সাত ‘ঋষির’ ফাঁসির তারিখ পাকা, হাল ছাড়লেন গান্ধীজিও, তারপর ঘটল অত্যাশ্চর্য ঘটনা

ইতিমধ্যে ব্রিটেন ওই ৭ জনের মৃত্যুদণ্ড রদের আর্জি খারিজ করে দেয়। এই সিদ্ধান্তকে ‘ঠাণ্ডা মাথায় খুন’ বলে আখ্যা দেন গান্ধীজি। চাপে পড়ে মৃত্যুদণ্ডের দিন ৫ এপ্রিল পরিবর্তন করা হয়

সাত ‘ঋষির’ ফাঁসির তারিখ পাকা, হাল ছাড়লেন গান্ধীজিও, তারপর ঘটল অত্যাশ্চর্য ঘটনা
গান্ধীজির 'ভারত ছাড়ো' আন্দোলনে অন্য মোড় দেয় 'চিমুর আন্দোলন'
Follow Us:
| Updated on: Aug 15, 2021 | 7:32 AM

শেষ সহায় ছিলেন মহাত্মা গান্ধী। হতভাগা কয়েকটা প্রাণ শুধু তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিল না, গোটা দেশ জাতির জনকের মুখ থেকে আশার বাণী শুনতে চেয়েছিল। কিন্তু হতাশ হয়ে গান্ধীজি বললেন, “তাঁহাদের জীবন রক্ষার জন্য সমস্ত চেষ্টাই ব্যর্থ হইয়াছে। অবশিষ্ট সময় এখন ভগবানের হাতে।” এ কথা শোনার পর দেশবাসীর আর কী করারই থাকে। মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত। অস্তি-চিমুর ও অগস্ট আন্দোলনে হিংসায় দোষী সাব্যস্তদের প্রাণদণ্ড শুধু সময়ের অপেক্ষা।  ঠিক এই সময় ঘটে গেল এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা।

আগে জেনে নেওয়া দরকার স্বাধীনতা আন্দোলনে চিমুরের তাৎপর্য কোথায়?  মহারাষ্ট্রের নাগপুর থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরে ঘন বনানী ঘেরা ছোট্ট গ্রাম চিমুর। ১৯৪২ সালে অগস্টে রাতারাতি সেই ছোট্ট গ্রাম খবরের শিরোনামে চলে আসে। মুম্বইয়ের গোয়ালিয়া ট্যাঙ্ক ময়দানে দাঁড়িয়ে গান্ধিজী ‘ভারত ছাড়ো’ স্লোগান দিলে গোটা দেশের মতো চিমুরও সেই আন্দোলনে গা ভাসিয়ে দেয়। চিমুর গ্রামবাসীর মাত্র ৩ দিনের আন্দোলন ইংরেজদের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। 

‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে তখন উত্তাল দেশ। এই আন্দোলনকে রুখতে ব্রিটিশ সরকারও হাত ধুয়ে নেমে পড়ে। কংগ্রেস কর্মীদের একাধিক সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত, সংবাদমাধ্যম সেন্সর করা থেকে গান্ধীজি, জওহরলাল নেহরু-সহ প্রথম সারির নেতাদের একে একে গ্রেফতার করে আন্দোলনের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার কোনও প্রচেষ্টাতে ত্রুটি রাখেনি সরকার। এর ফলে আন্দোলনের নেতৃত্বে সঙ্কট দেখা দেয়। অভিমুখ হারায় ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন। বেশ কিছু জায়গায় থেকে হিংসার খবর আসতে শুরু করে। পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে চিমুর, অস্তি, ইয়াওলি, রামতেক, নাগপুর-সহ একাধিক জায়গা।

Chimur Movement

গান্ধীজির ‘ভারত ছাড়ো’ ঘোষণার পর গোওয়ালি ট্যাঙ্ক ময়দানে পুলিশের লাঠিচার্জ | ১৯৪২ অগস্ট

চিমুর আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বিধর্ভের আধ্যাত্মিক গুরু তুকদোজি মহারাজ। ১৯৪২ সালের ১৫ অগস্ট রাতে চিমুরে গিয়ে ‘খঞ্জরি ভজন’ গেয়েছিলেন তুকদোজি মহারাজ। সেই ভজন চিমুর গ্রামবাসীকে দেশত্ববোধে উজ্জীবিত করে তোলে। পরের দিন অর্থাৎ ১৬ অগস্ট চিমুর অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। গান্ধীজি তখন জেলে। আন্দোলনকারীদের উপর নির্বিচারে লাঠিচার্জ তো হয়ই, গুলিও চালায় পুলিশ। একাধিক আন্দোলনকারীর মৃত্যু হয়। আহত হন প্রচুর। প্রাণহানি হয় পুলিশ কর্মীদেরও। 

সাব-ডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট, সার্কেল ইনস্পেক্টর, নায়েব তহশিলদর এবং এক পুলিশ কনস্টেবলের মৃত্যু হয়। একাধিক সরকারি আবাসনে আগুন ধরিয়ে দেয় উন্মত্ত জনতা। চিমুরের সংযোগকারী সেতু ভেঙে দেওয়া হয়। ব্যাপক হিংসার খবর মিলতে প্রাদেশিক সরকারের কাছে আরও সেনা পাঠানোর অনুরোধ করেন জেলা শাসক কে এন সুব্রহ্মণ্যম। ১৯ অগস্ট একটি স্পেশাল ট্রেনে ২০০ ব্রিটিশ সেনা ও ৫০ ভারতীয় কনস্টেবল এসে পৌঁছয় চিমুরে। এরপর চলে গ্রামবাসীদের উপর বর্বোরচিত অত্যাচার। নরসংহার, ধর্ষণ কোনও কিছুই বাদ পড়ল না।

Chimur Movement

চিমুর গ্রামবাসীদের অত্যাচারের পর চান্দা জেলার ডেপুটি কমিশনারের তোলা ছবি। ১৯৪২ অগস্ট। ন্যাশনাল আর্কাইভ অব ইন্ডিয়া

দাদিবাঈ বেগড়ে নামে এক বৃদ্ধা এন সুব্রহ্মণ্যমের কাছে কাতর আর্জি জানান এই নির্মম অত্যাচার বন্ধ করার। এরপর বিবেকের বর্শবর্তী হয়ে সেনা সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেন জেলা শাসক। তবে, হিংসায় মদত দেওয়ার অভিযোগে ৪০০ জনকে আটক করা হয়। সম্পত্তি ধ্বংসের জন্য এক লক্ষ টাকার জরিমানা করা হয় গরিব গ্রামবাসীদের উপর। অগস্টের শেষে চিমুরে গণহত্যার তদন্তের দাবি জানিয়ে সরকারে কাছে দারস্থ হয় চান্দা জেলার বার অ্যাসোসিয়েশন। চিমুর পরিদর্শনে যান বিমলাবাঈ দেশপাণ্ডে, দ্বারকাবাঈ দেওসকার, রমাবাঈ তাম্বে-সহ অন্যান্য মহিলা মানবাধিকার কর্মীরা। 

চিমুরের পরিস্থিতি দেখে হতভম্ব মানবাধিকার কর্মীরা। যে অত্যাচার চিমুরের গ্রামবাসীদের উপর করা হয়েছে, তা অবর্ণীয় বলে উল্লেখ করেন তাঁদের রিপোর্টে। সরকারের কাছে তদন্তের দাবি জানিয়ে চাপ সৃষ্টি করেন তাঁরা। পাল্টা সরকারও বিবৃতি দিয়ে জানিয়ে দেয়, এমন কোনও নক্কারজনক ঘটনা ঘটেনি সেখানে। চিমুরের মহিলারা সেনাকে অসম্মান করার জন্য এমন অভিযোগ করছেন। 

Chimur Movement

চিমুরে ইংরেজদের বর্বোরচিত নারী নির্যাতনের অলঙ্করণ অমৃতবাজার পত্রিকায়

এরপরই গান্ধীবাদী নেত্রী উষা মেহতা কংগ্রেসের আন্ডারগ্রাউন্ড রেডিয়ো স্টেশন থেকে চিমুরের মহিলাদের উপর সেনার নির্মম ধর্ষণের বর্ণনা দেশবাসীর কাছে তুলে ধরেন। এই খবর নাড়িয়ে দেয় গোটা দেশকে। আর আন্তর্জাতিক মহলে এই খবর ছড়িয়ে দেয় বার্লিন থেকে সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ রেডিয়ো। চাপে পড়ে ব্রিটিশ সরকার।

মচকালো তবুও ভাঙল না ইংরেজরা। ‘ভারত রক্ষা’ আইনে চিমুর সংক্রান্ত সব খবর নিষিদ্ধ করা হল। আরও কড়া ব্যবস্থার পথে হাঁটল ব্রিটিশ সরকার। এ দিকে গান্ধীবাদী নেতা প্রফেসর জে পি ভনসালি আমরণ অনশনে বসে চিমুর আন্দোলনকে অক্সিজেন দিতে শুরু করেন।  চিমুরের সঙ্গে ভনসালির অনশনে খবরও নিষিদ্ধ করা হয়। এর প্রতিবাদে ১৯৪৩ সালে ৬ জানুয়ারি এক দিন সব পাবলিকেশন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয় সংবাদ মাধ্যমগুলি।

টানা ৬৩ দিন ভনসালির অনশনের পরে টনক নড়ে ইংরেজ সরকারের। বাধ্য হয়ে প্রাদেশিক সরকার ভনসালির সঙ্গে সমঝোতা করে প্রতিশ্রুতি দেয়, ভবিষ্যতে মহিলাদের সম্মান কোনওভাবে অক্ষুন্ন না নয়, তা দেখতে সরকার বদ্ধপরিকর থাকবে। চিমুর সংক্রান্ত খবরে নিষেধাজ্ঞাও তুলে নেওয়া হয়। তদন্তে উঠে আসে চিমুরে ১৩ জন মহিলা ধর্ষিত হয়েছেন। শ্লীলতাহানি হয় ৪ নাবালিকার। এমনকী, গ্রামের প্রধানের গর্ভবতী স্ত্রীও ধর্ষিত হন বলে আদালতে প্রমাণ হয়। পাশাপাশি, হিংসায় মদত দেওয়ার অভিযোগে ৪০০ জনের বিরুদ্ধে যে মামলা চলছিল, তার মধ্যে ২৯ জনের মৃত্যুদণ্ড এবং ৪৩ জনের যাবজ্জীবন শাস্তি হয়।

চিমুর নিয়ে প্রতিবেদন ডেকান ক্রনিক্যালে।

অস্তি-চিমুর মামলায় মৃত্যুদণ্ডিতদের শাস্তি কমানোর আর্জি জানিয়ে সরকারের কাছে এক লক্ষ হস্তাক্ষর জমা পড়ে। এই হস্তাক্ষরের তালিকায় কংগ্রেস, মুসলিম লিগ, কমিউনিস্ট পার্টি সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, ট্রেড ইউনিয়ন-সহ একাধিক সংগঠনের সদস্য, বুদ্ধিজীবী, চিকিৎসক, সাংবাদিক, লেখক কেউ বাদ ছিলেন না। অনেক লড়াইয়ের পর ২৯ জনের মধ্যে শাস্তি কমিয়ে আজীবন কারাদণ্ড হয় ১৪ জনের । ১৯৪৫ সালে ২৯ জানুয়ারি বাকি ১৫ জন মৃত্যুদণ্ডিতদের মধ্যে ৮ জনকে নাগপুর জেলে পাঠানো হয় যাবজ্জীবন কারদণ্ডে দণ্ডিত করে। বাকি রইল ৭।

ফিরে আসি চিমুর কাণ্ডে গান্ধীজির শেষ চেষ্টার কথা। গান্ধীজি কড়া বিবৃতি দিয়ে দেশবাসীর কাছে আর্জি জানালেন, ৭ জনের মৃত্যুদণ্ড রদ করার জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করতে হবে। আরও বড় আন্দোলনের পথে হাঁটলেন গান্ধীজি। বোম্বের রেল, ট্রামওয়ে ইউনিয়ন-সহ একাধিক সংগঠনের প্রায় দেড় লক্ষ শ্রমিক রাস্তায় নামলেন প্রতিবাদ জানাতে। মৃত্যুদণ্ড রদের দাবি জানিয়ে ১৯৪৫ সালে ৩ এপ্রিল ‘চিমুর দিবস’ পালন করেন তাঁরা। কংগ্রেস নেতা ভুলাভাই দেশাইকে দুঃখপ্রকাশ করে চিঠি লিখে গান্ধীজি জানান, চিমুরের বন্দিদের যদি ফাঁসি দেওয়া হয়, তাহলে আমরা কীভাবে জাতীয়তাবাদী সরকার গড়ব? তাঁদের বাঁচানোর জন্য মুসলিম লিগকে সঙ্গে নিয়ে কিছু একটা করা দরকার।

ইতিমধ্যে ব্রিটেন ওই ৭ জনের মৃত্যুদণ্ড রদের আর্জি খারিজ করে দেয়। এই সিদ্ধান্তকে ‘ঠাণ্ডা মাথায় খুন’ বলে আখ্যা দেন গান্ধীজি। চাপে পড়ে মৃত্যুদণ্ডের দিন ৫ এপ্রিল পরিবর্তন করা হয়। ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট রিলিফ সোসাইটি (সিপিআরএস)-এর সভাপতি অনুসূয়াবাঈ কালে দিল্লিতে এসে ভাইসরয়ের আপ্তসহায়কের সঙ্গে দেখা করেন। কালের অক্লান্ত চেষ্টায় আরও একবার ব্রিটেনের রাজপরিবারের গোচরে আসে বিষয়টি। ব্রিটেনে লেবার পার্টি ক্ষমতায় আসায় এই মামলার মোড় ঘুরে যায়। মৃত্যুদণ্ড সিদ্ধান্তে অটল থাকলে আন্তর্জাতিক মহলে নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা ছিল লেবার পার্টির। সহানুভূতির সঙ্গে বিষয়টি বিবেচনা করে তারা।  শেষমেশ ১৬ অগস্ট ওই ৭ জনের মৃত্যুদণ্ড রদ হয়ে যাবজ্জীবন সাজা হয়।

সেই সাত জন হলেন গোপালরাও কোরেকার, বিনায়ক ভোপে, গণপতি চানে, দোমাজি কোটে, বাবুরাও কোটে, দাদাজি কিরিমকার এবং দাদাজি তানিরওয়ার। মৃত্যুকে জয় করায় ‘সপ্তঋষি’ হিসাবে পরিচিতি পান চিমুরের ওই ৭ জন আন্দোলনকারী।

(ভারতের স্বাধীনতার  প্ল্যাটিনাম জয়ন্তীতে অগ্নিযুগের সেই সব অনাপসী অসংখ্য তথা কথিত অনামী দেশপ্রমিকদের ভূমিকা স্মরণ করার এক ক্ষুদ্র প্রয়াস।)