World Mental Health Day: নিজেকে বাঁচিয়ে রাখুন EMOTIONAL DUMPING থেকে

EMOTIONAL DUMPING বিষয়টি তুলনামূলক ভাবে নতুন ধারণা, ফলে গবেষণাও কম। VENTING বা চেপেঢেকে রাখা আবেগ বের করে দেওয়ার যে প্রক্রিয়া, তার থেকে EMOTIONAL DUMPING চরিত্রগত ভাবে বেশ কিছুটা আলাদা, ধারণা বিশেষজ্ঞদের। আজ, বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসে খেয়াল থাকুক সে দিকে।

World Mental Health Day: নিজেকে বাঁচিয়ে রাখুন EMOTIONAL DUMPING থেকে
সহজ ভাষায়, অন্যের কথা নিশ্চয়ই শুনুন। তবে সে শোনা যেন অর্থবহ হয়।
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Oct 10, 2021 | 9:03 AM

পায়েল মজুমদার

মনের কথা, প্রাণের কথা বলা জরুরি! অন্ধকার, অবসাদ, উদ্বেগের ধূসর মুহূর্তে আরও বেশি প্রয়োজন হয় বন্ধু-পরিচিত-অপরিচিত শ্রোতাদের। কিন্তু মনের কথা বলতে গিয়ে অন্যের উপর মনের ভার ডাঁই করে ফেলছি না তো? নিজের ভার লাঘব করতে গিয়ে শ্রোতাকে ভারবহ করছি না? বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসে খেয়াল থাকুক সে দিকেও। বক্তার কষ্ট কমাতে গিয়ে যেন শ্রোতা বিপর্যস্ত না হয়ে পড়েন, সে দিকেও নজর দেওয়া দরকার। নিজেকে বাঁচিয়ে রাখুন EMOTIONAL DUMPING থেকে।

—‘‘কখন থেকে ফোন করছি! আর ইউ ডেড অর হোয়াট?’’ —‘‘এই ফিরলাম। অফিসে ভীষণ চাপ ছিল আজ। এখনও ফ্রেশ হইনি।’’ —‘‘ফ্রেশ হয়ে ফোন করো। অপেক্ষা করছি। আর্জেন্ট।’’ —‘‘রাত প্রায় তিনটে এখন…কাল করি?’’ —‘‘আমি জেগে আছি। অসুবিধা নেই।’’ —‘‘মানে, আসলে, আজ খুব টায়ার্ড…’’ —‘‘SOS নিয়েও কমছে না কষ্টটা…কেন বার বার আমার সঙ্গেই যে এরকম হয়…জানো আজ ওরা আমাকে…’’ —‘‘শোনো না, কাল কথা বলি?’’ —‘‘জাস্ট ভাবো। আজ ওরা চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল। অথচ আমাকে এক বারও ওদের সঙ্গে যেতে বলল না। সব সময় অ্যাভয়েড করে। আমি যে কী ক্ষতি করেছি ওদের…’’

ধরা যাক, কথোপকথনটি কাল্পনিক। কিন্তু স্থান, কাল, সময়ের পরোয়া না করে মনের ভার কমানোর এই প্রবণতাও কি গাঁজখুরি? ভেবে দেখুন তো! কলেজ-ইউনিভার্সিটি-অফিস বা বাড়ির পাঁচশো রকম ঝামেলা সামলে সবেমাত্র ফোন হাতে নিয়েছেন। স্ক্রিনটা জ্বলে উঠতেই খান সতেরো মিসড কল, ২২টা হোয়াটসঅ্যাপ! মানে কেউ কথা বলতে মরিয়া! আপনার ব্লাড প্রেশার তখন ১৮০/১২০ নাকি সদ্য বসের বাক্যবাণে ঘায়েল হয়েছেন, তাতে থোড়াই কেয়ার ও দিকের মানুষটির। তাঁর দরকারই শেষ কথা। দুঃখ-কষ্ট ভাগ করে নেওয়ার পরিচিত তাগিদের তুলনায় এই প্রবণতা কিন্তু বেশ কিছুটা আলাদা, মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের কেউ-কেউ। নাম রেখেছেন EMOTIONAL DUMPING।

খানিকটা যেন অতিরিক্ত জামাকাপড় বা আসবাব যেখানে সেখানে ডাঁই করে রেখে দেওয়ার মতো। সহজ ইংরেজিতে DUMPING। সম্ভবত সেখান থেকেই প্রবণতাটির নাম EMOTIONAL DUMPING। VENTING বা চেপেঢেকে রাখা আবেগ বের করে দেওয়ার যে প্রক্রিয়া, তার থেকে EMOTIONAL DUMPING চরিত্রগত ভাবে বেশ কিছুটা আলাদা, ধারণা বিশেষজ্ঞদের। কী রকম?

‘‘ক্ষোভ-দুঃখ-কষ্টের কথা বলার সময় যদি উল্টো দিকের মানুষটি কোনও পরামর্শ দেন, সেটা শুনতে অন্তত আমাদের আপত্তি থাকে না। পরে হয়তো ভাবনাচিন্তাও করি বিষয়টি নিয়ে। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে VENTING-র মধ্যে একটা সাহায্যের আর্তি থাকে, সমস্যা সমাধানের তাগিদ থাকে। EMOTIONAL DUMPING–এর সঙ্গে প্রথম ফারাক এখানেই। এক্ষেত্রে বক্তা স্রেফ নিজের কথা বলে যেতে ইচ্ছুক, সমাধানে আগ্রহ থাকে না তাঁর’’–মত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সুজিত সরখেলের। টানা এমন চলতে থাকলে শ্রোতার স্ট্রেস বাড়ে, কাজের কাজ কিছু হয় না। নজরে পড়ছে বিশেষজ্ঞদের।

‘‘সম্ভবত অতিমারীতে বেড়েছে বিষয়টি’’—মত মনোবিদ শ্রুতি মিত্রের। গবেষণা কম, তাই তথ্যপ্রমাণ দিয়ে কিছু বলা অসম্ভব। তবে গত দেড় বছরের অভিজ্ঞতা থেকে শ্রুতির ধারণা, জীবনের আর পাঁচটা দিকের মতো আবেগ প্রকাশের ধরন-ধারণও উলটে-পালটে গিয়েছে অতিমারীতে। ‘‘এত দিন পর্যন্ত যে ভাবে একে অন্যের সঙ্গে কথা বলতেন, সুখ-দুঃখ ভাগ করতেন, বাইরে যেতেন, কাজকর্ম করতেন, তার প্রায় কোনওটাই হচ্ছে না। ওয়ার্ক ফ্রম হোম হোক বা অনলাইন লেখাপড়া, চার দেওয়ালেই আটকে জীবন। ফলে দুঃখ-কষ্ট প্রকাশের চেনা প্রক্রিয়া ধাক্কা খাচ্ছে। ফল ভুগছেন বাড়ির লোক, বিশেষত পার্টনার। মনোকষ্টের ভার চাপছে তাঁর উপর’’—বললেন শ্রুতি। তবে, DUMPING-এর প্রবণতা শুধু যে অতিমারীর জের তা নয়, সংযোজন মনোবিদের। অনেকে চরিত্রগত ভাবেই এরকম, বলছেন শ্রুতি।

অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা বললেন অদ্বিতীয়া মুখোপাধ্যায় (নাম পরিবর্তিত)। নামকরা আইটি সংস্থায় কর্মরতা অদ্বিতীয়ার প্রাক্তন সহকর্মী রোজ রাতে ফোন করতেন তাঁকে। প্রেমালাপ বা অন্য কোনও উদ্দেশ্যে নয়। দিনভর যে পরিমাণ বঞ্চনা, দুঃখ ও কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে, তারই বিবরণ দিতে ফোন। অদ্বিতীয়া ক্লান্ত নাকি ব্যস্ত, ও সবে থোড়াই পরোয়া তাঁর। গোড়ায় বিহ্বল হয়ে পড়তেন যুবতী।

ইনস্টিটিউট অফ সাইকিয়াট্রির চিকিত্সক-অধ্যাপক সুজিত সরখেলের মতে, ‘‘এ সব ক্ষেত্রে সমস্যা বাড়তে থাকে শ্রোতাদের। যিনি DUMP করছেন, প্রথম দিকে তাঁর মানসিক অবস্থার কিছুটা শ্রোতার মধ্যেও চলে আসতে পারে। কিন্তু একপেশে বিষয়টি চলতে থাকলে একসময়ে বিরক্তি বাড়ে শ্রোতার। তার পরও না থামলে স্ট্রেস। কারণ শ্রোতার জীবনেও যে সমস্যা রয়েছে, সে কথা ধর্তব্যের মধ্যেই রাখতে চান না বক্তা।’’

কিন্তু কেন এরকম? EMOTIONAL DUMPING বিষয়টি তুলনামূলক ভাবে নতুন ধারণা, ফলে গবেষণাও কম। সেই সীমাবদ্ধতা মাথায় রেখেই মনোবিশেষজ্ঞদের কেউ-কেউ বলছেন, কয়েকটি PERSONALITY DISORDER-এর ক্ষেত্রে এমন হতে পারে। বহু সময়ে আবার এই প্রবণতার নেপথ্যে থাকে ছোটবেলার ইতিহাস। সুজিতবাবুর কথায়, ‘‘হয়তো ছেলেবেলা থেকেই আবেগের একপেশে প্রকাশে অভ্যস্ত অনেকে। মা-বাবা বা অভিভাবকরা প্রশ্রয়ও দেন তাতে। তাই পরবর্তীকালে শ্রোতার দিকটা ভেবে ওঠার মানসিকতাই তৈরি হয় না।’’মনোবিদ শ্রুতি মিত্রের সংযোজন, ‘‘একটি জিনিস স্পষ্ট। এঁদের মধ্যে আত্মকেন্দ্রিকতার ঝোঁক অনেকটাই।’’

হালে ইন্টারনেট থেকে EMOTIONAL DUMPING সম্পর্কে জেনেছেন অদ্বিতীয়া। মনোবিশেষজ্ঞদের বর্ণনার সঙ্গে তাঁর অভিজ্ঞতা মিলে যাচ্ছে। অদ্বিতীয়ার প্রাক্তন সহকর্মী যা বলতেন, তার সবটাই নেতিবাচক। সমস্ত দোষ-ত্রুটি অন্যের, তাঁর নয়। এটা বোঝানোই মূল উদ্দেশ্য ছিল বক্তার। আর যেহেতু সমস্যাটা অন্যের, তাই সমাধান তাঁর দায়িত্ব নয়। বদ্ধমূল বিশ্বাস ছিল বক্তার। ফলে অদ্বিতীয়া কোনও রকম পরামর্শ দিলে বিরক্ত হতেন। ভদ্রতার খাতিরে যুবতী কিছু বলতে পারতেন না। কিন্তু চাপ বাড়ত প্রতি দিন।

Personality Disorder

মানসিক স্বাস্থ্যে নজর দিতে হলে মনের কথা বলা জরুরি। প্রশিক্ষিত হোন বা না হোন, LISTENER-এর ভূমিকা এক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মনের কথা বলা ও মনের ভার চাপিয়ে দেওয়ার মধ্যে ফারাকটা কয়েক আলোকবর্ষের। মাথায় রাখা দরকার সেটিও। কী ভাবে সামলাবেন এমন পরিস্থিতি? হদিস দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা…

১) শুরুতেই বলে নিন, ‘আমার হাতে মিনিট পনেরো সময়। এর মধ্যেই আলোচনা করব।’ ২) স্পষ্ট বলুন, ‘যদি মনে করো তোমাকে উপযুক্ত পরামর্শ দিতে পারব, তা হলেই কথা বলো।’ ৩) বক্তা যখন অন্যের সমালোচনা করছেন, তখন তাঁকে বলুন, ‘এটা তো তোমার কথা। যাঁর সম্পর্কে বলছ, তাঁর কথা তো জানতে পারছি না। ফলে কার দোষ সেটা না দেখে সমাধান খুঁজি।’ ৪) দিনের কোনও একটা নির্দিষ্ট সময় স্থির করে নিন। তার বাইরে কথা নয়। ৫) এর পরও বিষয়টি চলতে থাকলে শান্ত ভাবে বুঝিয়ে দিন, সমস্যা-অসুবিধা থাকলে আপনার পক্ষে তাঁর কথা শোনা সম্ভব নয়। ৬) প্রয়োজনে পেশাদার সাহায্য নিতে বলতে পারেন।

সহজ ভাষায়, অন্যের কথা নিশ্চয়ই শুনুন। তবে সে শোনা যেন অর্থবহ হয়। যিনি বলছেন, তিনি যেন আপনার সঙ্গে কথা বলার মধ্যে দিয়ে কোনও ইতিবাচক দিকের সন্ধান পান। আর আপনার কাছেও যেন সে অভিজ্ঞতা ভারবহ না হয়ে ওঠে। LISTENER-এর মানসিক স্বাস্থ্য-ও কিন্তু খেয়াল করার, খেয়াল রাখার বিষয়।

গ্রাফিক্স ও অলংকরণ- অভীক দেবনাথ