিত রঞ্জনের। বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপুজোর কার্টেন রেইজার – ‘মহালয়া’ এলেই কাজ বাড়ে তাঁর। বাঙালি সব ভুলে মহালয়ার ভোর ৪টেয় খুলবেই আকাশবাণীর কলকাতা কেন্দ্র। আর তার জন্য পুরোনো রেডিয়ো ট্রানজিস্টারটাকে সারাতে আসবে অমিত রঞ্জন কর্মকারের কাছে। এই অতিমারি অবহেও বদলায়নি সেই অভ্যাস। তাই এখন একমাস আগে থেকেই প্রস্তুত অমিত। গর্বের সঙ্গে বলেন প্রবীণ কারিগর ১৯৮২-র মহালয়ার সময়ে রোজগার করেছিলেন ৭৩৩০ টাকা। যা আজও তাঁর ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ইনকাম। অনেক সময়ে মহালয়ার আগে কাজের চাপে রাত্রে বাড়ি ফেরাও হয়নি তাঁর। রাস্তার ঘুগনি পাউরুটি আর চা দিয়েই নৈশভোজ হয়েছে।

এভাবেই রেডিয়োর নেশা ছেড়ে, এই দোকানটাকে ছেড়ে বেরোতে পারেননি। সুযোগ এসেছিল একবার ভারতীয় নৌবাহিনীতে চাকরির, বাড়ির আপত্তি সত্ত্বেও ট্রেনিং করেছিলেন। কিন্তু সপ্তম লোকসভা নির্বাচনের জন্য বাতিল হয়ে যায় নিয়োগ প্রক্রিয়া। সেই আক্ষেপ ভুলিয়ে দেয় এই রেডিয়ো সেটগুলো। এদের নিয়েই মেতে থাকেন। মনে পড়ে কলকাতায় পেলে ম্যাচের সময়ে ফিলিপসের বিশেষ রেডিয়ো সেট ‘স্কিপার’-এর কথা। বোঝাতে থাকেন তার বিশেষত্ত্ব। স্কিপারে নাকি দেওয়া ছিল এফএম বা ফ্রিকুয়েন্সি মডিউলেশন প্রযুক্তি সেই ১৯৭৭-এ। দেশীয় এফএম চ্যানেল তখন ছিল না। তাই-ই দূরদর্শনের খবর শোনা যেত স্কিপারের ট্রানজিস্টার সেটে।

অতীত আজ প্রায় বিস্মৃত।

রেডিয়োর কারিগরি খুঁটিনাটি আর কলকব্জা নিয়েই এই কুমোরটুলিতে কেটে গেল একটা জীবন। মাটি, রঙ আর শিল্পীদের হাতের ছোঁয়ায় মৃন্ময়ী, চিন্ময়ী হন এই পাড়ায়। কারিগরি শিল্পের দেবতা ‘বিশ্বকর্মা’ আর ‘কর্মকার’ শব্দ দুটো তো সমার্থক? তাই না? অমিত রঞ্জন কর্মকারের মন জুড়ে থাকা ইথার তরঙ্গের ট্রানজিস্টারগুলো থেকে এলোমেলো শব্দ ভেসে আসে। সে শব্দ দিক নির্দেশ করে এক গৌরবমাখা অতীতের দিকে। যে অতীত আজ প্রায় বিস্মৃত।