Sign In

By signing in or creating an account, you agree with Associated Broadcasting Company's Terms & Conditions and Privacy Policy.

Explained: কী রোগে আক্রান্ত অস্মিকা? কেন ওষুধের দাম ১৬ কোটি? সারলে ‘স্টিফেন হকিং’ হতে পারে ছোট্ট মেয়েটি

Explained: কী এই স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যট্রফ্রি বা এসএমএ টাইপ-১? কী ভাবে শরীরে বাসা বাঁধে এই রোগ? এর প্রভাবে কত দূর? এই সব রোগের চিকিৎসায় এত খরচ বা কেন হয়? এই সব প্রশ্নের উত্তর পেতেই টিভি৯ বাংলা যোগাযোগ করেছিল শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সংযুক্তা দে-এর সঙ্গে, কী বললেন তিনি?

Explained: কী রোগে আক্রান্ত অস্মিকা? কেন ওষুধের দাম ১৬ কোটি? সারলে 'স্টিফেন হকিং' হতে পারে ছোট্ট মেয়েটি
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Jan 20, 2025 | 10:15 AM

মাত্র এক বছর বয়স অস্মিকার। ১০ দিন আগেই ছিল জন্মদিন। সাধারণত এই বয়সে মেয়ে বাবা আগে বলবে না মা আগে বলবে তা নিয়ে চলে কপট রাগারাগি। কিন্তু অস্মিকার বাবা-মায়ের জন্য বিষয়টা তেমন না। ফুটফুটে ছোট্ট মেয়েটা কোনও দিন হাঁটতে-চলতে পারবে কি না, বাঁচবে কি না সেই ভাবনাই কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে তাঁদের। কারণ অত্যন্ত বিরল রোগে আক্রান্ত তাঁদের ছোট্ট অস্মিকা। যার নাম স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যট্রফ্রি টাইপ-১। এই রোগের কবল থেকে মেয়েকে সুস্থ করে তুলতে হলে তাঁকে দিতে হবে একটা ইনজেকশন। যার দাম ১৬ কোটি টাকা! অস্মিকার বাবা-মা তো বটেই, যে কোনও মধ্যবিত্ত পরিবারের কাছেই এই টাকা জোগাড় করা প্রায় অসাধ্য।

বাধ্য হয়েই মেয়ের জীবনের জন্য জনসাধারণের কাছে হাত পেতেছেন বাবা-মা। তাঁদের ডাকে সারা দিয়ে এগিয়েও এসেছেন অনেকে। গায়ক কৈলাস খের, রূপম ইসলাম সহ আরও অনেকে। সকলের সাহায্যে এখনও অবধি জোগাড় হয়েছে প্রায় ৫ কোটি টাকা মতো। এখনও অনেকটাই পথ চলা বাকি, চাই আরও প্রায় ১১ কোটি টাকা। কিন্তু সময় যে ফুরিয়ে আসছে। চিকিৎসকেরা বলেছেন আর ৫-৬ মাসের মধ্যেই অস্মিকাকে দিতে হবে এই ইনজেকশন।

কী এই স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যট্রফ্রি বা এসএমএ টাইপ-১? কী ভাবে শরীরে বাসা বাঁধে এই রোগ? এর প্রভাবে কত দূর? এই সব রোগের চিকিৎসায় এত খরচই বা কেন হয়? এই সব প্রশ্নের উত্তর পেতেই টিভি৯ বাংলা যোগাযোগ করেছিল শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সংযুক্তা দে-এর সঙ্গে, কী বললেন তিনি?

স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যট্রফ্রি বা এসএমএ আসলে কী?

শরীরে সারভাইভাল মোটর নিউরন বা এসএমএন প্রোটিনের অভাব হলে কোনও ব্যাক্তি স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যট্রফ্রি বা এসএমএ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন।

বাস্তবে এটা এক ধরনের নিউরো-মাসকুলার ডিসঅর্ডার বা স্নায়ু-পেশীর রোগ। তবে মাথায় রাখবেন, নিউরো মানেই তা যে মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলবে বিষয়টা এমন মোটেই নয়। বরং দেখা গিয়েছে এই রোগে আক্রান্তদের বুদ্ধিমত্তা অন্যদের থেকে অনেক বেশি হয়। এর প্রভাব পরে আমাদের শিরদাঁড়ায়। যার ফলে সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমের কাজ ব্যহত হয়। নিঃশ্বাস নেওয়া, খাওয়া দাওয়া করা, চোখের পাতা নাড়া এই সব সাধারণ কাজ ব্যহত হয়।

এই রোগ মূলত চার ধরনের হয়। এসএমএ টাইপ-১, টাইপ-২, টাইপ-৩, টাইপ-৪। যার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক এবং কষ্টদায়ক টাইপ-১, সেই রোগেই আক্রান্ত ছোট্ট অস্মিকা।

কোন রোগের ফলে কী হয়?

স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যট্রফ্রি বা এসএমএ টাইপ-১ – সাধারণত জন্মানোর ৬ মাসের মধ্যেই ধরা পরে এই রোগ। টাইপ-১ রোগে আক্রান্ত হলে একটি শিশুর বসার ক্ষমতাটুকুও থাকে না।

স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যট্রফ্রি বা এসএমএ টাইপ-২ – এই রোগে যারা আক্রান্ত হয়, তাঁরা উঠে বসতে পারলেও, হাঁটার ক্ষমতা থাকে না।

স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যট্রফ্রি বা এসএমএ টাইপ-৩ – রোগে আক্রান্ত তাঁরা আরেকটু ভাল। বসতে, চলতে, হাঁটতে পারে। কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে একা একা উঠতে পারে না। পড়ে যায়, হোঁচট খাওয়ার মতো নানা সমস্যা হয়।

স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যট্রফ্রি বা এসএমএ টাইপ-৪ এ যারা আক্রান্ত হয়, তাঁদের ক্ষেত্রে এই অসুখ সব সময় ছোটবেলায় ধরা পড়ে না। ৩০ বছরের পড়ে গিয়ে ধরা পড়ে। এঁদের ক্ষেত্রে না হাত পা নাড়তে অসুবিধা থেকে শুরু করে আরও নানা সমস্যা দেখা যায়। অর্থাৎ পেশী বা মাসেলের যে কোনও কাজেই সমস্যা দেখা দেয়। এসএমএন প্রোটিনের অভাব যার শরীরে যত বেশি হয়, তার সেই রোগের ভয়াবহতা তত বেশি হবে।

কেন হয় এই রোগ?

চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, এই রোগ সম্পূর্ণরূপে জিন ঘটিত। যদি বাবা-মা দু’জনের শরীরেই এই রোগের উপস্থিতি থাকে, এবং তাঁদের মিলন হয় সেক্ষেত্রে সন্তান এই স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যট্রফ্রি রোগে আক্রান্ত হয়। অর্থাৎ চিকিৎসা পরিভাষায় বললে দুটি অ্যাবনরমাল ডিএনএ-এর মিলনে যে নতুন সন্তানের জন্ম হয়, তাঁর ডিএনএতে এই রোগ পরিবাহিত হয়ে সেই ব্যাক্তি আক্রান্ত হয়। এক্ষেত্রে আরেকটি জিনিস মাথায় রাখতে হবে, এই রোগে শিশুর আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ১/৪ ভাগ।

চিকিৎসক সংযুক্তা দে বলেন, “এটা এক প্রকার অটোসোমাল রিসেসিভ ডিসঅর্ডার। অর্থাৎ বাবা-মা দুজনের শরীরেই রোগটি থাকবে কিন্তু তাঁদের কোনও লক্ষণ থাকবে না। কেউ হয়তো জানতেও পারবেন না। এই ধরনের দুজন ব্যাক্তির মিলনের ফলে সন্তান জন্ম নিলে প্রত্যেকবার ২৫% ঝুঁকি থাকে এই রোগ হওয়ার।”

কী ভাবে বোঝা যায় এই রোগের উপস্থিতি?

বিদেশে উন্নত মানের চিকিৎসা পরিষেবা রয়েছে। মায়ের গর্ভে থাকাকালীন সময়ে সন্তানের টিস্যু সংগ্রহ করে জানা যায় তাঁর শরীরে এসএমএন প্রোটিনের অভাব রয়েছে কি না। সেই সময়ে চাইলে কোনও দম্পতি গর্ভপাত করতে পারেন।  অথবা সন্তানের জন্মের পরে জিন থেরাপির মাধ্যমে তাঁর চিকিৎসা করতে পারেন।

আমাদের দেশে এই ধরনের স্ক্রিনিং করার কোনও সুযোগ নেই। জিন থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসার ক্ষেত্রে নানা সমস্যা রয়েছে।

কী সমস্যা?

এই রোগের প্রভাবে প্রথমে মূলত শ্বাস কষ্টের সমস্যা দেখা যায়। ফলে বেশিরভাগ চিকিৎসক পালমোনারি কোনও সমস্যা ভেবে ভুল করে বসেন। পরে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখা যায় রোগীটির শরীরে হয়তো এসএমএন প্রোটিনের অভাব রয়েছে।

মনে রাখতে হবে, যদি কারও শরীরে একদম এসএমএন প্রোটিনের উপস্থিতি না দেখা যায় বা খুব ক্ষীণ হয় তাহলে সে টাইপ-১ স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যট্রফ্রি আক্রান্ত হয়। টাইপ-১ রোগীর ক্ষেত্রে যদি চিকিৎসা দ্রুত শুরু না হয় তাহলে সেই রোগীকে বাঁচানোটাই অসম্ভব।

কী ভাবে এই রোগের থাবা থেকে সন্তানকে রক্ষা করবেন?

স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যট্রফ্রি বা এসএমএ রোগের চিকিৎসার মূল বাঁধা হল এটি অত্যন্ত ব্যয় বহুল। প্রধানত ৩ রকমের চিকিৎসা করা সম্ভব।

১) ওষুধ – এই রোগের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ ভারতে পাওয়া যায়। কিন্তু তা খুবই ব্য়য় বহুল। রিসডি প্লাম ওষুধটির একটি শিশির দাম প্রায় ৬ লক্ষ টাকা। এই দামের ওষুধটি সারা জীবন খেয়ে যেতে হবে, তবেই সেই রোগী বাঁচবে। কিন্তু এসএমএ নির্মূল হবে না। বড়জোর টাইপ-১ থেকে টাইপ-২ রোগী হতে পারে। রোগীর বসার ক্ষমতা হবে।

২) ইনজেকশন – বিশেষ একটি ইনজেকশন রয়েছে। তার নাম নুসিনার্সেন, প্রথম এই রোগের জন্য এই ইনকজেকশন ব্যবহার করা শুরু হয়। বছরে ৩ বার সেই ইনজেকশনটি দিতে হবে। যার দাম প্রায় ১ লক্ষ টাকা। প্রত্যেকবার ইনজেকশন দেওয়ার সময় রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। শিরদাঁড়ায় ইনজেকশন দিতে হবে। তাহলেও রোগী টাইপ-১ থেকে টাইপ-২ রোগী হতে পারে।

৩) জিনগত থেরাপি – এই প্রক্রিয়ায় শরীরের ভিতর ইনজেক্ট করে একটি বিশেষ ধরনের অ্যাডিনো ভাইরাস ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। ওষুধটির নাম অনাসমোনোজিনি অ্যাবিপারভোভেক। সেই ভাইরাস কোষে কোষে গিয়ে ভাইরাসটির বংশ বিস্তার করে। ভাইরাসটিকে এমন ভাবে তৈরি করা হয়, যা শরীরের ভিতরে গিয়ে বিশেষ সারভাইভাল মোটর নিউরোন প্রোটিন তৈরি করে।

এই প্রক্রিয়ার ফলে শরীরের ভিতরে প্রোটিনের ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব।

জিন থেরাপির ক্ষেত্রে বাধা –

চিকিৎসা শাস্ত্র বলছে এই জিন থেরাপির জন্য় প্রয়োজনীয় ইনজেকশনটি কোনও বাচ্চার ২ বছরের মধ্যে দিতেই হবে, না হলে কোনও লাভ নেই।

এই ওষুধকে বলে অরফ্যান ড্রাগ। সহজে এই ড্রাগ পাওয়া যায় না। ওষুধটি তৈরি করাও অনেকটা সময় সাপেক্ষ।

ভারতে এই ওষুধ তৈরি হয় না। এত দাম দিয়ে এখানে এই ওষুধ কিনবে কে? তাই ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলিও ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে এই ওষুধ তৈরি করে না। আমেরিকা বা ইউরোপিয়ান দেশে তৈরি হয় বিশেষ এই ওষুধ। আমাদের দেশে কারও প্রয়োজন হলে ওষুধটি বিদেশ থেকে আনাতে হয়। ওষুধটির দাম ৯ কোটি টাকা। ট্রান্সপোর্টেশন খরচ, ট্যাক্স সব মিলিয়ে তাঁর খরচ গিয়ে পৌঁছায় ১৬ কোটি টাকায়।

আমাদের দেশে কিছু রোগীকে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার তরফে লটারির মাধ্যমে এই ওষুধ বিনামূল্যে দেওয়া হয়। সরকারি কোথাও এই রোগের চিকিৎসা হয় না। কিন্তু অস্মিকার ক্ষেত্রে সেই রাস্তাও বন্ধ। ওঁর হাতে সময় মাত্র ৫-৬ মাস। অথচ এই বছর লটারি কখন হবে, কোথায় হবে তার কোনও ঠিক নেই। সুতরাং ছোট্ট অস্মিকাকে বাঁচাতে গেলে ১৬ কোটি টাকা দিয়েই কিনতে হবে এই ওষুধ। শিশু বিশেষজ্ঞ বলেন, “দ্রুত এই রোগের চিকিৎসা শুরু হওয়াটাও গুরুত্ব পূর্ণ। যত দেরী হবে তত কিন্তু সমস্যা বাড়বে। সুস্থ হওয়াও কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।”

তবে এত খারাপের মধ্যেও রয়েছে একটা ভাল খবর। চিকিৎসক সংযুক্তা জানাচ্ছেন, এই ধরনের শিশুদের ক্ষেত্রে একটি অদ্ভুৎ ট্রেন্ড দেখা গিয়েছে। পেশী বা স্নায়ু সচল না হলেও এঁদের মস্তিষ্ক অত্যন্ত ভাল কাজ করে। তীক্ষ্ণ এবং ক্ষুরধার বুদ্ধির অধিকারী হতে দেখা গিয়েছে এঁদের। হয়তো কেউ খুব সহজে পাশ করে যাচ্ছেন আইআইটি বা নিট পরীক্ষা। কেউ আবার বায়োটেকনোলজি করে ফেলেছে গবেষণা। তিনি বলেন, “এই রোগ ব্রেনকে প্রভাবিত করে না। এই বাচ্চাগুলো খুবই ইন্টেলিজেন্ট হয়। তাঁদের চিন্তা ভাবনা কথাবার্তা সবই সাধারণ থাকে। তবে হাতে পায়ের পেশী আসতে আসতে কাজ করা বন্ধ করে দেয়।”

যা দেখে স্টিফেন হকিংয়ের কথাও মনে পড়ে যায় অনেক সময়। যদিও তিনি অন্য রোগে আক্রান্ত ছিলেন। তবে হুইল চেয়ারে আবদ্ধ থেকেও গোটা বিশ্বের থেকে এগিয়ে তিনি। ছোট্ট অস্মিকার জন্য তেমন উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে কি না, সেটা বলবে সময়।