Exclusive: এক অভিশপ্ত রবিবার ও সব্যসাচী, এক বছর পর কেমন আছেন ঐন্দ্রিলার ভালবাসা?

Aindrila Sharma: হেমন্তের শিউলির গন্ধ আর হলুদ-তেল মাখা সকালে যখন চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলেন আপনি, রবিবারে দুপুরে জমিয়ে মাংস-ভাত খেয়ে ঘুমনোর চেষ্টা জারি রেখেছিলেন ঠিক তখনই এক বেসরকারি হাসপাতালে বছর ২৪-এর ঐন্দ্রিলা শর্মা বারবার সেরিব্র্যাল অ্যাটাককে রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, ঠিক এক বছর আগে। দুপুর বেলা খবরটা এসেছিল। না, তিনি নেই। সারা বাংলা চোখের জল ফেলেছিল।

Exclusive: এক অভিশপ্ত রবিবার ও সব্যসাচী, এক বছর পর কেমন আছেন ঐন্দ্রিলার ভালবাসা?
প্রিয়তমা আমার....
Follow Us:
| Updated on: Nov 20, 2023 | 3:33 PM

বিহঙ্গী বিশ্বাস 

“প্রিয়তমা আমার,  তোমার শেষ চিঠিতে তুমি লিখেছ; মাথা আমার ব্যথায় টন্ টন্ করছে… দিশেহারা আমার হৃদয়… বিংশ শতাব্দীতে মানুষের শোকের আয়ু নাকি বড় জোর এক বছর…?” নাজিম হিকমতের সেই অমোঘ পংক্তি নাকি রবিঠাকুরের কালজয়ী লাইন: ‘আমাদের গেছে যে দিন একেবারেই কি গেছে?’ এই প্রশ্নটা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতেই জিজ্ঞাসু মনের স্বাভাবিক রিফ্লেক্সে আঙুল ডায়েল করল এক চেনা নম্বর। নম্বরটি সব্যসাচী চৌধুরীর। আমজনতার কাছে যিনি এই বছর খানেক আগেও আখ্যা পেয়েছিলেন, ‘আদর্শ প্রেমিক’-এর। প্রেমিকার শেষযাত্রায় তাঁর পা জড়িয়ে তীব্র আশ্লেষে প্রগাঢ় চুম্বন দেখে দ্রব হয়েছিল মন, চোখ ভিজেছিলেন অজান্তেই। মনের কোন অজানা কোণে নিঃশব্দে কবি বলে উঠেছিলেন, “যা কিছু বলেছি আমি মধুর অস্ফুটে/ অস্থির অবগাহনে তোমারি আলোকে/ দিয়েছ উত্তর তার নব-পত্রপুটে/ বুদ্ধের মূর্তির মতো শান্ত দুই চোখে।”

হেমন্তের শিউলির গন্ধ আর হলুদ-তেল মাখা সকালে যখন চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলেন আপনি, রবিবারে দুপুরে জমিয়ে মাংস-ভাত খেয়ে ঘুমনোর চেষ্টা জারি রেখেছিলেন ঠিক তখনই এক বেসরকারি হাসপাতালে বছর ২৪-এর ঐন্দ্রিলা শর্মা বারবার সেরিব্র্যাল অ্যাটাককে রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, ঠিক এক বছর আগে। দুপুর বেলা খবরটা এসেছিল। না, তিনি নেই। সারা বাংলা চোখের জল ফেলেছিল। সারা ভারতে সেদিন টুইটারে (বর্তমানে এক্স) ওই নামটিই ট্রেন্ড করেছিল। আর শঙ্খলাগা সাপের মতো যে নামটি ফিরে-ফিরে এসেছিল, তিনি সব্যসাচী, যার দুই হাত নাকি সমান ভাবে কাজে পারদর্শী। আর মন? সেই মনের হদিশ নিতেই ওপার থেকে ভেসে এসেছিল এক অপার্থিব নৈঃশব্দ্য ।

“আমার যে কিছুই বলার নেই,” এটুকু বলে প্রথমবারের মতো শেষ করে কিছুক্ষণ পরে নিজেই ফোন করলেন। শান্ত স্বর, উচ্চকিত নৈঃশব্দ্য। আর এর পরেই প্রতিবেদকের উদ্দেশে ফোনের ওপার থেকে তাঁর প্রশ্ন, “বলুন, কী জানতে চান?” পৌষ শেষের পর্ণমোচী নাকি ফাল্গুনের শুরুতে ক্ষতে মলম লাগানো কচিপাতা, এ হিসেব করতে করতেই ‘কেমন আছেন’ প্রশ্ন, প্রতিবেদকের। আবারও সেই স্বর। “ভাল আছি। শুটিং করছি। রোজই যেতে হয়। ধারাবাহিকের চাপ থাকে তো।” ঐন্দ্রিলা চলে যেতেই গুটিয়ে নিয়েছিলেন নিজেকে। বা বলা ভাল, অন্তর্মুখী স্বভাবের যে ছেলেটা ঝর্ণার কাছে দাঁড়িয়ে খোলস খুলতে শুরু করেছিল সদ্য, ঝর্ণার আচমকাই মৃত্যুতে সে আবারও ফিরে গিয়েছে পরিণত ‘তাঁর’ সেই চেনা খোলসে। বললেন, “অনেকেই প্রশ্ন করেন আজকাল, সামাজিক মাধ্যমে ফিরি না কেন? আমার কি কিছুই বলার নেই? আমি প্রয়োজন বোধ করি না। এরকমটাই ছিলাম আজীবন। নিজে কোনওদিনও পিআর রেখে ফেসবুক-ইনস্টা করিনি। ও (ঐন্দ্রিলা শর্মা) জোর করত। লেখালিখি শুরু করেছিলাম। আর তো এ সবের প্রয়োজন দেখি না।”

কণ্ঠস্বরে নেই কোনও অভিযোগ। আর্দ্র অভিমান? অনুসন্ধিৎসু সাংবাদিকের মনের গভীরে ঘুরপাক খায় প্রশ্ন: তবে কি বিংশ শতাব্দীতে (পড়ুন একবিংশ) শোকের আয়ু সত্যিই এক বছর নয়? বেশি? অ-নে-এ-এ-এ-এ-এ-ক বেশি… আজীবন… ‘আজীবন ভালাবাসা ছাড়া’ আর কী-ই বা চাইতে পারেন এহেন প্রেমিক, যাঁকে প্রতি মুহূর্তে নিজেকে বিশ্বাস করাতে হয় ‘ভালবাসা ছাড়া’ (পড়ুন ঐন্দ্রিলাকে ছাড়া)-ই থাকতে হবে? নাকি… দপ করে জ্বলে উঠেই চুপ করে গেলেন? তারপর বললেন, “কে বলেছে এসব কথা? কোন লেখক বলেছেন আমি ঠিক জানি না। শুধু জানি, সত্যিটা কে মেনে নিতে হয় এক পর্যায়ে গিয়ে। প্রত্যেকেই নিজের মতো করে মানিয়ে নেন। চেষ্টা করেন। আমিও করছি। আমি ইন্ট্রোভার্ট বরাবরই। তাই অনেকেই হয়তো আমার থাকা, আমার যাপন নিয়ে নিজেদের মতো ভেবে নেন। সেটার উপর আমার নিয়ন্ত্রণ নেই। যা ঘটেছে, যা হয়েছে… একটা পর্যায়ের পর সেটাকে সত্যি বলে মেনে নেওয়া ছাড়া আমার কী করণীয় আর?” প্রশান্তির ঘেরাটোপে বসে এই সব্য আরও শান্ত, ধীর, অপ্রগলভ।

কথায়-কথায় উঠল তাঁর সাধের রেস্তোরাঁর কথা। গত বছরই অভিনেতা সৌরভ দাসের সঙ্গে যে রেস্তোরাঁ খুলেছিলেন সব্যসাচী। প্রথম দিনে ঐন্দ্রিলাকে জড়িয়ে দিয়েছিলেন এক ছবিও। যাওয়া হয় সেখানে? এবারও সেই ছোট্ট উত্তর, “খুব যে যাওয়া হয়, তা নয়। শুটিং থাকে। কাজ থাকে। মাঝেমধ্যে যাই। আগের মতো হয়ে গিয়েছি। আসলে আমি কে, মানুষটা আদপে কেমন, তা কেউ জানত না। আমি কিন্তু বরাবরই চুপচাপই ছিলাম। বাইরে থেকে পড়েছি। এখানে এসে সিনেমা-সিরিয়াল। ওর সঙ্গে আলাপ। তারপর ওই যেটুকু যা রিলস… আমি কিন্তু নিজে কোনওদিনও…” চুপ করলেন আবারও। ফের বললেন, “ওটা ওই ও দেখত। এখন এ সবের আর দরকার নেই। ঠিক আছে সব। চলছে…।” মিষ্টি (ঐন্দ্রিলার ডাকনাম—’আদরের ডাকনাম’) নেই, তবে তাঁর পরিবারকে আজও আগলে রাখেন সব্যসাচী। সপ্তাহ দুয়েক আগেই ঐন্দ্রিলার মায়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে। কথা হয়েছে। মা ভাল আছেন… সে কথা জানাতেও ভুললেন না তিনি। স্টুডিয়োয় ছিলেন। শটে যাওয়ার ডাক এল। ‘এখন রাখছি’ বলে কাজে ফিরলেন তিনি… আসলে বেদনা তো একটা সময়ের পর বৈরাগ্য এনে দেয়—আর বৈরাগ্য করে তোলে স্থিতধী। ভালবাসার চেয়ে বড় সাধনা আর কী-ই বা থাকতে এই প্রেমিকের? তবু বৈরাগীকেও পালন করে যেতে হয় দায়িত্ব… পেশাদারিত্বের সঙ্গে সন্ন্যাসের যে ঘোর বিরোধ—’দ্বন্দ্ব অহর্নিশ’।

ঐন্দ্রিলার মৃত্যু হয়েছিল, শেষবেলার বিদায়ে প্রেমিকাকে প্রণাম করার সময় বিড়বিড় করে কিছু বলেছিলেন সব্যসাচী। জন্মান্তরে বিশ্বাস নাকি অব্যক্ত অনুভূতি উজাড় করে দিয়েছিলেন ওই কয়েক মুহূর্তে? আপাত শান্ত মানুষটার মনের উথালপাথাল আছড়ে পড়েছিল ওই পা দু’টোয়। আড়াল থেকে নিঃসঙ্গ চিল-হৃদয়ও কি বলে উঠেছিল, “এত দূরে আছে তাঁর প্রাণের দোসর/ কখন বা তার চেয়ে ভাগ্য নির্দয়/ প্রণয়ী মিলিল যদি অতি-অসময়/ ‘হৃদয়টি?’ ‘দিয়াছি তো’… কাঁদিয়া সে কহে…/ ‘হাতখানি প্রিয়তম’? ‘নহে নহে নহে…”।