কেন এমারজেন্সির পথে হেঁটেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী?
৪৪ বছর পর যখন জরুরি অবস্থা নিয়ে খোদ রাহুল গান্ধী এমন কথা বলছেন। তখন অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগছে ঠিক কী হয়েছিল সে সময়। কেনই বা দেশে এমন পরিস্থিতি এল যে জারি করতে হল এমারজেন্সি। সেই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে ফিরে যেতে হবে ১৯৭১ সালে।
কলকাতা: “ভাইও অউর বেহনো রাষ্ট্রপতিজি নে আপদকাল কা ঘোষণা কি হ্যায়, ইসসে আতঙ্কিত হোনে কা কোয়ি কারণ নেহি হ্যায়।” ১৯৭৫ সালের ২৬ জুন অল ইন্ডিয়া রেডিয়োয় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর (Indira Gandhi) এই ঘোষণাই সারা দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। ২১ মাস ধরে দেশে এমারজেন্সি (Emergency 1975)। সেই সময়টাকে অনেকে বলেন “দেশের অন্ধকার অধ্যায়।” প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর এই পদক্ষেপে সমালোচনা হয়েছে বিস্তর। জরুরি অবস্থাকে উস্কে দিয়ে বিজেপিকে খোঁটা দেয় বিজেপি। ফের সেই বিতর্ক ফিরে এল। তবে এবার খোদ ইন্দিরা গান্ধীর নাতি তথা কংগ্রেস সাংসদ রাহুল গান্ধীর হাত ধরে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় মঙ্গলবার রাহুল বলেন, “১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল অবধি দেশে ২১ মাসের জরুরি অবস্থা জারি ছিল। খর্ব করা হয়েছিল মানুষের সাংবিধানিক অধিকার। একেবারেই ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ঠাকুমা।” কংগ্রেসের শীর্ষ নেতার মন্তব্য, “কংগ্রেস দেশের প্রাতিষ্ঠানিক পরিকাঠামো দখল করতে চায় না। কংগ্রেসের সেই ক্ষমতাও নেই।” এখন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিজেদের লোক ঢোকাচ্ছে বলে অভিযোগ করে রাহুল জরুরি অবস্থার বিষয়ে এমন বলেন।
৪৪ বছর পর যখন জরুরি অবস্থা নিয়ে খোদ রাহুল গান্ধী এমন কথা বলছেন। তখন অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগছে ঠিক কী হয়েছিল সে সময়। কেনই বা দেশে এমন পরিস্থিতি এল যে জরুরি অবস্থা জারি করতে হল ইন্দিরা গান্ধীকে। সেই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে ফিরে যেতে হবে ১৯৭১ সালে। তখন বাংলাদেশ শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পাকিস্তানের শাসন থেকে বেরিয়ে এসেছে। ইন্দিরার পূর্ণ সমর্থনে গড়ে উঠেছিল স্বাধীন বাংলাদেশ। ভারত-পাক যুদ্ধে ভারতের জয়। সব মিলিয়ে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ইন্দিরা। স্বাভাবিক ভাবেই তার আঁচ পড়ল নির্বাচনে। আর এই নির্বাচন থেকেই তৈরি হল জরুরি অবস্থার বুনিয়াদ।
১৯৭১-এর নির্বাচন
এর আগে বিশ্লেষকরা বলেন, এই নির্বাচনই ‘গুঙ্গি গুড়িয়া’কে ‘আইরন লেডি’তে পরিণত করেছিল। এই নির্বাচনে ইন্দিরার স্লোগান ছিল, “গরিবি হঠাও।” নির্বাচনে ৫১৮টি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে ৩৫২টি আসনেই জিতল কংগ্রেস। রায়বেরিলি লোকসভায় জিতলেন ইন্দিরা গান্ধী। সেই আসনে বিরোধী সংযুক্ত সোশালিস্ট পার্টির রাজনারায়ণ পেয়েছিলেন ৭১ হাজার ৪৯৯ ভোট। আর ইন্দিরা পেয়েছিলেন ১ লক্ষ ৮৩ হাজার ভোট। তবে হার মানেননি রাজনারায়ণ। লোকসভা নির্বাচনের ফলের বিপক্ষে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন রাজনারায়ণ। অভিযোগ, রায়বেরিলির ভোটে সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন ইন্দিরা।
ক্ষমতায় ইন্দিরা
জনপ্রিয়তার শিখরে থাকার সময় ইন্দিরা গান্ধীর ২টি সিদ্ধান্তের উল্টো পথে হাঁটে সুপ্রিম কোর্ট। প্রথম, ১৪টি বেসরকারি ব্যাঙ্ককে সরকারি অধিগ্রহণ করা ও পুরনো রাজা মহারাজাদের ভাতা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। দু’টি ক্ষেত্রেই সুপ্রিম কোর্ট ইন্দিরার এই সিদ্ধান্ত আটকে দেয়। তখন সংবিধানে পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু তাঁর এই সিদ্ধান্তই পরোক্ষভাবে জরুরি অবস্থার দিকে নিয়ে যায় দেশকে। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হয়ে আসেন বিচারপতি এএন রায়। কিন্তু নিয়ম মতো প্রধান বিচারপতি হওয়ার কথা ছিল সিনিয়র আর এক বিচাপতির। এএন রায় প্রধান বিচারপতি হওয়ার পর সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খোলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ (জেপি)। তিনি সাংসদের উদ্দেশে এই বিচারপতি নিয়োগের বিরোধিতা করে একটি খোলা চিঠি লেখেন।
গুজরাটে নবনির্মাণ আন্দোলন
১৯৭৩-১৪ এ মূল্যবৃদ্ধি চরমে ওঠে। যার ফলে দেশজুড়ে আন্দোলনের পরিস্থিতি তৈরি হয়। ছাত্র আন্দোলন আছড়ে পড়ে গুজরাটে। যা সামলাতে গুজরাটে গুলি চলে, নামে সেনাও। এই আন্দোলনই গুজরাটে চিমন ভাই প্যাটেলের মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য করে। বিহারেও শুরু হয় ছাত্র আন্দোলন। ২০ মার্চ বিহারের এই আন্দোলনের সমর্থনে নেতৃত্বে আসেন জেপি। ৮ এপ্রিল ১৯৭৪-এ মূক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন তিনি। এরপর জর্জ ফার্নান্দেজের নেতৃত্বে বৃহৎ রেলকর্মীদের আন্দোলন হয় গোটা দেশজুড়ে। অন্যদিকে জেপির আন্দোলনে সিপিআই ছাড়া কংগ্রেস বিরোধী সবক’টি দল চলে আসে। জেপি যখন বিহারের সরকারের পতন চাইছেন, তখন পয়লা নভেম্বর রামলীলা ময়দানে ইন্দিরা সাফ জানান, বিহার সরকারের পতন হবে না। যার মাধ্যমে স্পষ্ট হয় ইন্দিরা-জেপি তরজা।
১২ জুন, ১৯৭৫-এলাহাবাদ হাইকোর্টের সিদ্ধান্ত
১৯৭১-এর লোকসভা নির্বাচনে রায়বেরেলি আসনে দুর্নীতির মামলায় রাজনারায়ণের আইনজীবী ছিলেন শান্তিভূষণ। এলাহাবাদ হাইকোর্টে বিচারপতি ছিলেন জগমোহনলাল সিনহা। হাইকোর্টে যে দিন সিদ্ধান্ত ঘোষণার কথা ছিল সে দিন প্রথম বার কোনও প্রধানমন্ত্রীকে আদালতে আসতে হয়েছিল। ১৮ মার্চ হাইকোর্টে এসেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। সে দিন বিচারপতি জগমোহনলালের নির্দেশে আদালতে প্রধানমন্ত্রী সুলভ আচরণ হয়নি ইন্দিরার সঙ্গে। তাঁকে অভিবাদন জানাতে উঠে দাঁড়াননি পুলিশ আধিকারিকরা। ১২ জুন ১৯৭৫ এলাহাবাদ হাইকোর্ট ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে রায় দেয়। ৬ বছরের জন্য নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয় ইন্দিরার।
ইন্দিরা গান্ধীর ‘ইস্তফা’?
এলাহাবাদ হাইকোর্ট তাঁর বিরুদ্ধে যাওয়ার পর ইস্তফা দিতে চেয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। তখন ইন্দিরার কাছে পরামর্শ গিয়েছিল কংগ্রেস অধ্যক্ষ হওয়ার। কিন্তু পুত্র সঞ্জয় গান্ধীর পরামর্শে ইস্তফা দিতে নারাজ হন ইন্দিরা। হাইকোর্টের রায় চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে যান ইন্দিরা গান্ধী। সেখানেও রায় যায় তাঁর বিরুদ্ধে। ২৪ জুন সুপ্রিম কোর্ট জানায়, প্রধানমন্ত্রী থাকলেও লোকসভায় সংসদীয় ভোট দেওয়ার অধিকার পাবেন না ইন্দিরা। পরের দিন ২৫ জুন বিরোধীদের সভা করার কথা ছিল রামলীলা ময়দানে। প্রধান বক্তা ছিলেন জেপি। সেখান থেকে ইন্দিরা গান্ধীর উদ্দেশে কড়া ভাষায় কুর্সি ছাড়ার বার্তা দিয়েছিলেন তিনি। সেখানে জেপি হুঙ্কার ছেড়ে বলেছিলেন, “যদি সেনা বা পুলিশ কোনও সরকারি নির্দেশিকা ভুল মনে করে তা যেন না মানে তারা।” সত্যাগ্রহ আন্দোলনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বাসভবনের ডাক দেন জেপি।
দেশে জারি জরুরি অবস্থা
সুপ্রিম কোর্টে মুখ থুবড়ে পড়ে ইন্দিরার চ্যালেঞ্জ। অন্য দিক থেকে চাপ বাড়াচ্ছে বিরোধীরা। একের পর এক দরজা বন্ধ হচ্ছে ইন্দিরার সামনে। এমতাবস্থায় ২৫ জুন বিরোধীদের যখন জেপি জ্বালিয়ে তুলছেন, তখন ১ সফদরগঞ্জে চলছিল রুদ্ধদ্বার বৈঠক। সঞ্জয় গান্ধীর নেতৃত্বে সেই বৈঠকে ওম মেহতা, দিল্লির উপরাজ্য পাল ও হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মিলে রাজনৈতিক গ্রেফতার ও এমারজেন্সি সংক্রান্ত সব কলকবজা নাড়ছিলেন, এমনটাই জানা যায় সংবাদ মাধ্যমের বিভিন্ন প্রতিবেদন মারফত। এরপর রাষ্ট্রপতি ফখরুদ্দিন আলি আহমেদের সঙ্গে দেখা করেন ইন্দিরা গান্ধী। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর জরুরি অবস্থা জারি করতে রাজি হয়ে যান রাষ্ট্রপতি। রাত প্রায় ১১টা ২০ নাগাদ এমার্জেন্সি পত্রে সিলমোহর পড়ে রাষ্ট্রপতির। এরপর মধ্যরাত থেকে প্রায় ভোর ৩টে পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য়মন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় ও ইন্দিরা গান্ধী মিলে দেশের উদ্দেশে এমার্জেন্সি ঘোষণার বক্তব্য ঠিক করেন।
গ্রেফতার জেপি
রামলীলা ময়দান থেকে ফিরে গান্ধী শান্তি প্রতিষ্ঠানে ছিলেন জয়প্রকাশ। সেখান থেকেই তাঁকে গ্রেফতার করে পুলিশ। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা যায়, গ্রেফতারির সময় জেপি বলেছিলেন, “বিনাশকালে বিপরীত বুদ্ধি।” ওই রাত্রিবেলাই বিভিন্ন খবরের কাগজের কার্যালয়ে বিদ্যুৎ বিভ্রাট হয় বলেও জানা যায়। ২৬ তারিখ সকাল বেলা ক্যাবিনেট বৈঠক করেন ইন্দিরা, তখনই দেশের কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা এমার্জেন্সির সম্পর্কে জানতে পারেন। পরদিন থেকে বন্ধ হয়ে যায় বিরোধীদের র্যালি। কারণ এমার্জেন্সি পরবর্তী সময়ে প্রায় ১৩ হাজার বিরোধী নেতাদের গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। আর ২৬ জুন সকাল ৮টায় ইন্দিরার গান্ধীর কণ্ঠে অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো থেকে সম্প্রচারি হয়, “ভাইও অউর বেহনো রাষ্ট্রপতিজি নে আপদকাল কা ঘোষণা কি হ্যায়, ইসসে আতঙ্কিত হোনে কা কই কারণ নেহি হ্যা।”
১৯৭৭-এর নিবার্চন
১৯৭৭ সালে হঠাৎ লোকসভা নির্বাচনের কথা ঘোষণা করেন ইন্দিরা গান্ধী। তখন জেপির নেতৃত্বে বিরোধীরা একজোট হয়ে গড়ে তোলে জনতা পার্টি। আর নির্বাচনে এমারজেন্সির প্রভাবে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায় কংগ্রেস। ৫৪২টি লোকসভার মধ্যে ২৯৫টি আসন পায় জনতা পার্টি। ১৫৪টি আসন যায় কংগ্রেসের ঘরে। প্রথম অকংগ্রেসি প্রধানমন্ত্রী হন মোরারজি দেসাই।
এমার্জেন্সির ৪৪ বছর পর জরুরি অবস্থাকে ‘দেশের কালো অধ্যায়’ লিখে ২৫ জুন টুইট করেছিলেন বিজেপি নেতারা। সংসদে খোদ প্রধানমন্ত্রী এমার্জেন্সি নিয়ে বক্তব্য পেশ করেছিলেন। বাক স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে বিজেপি এখনও এমার্জেন্সির প্রসঙ্গ তুলে নিশানা করে কংগ্রেসকে। দেশের সেই লম্বা ২১ মাসের ইতিহাস ফের সামনে এল রাহুল গান্ধীর মন্তব্যে। যা নিয়ে ইতিমধ্যেই রাজনৈকি তরজা চরমে। বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নান বলেন, “অর্ধেক সত্য প্রকাশ্যে আনা হচ্ছে। রাহুল গান্ধী যেটা বলেছেন, সেটা ইন্দিরা গান্ধীও বলেছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীও জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করেছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী নিজেই বলেছিলেন, জরুরি অবস্থার পুনরাবৃত্তি হবে না। সে সময় দেশে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, যে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা ছাড়া উপায় ছিল না। কিন্তু সে সময় এমন প্রচার করা হয়, মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছিল।”
বঙ্গ বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি তথাগত রায় বলেন, “রাহুল গান্ধী তাঁর চিরাচরিত ঢঙে কিছু অর্থহীন কথা বলেছেন। যেগুলোর আমি কোনও তাৎপর্য খুঁজে পাচ্ছি না। ওঁ বলেছে আরএসএস সমস্ত পদ নিজেদের লোক দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছে। তার সঙ্গে তো জরুরি অবস্থা জারি করার কোনও সম্পর্ক নেই। ইন্দিরা গান্ধী সে সময় সন্ধিহান হয়ে পড়েছিলেন যে তিনি জিতবেন কিনা, তাই নিজের ওজন বুঝতেই নির্বাচন করেছিলেন। রাহুল গান্ধীর বক্তব্য। অর্থহীন।”
বাম পরিষয়ীয় দলের নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেন, “জরুরি অবস্থা যেভাবে ৭৫ সালে হল, সেটা ভুল ও বেঠিক। তা মেনে নেওয়া যায় না। রাহুল গান্ধী যা বলেছেন, তা আগে বিভিন্ন সময়ে কংগ্রেস নেতারা বলেছেন। স্বৈরাচারি মনোভাবের প্রভাব যে গণতান্ত্রিক দেশে ভাল হয় না, তা প্রমাণিত।”