পায়ে চোট দেবের, পর্দার ‘দাদু’কে দেখতে শুটিং সেটে নাতি
সাল ২০২০। মাস ডিসেম্বর। হঠাৎ করেই বজবজের সন্তোষপুরের আক্রা পিছিয়ে গেল প্রায় দুই শতক। গোটা মাঠ জুড়ে টাঙানো হল তাঁবু। সোনালি চুল, আর ধবধবে রঙের বিদেশি খেলোয়াড়রা প্রস্তুতি শুরু করলেন জোর কদমে। কাঁচা হাতের সেলাই করা, দড়ি বাঁধা চামড়ার ফুটবলে দিলেন ‘কিক’। অন্য দিকে, ভারতীয় ফুটবলের জনক নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারীও ছড়ে যাওয়া পা এবং ফেটে যাওয়া […]
সাল ২০২০। মাস ডিসেম্বর। হঠাৎ করেই বজবজের সন্তোষপুরের আক্রা পিছিয়ে গেল প্রায় দুই শতক। গোটা মাঠ জুড়ে টাঙানো হল তাঁবু। সোনালি চুল, আর ধবধবে রঙের বিদেশি খেলোয়াড়রা প্রস্তুতি শুরু করলেন জোর কদমে। কাঁচা হাতের সেলাই করা, দড়ি বাঁধা চামড়ার ফুটবলে দিলেন ‘কিক’। অন্য দিকে, ভারতীয় ফুটবলের জনক নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারীও ছড়ে যাওয়া পা এবং ফেটে যাওয়া নখ নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে প্রস্তুত হলেন বিদেশীদের বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে। না, টাইমমেশিন নয়, সত্যি ঘটনা। ভরা শীতে এক টুকরো ইতিহাস যেন এ ভাবেই ঝলসে উঠল পরিচালক ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত ‘গোলন্দাজ’ ছবির শেষ কয়েকদিনের শুটিংয়ে। সাক্ষী থাকলেন, নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারীর নাতি ময়ুখ রঞ্জন সর্বাধিকারী। খুঁটিয়ে দেখলেন শুটিংয়ের খুঁটিনাটি। প্রশংসায় ফেটে পড়লেন নগেন্দ্রপ্রসাদের বেশে দেবকে দেখে। আর কী-কী হল সেখানে? হদিশ দিল TV9 Bangla বাংলা।
ছড়ে যাওয়া হাত-পা আর দেব
পর্দার নগেন্দ্রপ্রসাদ তিনিই। ফাঙ্কি জ্যাকেট আর নিওন বুট নয়। এ ছবিতে দেবের খালি পা, চোখের নীচে কালি আর অক্লান্ত পরিশ্রম। পরিচালকের কথাতেই জানা গেল, শুট করতে গিয়ে উপড়ে গিয়েছে তাঁর পায়ের নখ, উঠে গিয়েছে পায়ের চামড়া। ঘাড়ে লেগেছে চোট। ডাক্তার লিখে দিয়েছিলেন দশ দিনের টানা বিশ্রাম। দেব শোনেননি। খাটো ধুতি আর একগাল হাসি নিয়ে পৌঁছে গিয়েছেন সেটে। দেবের ডেডিকেশনে আপ্লুত ধ্রুব। সবটা দেখে অবাক ময়ুখবাবুও। “অদ্ভুত সুন্দর”, মুখ থেকে বেরিয়ে এল তাঁর।
সেলাই করা ফুটবল আর নস্টালজিয়া
ময়ুখবাবুকে সেট ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন পরিচালক। ‘গোলন্দাজ’-এর প্রত্যেক সদস্য কীভাবে ডিটেলিংয়ে নজর দিয়েছেন, সে কথাই শোনাচ্ছিলেন তিনি। হালফিলের দুধসাদা ব্র্যান্ডেড বল নয়। দুই শতক আগে অনভ্যস্ত হাতে সেলাই করা কাপড়ের বলেই যে ঝড় তুলেছিলেন নগেন্দ্রপ্রসাদেরা, তাই-ই হাতে-কলমে ময়ুখবাবুকে দেখাচ্ছিলেন পরিচালক।
‘শুধু ফুটবল নয়, ক্রিকেটেও তিনি সেরা’
করোনা এবং লকডাউন মাঝে কেড়ে নিয়েছিল বেশ কয়েকটি মাস। ‘গোলন্দাজ’ শুরু হয়েও থমকে গিয়েছিল হঠাৎই। শুটিংয়ের শেষ কয়েকদিনে দেব আবেগপ্রবণ। স্বীকার করে নিলেন নগেন্দ্রপ্রসাদের কথা আগে শুনলেও তাঁর জীবনের এত মহত্ত্ব, ব্যাপ্তি তা আগে জানা ছিল না তাঁর। দেবের কথায়, “শুধু ফুটবলই নয়, তিনি ক্রিকেটও খেলতেন বেশ ভাল।”
পরিচালকের সঙ্গে নগেন্দ্রপ্রসাদের নাতি
কস্টিউমের কারসাজি
কস্টিউম? তাতেও একগুচ্ছ চলন্ত ইতিহাস। রীতিমতো গবেষণা করে বানান হয়েছে সে সময়ের আঙ্গিকে জুতো, মোজা। জামার নট থেকে প্যান্টের নট, তাতে সেলাই কী হবে, কোন খেলোয়াড়কে কীভাবে সাজানো হবে, প্রত্যেক খুঁটিনাটিতে কড়া নজর রেখেছেন তাঁরা। বিদেশি খেলোয়াড়দের পোশাকে আলাদা নজর। তাঁদের দিয়ে প্র্যাকটিস করানো… কীভাবে সামলালেন সবটা? পরিচালকের ছোট্ট উত্তর, “রিসার্চ।”
বড়লাটের তাঁবু এবং ট্রেডস কাপ
দূরে জ্বলজ্বল করছে ‘ট্রেডস কাপ’-এর রেপ্লিকা। সেই ট্রেডস কাপ যা দুই শতক আগে ব্রিটিশ অহংকার চূর্ণ করেছিল রাতারাতি। ফুটবলের জনক ছিনিয়ে নিয়েছিলেন সেই কাপ। আরও একবার সেই স্মৃতি, সেই অহংকার ফিরে এল ‘গোলন্দাজ’-এর সেটে। পাশেই রয়েছে বড়লাটের তাঁবু। মাঠের চারপাশে লাগানো হয়েছে সে সময়কার ক্লাবগুলির পতাকা। কাঁচা হাতের কাজ নয়, একেবারে খাঁটি রিসার্চ।
ইন্দ্রাশিসের ইন্দ্রজাল
এ ছবিতে এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করছেন ইন্দ্রাশিস রায়। ছবির মূল কাস্টিং হওয়ার পর ডাক পড়েছিল তাঁর। “প্রথমদিকে লেফট আউট ফিল হচ্ছিল। ছোট থেকে ফুটবল খেলেছি। তার পর যখন সুযোগ এল তখন সত্যিই আলাদা একটা অনুভূতি,” বললেন তিনি।
গর্বিত পরিবার
কাজ দেখে আপ্লুত নগেন্দ্রপ্রসাদের পরিবার। ধ্রুব জানালেন, জীবনী নয়, সে সময়কার সত্যি ঘটনাগুলোকে আর এক হার না-মানা মানুষের জীবনীকে এক পঙতিতে বসিয়ে খানিক কল্পনার উপর ভর করে গল্প বলতে চেয়েছেন তিনি। সবটা দেখে খুশি ময়ুখরঞ্জন। বললেন, “এগিয়ে যান, আজকে তো আমরা দেখেই গেলাম। আরও এগিয়ে যান।” একগাল হেসে হাত মেলালেন ধ্রুব। তাঁর চোখে-মুখে তখন তৃপ্তির আভাস।