Independence Day: ‘বন্দে মাতরম’ চেয়েছিল বাংলা, ‘জন-গণ-মন’ চেয়েছিলেন নেহরু? কোনটি হওয়া উচিত জাতীয় সঙ্গীত, চিঠিতে ব্যাখ্যা নেহরু ও বিধানচন্দ্রের

Independence Day: দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, স্বাধীন ভারতের জাতীয় সঙ্গীত কী হবে, তা নিয়ে সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের থেকে মতামত জানতে চেয়েছিলেন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। সেই সময় জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে 'জন-গণ-মন'-কে বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে আপত্তি জানিয়েছিলেন বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়।

Independence Day: 'বন্দে মাতরম' চেয়েছিল বাংলা, 'জন-গণ-মন' চেয়েছিলেন নেহরু? কোনটি হওয়া উচিত জাতীয় সঙ্গীত, চিঠিতে ব্যাখ্যা নেহরু ও বিধানচন্দ্রের
জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে চিঠি চালাচালিImage Credit source: TV9 Bangla
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Aug 15, 2023 | 5:49 PM

স্বাধীনতার ৭৬ বছর পূর্ণ হল। আজ দেশের ৭৭তম স্বাধীনতা দিবস। দিনভর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত বিভিন্ন সরকারি অনুষ্ঠান। জাতীয় সঙ্গীত বাজবে গোটা দেশে। ‘জন গণ মন অধিনায়ক’-এর সুরে মুখরিত হবে চারিদিক। এই জাতীয় সঙ্গীত দেশের গর্ব, দেশের অহংকার। কিন্তু স্বাধীনতার পর কী হবে জাতীয় সঙ্গীত, তা নিয়ে এককালে অনেক আলোচনা হয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, স্বাধীন ভারতের জাতীয় সঙ্গীত কী হবে, তা নিয়ে সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের থেকে মতামত জানতে চেয়েছিলেন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। সেই সময় জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ‘জন-গণ-মন’-কে বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে আপত্তি জানিয়েছিলেন বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়।

প্রাক্তন আমলা সরোজ চক্রবর্তী, যিনি স্বাধীনতার আগে এবং স্বাধীনতার পরে বিভিন্ন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কাছ করেছেন, তাঁদের কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাঁরই লেখা ‘মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে’ বইয়ের প্রথম খণ্ডে সেই সময়ের বেশ কিছু চিঠি উঠে এসেছে। জওহরলাল নেহরু ও বিধানচন্দ্র রায়ের মধ্যে তখন বেশ কিছু চিঠি চালাচালিও হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী নেহরু ‘জন-গণ-মন’-কে দেশের জাতীয় সঙ্গীত করার বিষয়ে যে মতামত জানতে চেয়েছিলেন, তাতে কী বলেছিলেন বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিসি রায়? প্রধানমন্ত্রীর চিঠি পাওয়ার পর বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর পাঠানো চিঠির বয়ান,

কলকাতা

১৪ই জুন ১৯৪৮

প্রিয় প্রধানমন্ত্রী,

ভারত সরকারের ডেপুটি সেক্রেটারি ঈ. গেনব সাহেবের একখানা চিঠি এবং আপনার দপ্তরের এখটি নোট পেলাম আমরা, জাতীয় সঙ্গীতের ব্যাপার নিয়ে।

এ-বিষয়ে আমাদের মন্ত্রিসভায় আমরা আলোচনা করেছি। অবশ্য আইন সভাই এর চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করবে। তবে, যে পর্যন্ত সেটা না হচ্ছে, সে পর্যন্ত কাজ চালানোর যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাতে এটা বুঝতে পারছি না, জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ‘জনগণমন’ ব্যবহার করা কি আপনার নির্দেশ, না কি, এ বিষয়ে আপনি আমাদের মতামত চেয়ে পাঠিয়েছেন। যদি এটা নির্দেশ হয় তবে, আমাদের বলার কিছু নেই। কিন্তু যদি মতামতের প্রশ্ন হয়, তাহলে বলতে পারি, পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রিসভার মতে, জাতীয় সঙ্গীত হবার ব্যাপারে ‘বন্দে মাতরম্’ এর দাবি যে অনেক বেশি, সেটা বিবেচনা করে দেখা উচিত। নির্ধারিত মান অনুযায়ী এর সুর করা যেতে পারবে, আর তা বাজাতে সময় লাগবে ৪৫ সেকেন্ড বা এক মিনিট। কিন্তু এ সব ছাড়াও দেখা উচিত, জাতীয় সঙ্গীতের পিছনে কোনো ঐতিহ্য আছে কিনা। বন্দে মাতরমের তা আছে। ১৯০৫ সাল থেকে আত্মদান ও নিপীড়নের এক মহান ঐতিহাসিক ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে এর পিছনে। ব্রিটিশ আমলে সরকারী আদেশ ভাঙবার জন্য মানুষ এই গান গেয়ে উঠতো, আর তার জন্য অবলীলায় শাস্তি ভোগ করতো। মানুষ জেলে গেছে, বন্দুকের গুলির সামনে বুক পেতে দিয়েছে, ফাঁসীর মঞ্চে উঠে গেছে এই গান কণ্ঠে নিয়ে। আমরা নিশ্চয় বলতে পারি, ‘জনগণমন’-এর পিছনে তেমন কোন ঐতিহ্য নেই। এ কথা বলার দরকার করে না, কোনো দেশের জাতীয় সঙ্গীত যে কোনো বড়ো কবির দ্বারা লিখিত হবে, এমন কোনো কথা নেই। অনেক দেশ আছে যাদের জাতীয় সঙ্গীত লিখেছেন এমন লোক, যাঁর কবি হিসেবে খুব কমই সুখ্যাতি আছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত লেখার দরকার করে না। রবীন্দ্রনাথের উপর আমাদের বিপুল শ্রদ্ধা ও ভালবাসা থাকা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রিসভা একযোগে বলেছেন, ‘বন্দে মাতরম্’-ই জাতীয় সঙ্গীত হওয়া উচিত। আমাদের এ-ও সন্দেহ নেই যে, আমরা এ ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের জনগণের মতামতই ব্যক্ত করছি।

আপনার বিশ্বস্ত

বি.সি.রায়

অর্থাৎ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুখ্যাতি ও বিশ্বব্যাপী তাঁর গ্রহণযোগ্যতার কথা মেনে নিয়েও ‘জন-গণ-মন’-কে জাতীয় সঙ্গীত করার ক্ষেত্রে আপত্তি ছিল বিধানচন্দ্র রায়ের। তাঁর মতে, বন্দেমাতরমের মধ্যে যে দেশাত্মবোধ রয়েছে, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে যেভাবে বন্দেমাতরম গানটি জড়িয়ে রয়েছে, তাতে বন্দেমাতরম গানটিই জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার দাবিদার। সেই হিসেবে স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের সঙ্গে ‘জন-গণ-মন’ যে অতটা জড়িত নয়, সেটাও বোঝাতে চেয়েছিলেন তিনি। বিষয়টি নিয়ে যে রাজ্য মন্ত্রিসভাতেও আলোচনা হয়েছে এবং সর্বসম্মতিক্রমে বন্দেমাতরমের পক্ষেই মত এসেছে, সেটাও চিঠিতে জানিয়েছেন বিসি রায়। কেন ‘জনগণমন’র বদলে ‘বন্দেমাতরম’কে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করা উচিত, তা বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন তিনি। যদিও সঙ্গে এটাও বলেছিলেন যে এই বিষয়ে যাবতীয় সিদ্ধান্ত আইনসভাই নেবে।

বিধানচন্দ্র রায়ের চিঠির প্রাপ্তিস্বীকার করে উত্তর দিয়েছিলেন জওহরলাল নেহরুও। সেখানে তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, ‘বন্দেমাতরম’-কে জাতীয় সঙ্গীত করার ক্ষেত্রে কোথায় সমস্যা এবং কেন ‘জনগণমন’ জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার জন্য অগ্রগণ্য। স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে ‘বন্দেমাতরম’-এর ভূমিকা যে অনস্বীকার্য, সে কথা স্বীকার করে নিয়েছিলেন নেহরুও। কিন্তু তারপরও কোন কোন মাপকাঠিতে ‘বন্দেমাতরম’-কে জাতীয় সঙ্গীত করার ক্ষেত্রে আপত্তি, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা চিঠিতে লিখেছিলেন জওহরলাল নেহরু। দেখে নিন নেহরুর সেই চিঠির বয়ান…

নয়াদিল্লী

১৫ জুন ১৯৪৮

প্রিয় বিধান,

তোমার ১৪ই জুনের চিঠির জন্য ধন্যবাদ।

‘জনগণমন’-এর ব্যাপারে তোমাকে বলি, জাতীয় সঙ্গীত কী হবে সেটা যে আইনসভাই স্থির করবেন, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। ‘বন্দে মাতরম্’-এর ব্যাপারে কয়েকজন মুসলমান যে আপত্তি করছেন, সেটাও কোনো কাজের কথা নয়। এ চিন্তাটা এখানকার অনেককেই প্রভাবিত করতে পারে নি। কিন্তু আমাদের মধ্যে অনেকেই, এবং তার সঙ্গে আমিও বিশেষ করে অনুভব করি, এখনকার পরিস্থিতিতে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ‘বন্দে মাতরম্’ একেবারেই খাপ খাচ্ছে না। ‘বন্দে মাতরম্’ আমাদের জাতীয় ভাবোদ্দীপক গান হিসেবে এখান কেন, চিরকালই মর্যাদা পাবে, কারণ এর সঙ্গে আমাদের জাতীয় সংগ্রাম ওতপ্রোত-রূপে জড়িত ছিল। কিন্তু যে গান জাতীয় সংগ্রাম ও আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করে, যেমন ‘বন্দে মাতরম্’ করেছে, – তার সঙ্গে জাতীয় সঙ্গীতের কিছুটা তফাৎ আছে। জাতীয় সঙ্গীত এমনই হবে, যাতে জয়ের কথা থাকবে, আশাপূরণের কথা থাকবে, অতীতে কী সংগ্রাম করা হয়েছে, তার কথা নয়।

জাতীয় সঙ্গীত হচ্ছে প্রধানত সঙ্গীত, কথার সমষ্টি নয়। আৎ এমন একটি সুর থাকা দরকার, যার লালিত্য থাকবে, যা তালে তালে গাওয়া যায়, আর পৃথিবীর একোণ থেকে ওকোণ পর্যন্ত বাজিয়ে ফল পাওয়া যায়। সত্যি কথা বলতে কী নিজের দেশেও এটা বাজাতে হবে, দেশের বাইরে বাজাতে হবে আরও হয়ত বেশি। আমাদের প্রত্যেকটি দূতাবাসেও এটি বাজাতে হবে। বিদেশী দূতাবাস ও অফিসগুলিও এটা বাজাবে। ‘জনগণমন’ এইভাবেই সামনে এসে গেছে, আমাদের দিক থেকে এটা তুলে ধরার চেষ্টা আদৌ করতে হয় নি। গত অক্টোবরে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ওয়ালড্রফ-অ্যাষ্টোরিয়া হোটেলে এটা বাজানো হয়েছিল। ইউনাইটেড নেশন্স-এর সভা যখন বসেছিল, তখনকার কথা। এ সঙ্গীতে একটা সাড়া পড়ে গিয়েছিল। বিদেশী প্রতিনিধি যাঁরা এসেছিলেন তাঁরা বলেছিলেন, এমন সুন্দর জাতীয় সঙ্গীতের সুর তাঁরা আর কখনো শোনেন নি। উপস্আথিত আমেরিকান ও আরও অনেকের কাছে এর বিরাট চাহিদা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সে-কথাটা শুনে আমরা এর রেকর্ড চাইলাম। আর তা পাবার পর আমরা প্রস্তাব দিলাম, সৈন্যদের ব্যান্ড পার্টি এটা বাজাতে শিখুক। দেখতে দেখতে সৈন্যদের মধ্যে এটি জনপ্রিয় হয়ে উঠলো। জাতীয় সঙ্গীত বাজাবার সময় হলে এটি এখল স্থল-বাহিনী, নৌ-বাহিনী ও বিমান-বাহিনী সবাই নিয়মিত বাজিয়ে যাচ্ছে।

আমরা বহু নাম-করা সঙ্গীত-বিশারদদের পরামর্শ নিয়েছে, তার মধ্যে বিদেশের সব থেকে বড়ো অর্কেস্ট্রা-পরিচালকও কেউ কেউ আছেন। আসলে ভালো অর্কেস্ট্রা বা মিলিটারীতে বাজানোর পক্ষে ‘বন্দে মাতরম্’ তেমন জুৎসই হচ্ছে না। ‘জনগণমন’-এর এমন একটা লালিত্য ও তাল আছে, যা ঐ কাজের পক্ষে খুবই উপযুক্ত বলে সবাই অনুমোদন করেছেন।

এইভাবে ‘জনগণমন’ যখন মিলিটারী বা অন্যান্য বাজনার ব্যাপারে অপনা থেকেই জনপ্রিয় হয়ে দাঁড়তে লাগলো, তখন আমি সব প্রদেশের রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রীদের মতামত চেয়ে চিঠি লিখলাম। দু-একটি ক্ষেত্র ছাড়া সবাই একযোগে ‘জনগণ’-এর পক্ষে মত দিলেন। আর শুধু তা-ই নয়, অধিকাংশই এ কথা জানালেন, তাঁদের প্রদেশে এই গানটি খুবই জনপ্রিয় হয়েছে।

এই রকম অবস্থায় যখন হয়ে দাঁড়ালো, তখন আমরা এখানকার মন্ত্রিসভায় বসে ঠিক করলাম, যতদিন না পাকাপাকি কোনো সিদ্ধান্ত হচ্ছে, ততদিন জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে ‘জনগণমন’ই চলতে থাকুক। এ ব্যবস্থার খুবই দরকার হয়ে পড়েছিল। কী ভারতে, কী বিদেশে, এমন সব উপলক্ষ্য হতে লাগলো, যখন জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে একটা-তকিছু বাজাতেই হবে। বারবার চাহিদা আসতে লাগলো, আর আমাদের তাতে সাড়া দিতেই হলো।

আমি এখানে কথাটা আবার বলতে চাই, জাতীয় সঙ্গীতের কথা ততটা নয়, যতটা দরকার উপযোগী সুরের। যদিও কেউ কেউ বলেন, ‘বন্দে মাতরম্’-এর তা আছে, কিন্তু আমি যতদূর বুঝতে পেরেছি তা নেই। বিশেষ করে বিদেশের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে ও সুর একেবারে অচল। জানিনা ‘জনগণমন’-কে গ্রহণ করা হবে কিনা, তবে ‘বন্দে মাতরম’-কে নেওয়া হবে কিনা সে বিষয়ে আমার ঘোরতর সন্দেহ আছে।

তাছাড়া, কথার দিক থেকে দেখতে গেলেও ‘বন্দে মাতরম্’-এর ভাষা বেশিরভাগ লোকই বুঝতে পারবে না, আমি ত নয়ই।

তোমার বিশ্বস্ত

জওহর

অর্থাৎ, এই চিঠিতে জওহরলাল নেহরু বুঝিয়ে দিয়েছেন, জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার জন্য কেন ‘জনগণমন’-ই শ্রেয়। সেক্ষেত্রে জাতীয় সঙ্গীত যে স্বাধীনতার আগের কথার বদলে, স্বাধীনতা পরবর্তী আশাপূরণ, স্বপ্নপূরণের কথা বলবে, সেই কথাই বোঝাতে চেয়েছেন নেহরু। সেই কারণে ‘বন্দেমাতরম’-এর থেকে ‘জনগণমন’ জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার দিক থেকে এগিয়ে বলেই মনে করেছিলেন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী।

নেহরুর থেকে চিঠি পাওয়ার পরেও দমে যাননি বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়। তিনি আবার পাল্টা চিঠি পাঠিয়েছিলেন জওহরলাল নেহরুকে। নেহরুর মতের সঙ্গে তাঁর কোথাও আপত্তি এবং কেন তিনি নিজের মতে অবিচল, তাও ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেন বিধানচন্দ্র রায়। ১৯৪৮ সালের ২৪ জুন সেই চিঠিতে কী লিখেছিলেন বিসি রায়? দেখুন সেই চিঠির বয়ান…

প্রিয় জওহর,

জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে ১৫ তারিখ তুমি যে চিঠিখানা লিখেছো, তা আমি খুব মনোযোগ দিয়েই পড়েছি। আমি এ নিয়ে দক্ষ মতামত দিতে পারি না, যদিও সুদূর অতীতে আমি একসময় যন্ত্রসঙ্গীত নিয়ে কিছু নাড়াচাড়া করেছিলাম। কিন্তু সে যাই হোক, তোমার চিঠির তৃতীয় প্যারাগ্রাফে যে যুক্তি তুমি দেখিয়েছো, তা আমি বুঝতে পারলাম না। ‘বন্দে মাতরম্’ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল, এবং এ গান জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে অযোগ্য বলে আমি মনে করি না। বরং এ গান ভবিষ্যৎ ভারতের প্রতিনিধিত্ব করছে, ভারতবর্ষ যা হবে, শক্তিশালী এক দেশ, সমৃদ্ধিশালী এক দেশ, সুজলা এং সুফলা, – বিজয়ের প্রতীক, প্রত্যাশা পূরণের প্রতীক। আসলে পুরনো দিনের সংগ্রামের কোনও কথাই এতে নেই।

তোমার চিঠির পরের প্যারাগ্রাফে গানের সুষম ছন্দ ও কথার প্রশ্ন তুলেছো। আমি তোমার সঙ্গে একমত যে জাতীয় সঙ্গীতের সুরে একটা সুষম ছন্দ থাকা দরকার, যা সহজেই দেশ ও বিদেশে বাজানো যাবে। গত অক্টোবরে ওয়ালড্রফ অ্যাস্টোরিয়া হোটেলে আমিও উপস্থিত ছিলাম, যখন ‘জনগণমন’ বাজানো হয়েছিল। আমি এও জানি যে, এই সুর বিদেশের প্রতিনিধিদের খুবই ভালো লেগেছিল। কিন্তু এর থেকে এই দাঁড়ায় না যে ‘বন্দে মাতরম্’কেও তেমনি সুরে গাওয়া যাবে না, সে সুর অন্য দেশের লোকদের অতোটা ভাল লাগবে না, বা আরও বেশি ভাল লাগবে না। যে ভাবেই হোক, যদি তেমন সুর করা যায়, তাহলে ‘জন-গণ-মন’-এর তুলনায় ‘বন্দে মাতরম্’ বেশি প্রাধান্য পাবে বলে আমার ধারণা। ‘জন-গণ-মন’ সেভাবে সুরারোপিত হয়েছে বলেই সেনাবিভাগ ভালোভাবে বাজাতে পেরেছে। আমার দৃঢ় ধারণা, ‘বন্দে মাতরম্’-এর সুর যদি তেমন ভালো করে করা যায়, তাহলে তারাও তা সুন্দর করে বাজাতে পারবে। চিঠিতে তুমি বলেছো বিদেশের নাম-করা সঙ্গীত-বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে ‘জন-গণ-মন’ নিয়ে আলোচনা করেছো। আমি তোমাকে অনুরোধ করবো, তুমি তাদের ‘বন্দে মাতরম্’-এর নূতন সুরটা শুনিয়ে দিয়ে তাদের মতামত জেনে নাও।

কিছু দিন আগে জাতীয় সঙ্গীত সম্পর্কিত তোমার চিঠিখানা যখন পেয়েছিলাম, তখন তোমাকে তখ্খুনি লিখেছিলাম আমার মতে, ‘জন-গণ-মন’-এর বদলে ‘বন্দে মাতরম’-কেই পছন্দ করা উচিত। তুমি মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তে জানিয়েছিলে যে, আপাতত ‘জন-গণ-মন’-কেই জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ধরা হোক। আমি তোমার কাছে প্রস্তাব দেবো, ‘বন্দে মাতরম্’-কেও ঐ রকম সুযোগ দেওয়া উচিত। নতুন সুরের ‘বন্দে মাতরম্’। এই সুর বিদেশে শুনিয়ে দেখা হোক, তারা ‘জন-গণ-মন’-এর থেকে এটা বেশি পছন্দ করে কিনা।

এবার ‘বন্দে মাতরম্’-এর ভাষা সম্বন্ধে বলি। তুমি বলেছো, এ-ভাষা অনেকেই হয়ত বুঝবে না। তুমি নিজেই বলেছো, যে অন্যের কথা ছেড়ে দিই, তুমি নিজেই ঐ গানের ভাষা বুঝতে পারো না। এ সম্পর্কে আমার বক্তব্য হলো এই যে, সে অসুবিধা ‘জন-গণ-মন’-এর বেলাতেও খেটে যায়।

জাতীয় পতাকার ব্যবহার সম্বন্ধে ভারত সরকারের নির্দেশ আমি পেলাম, কিন্তু তোমার চিঠিতে এ বিষয়ে কিছু স্পষ্ট করে বলা নেই।

তোমার বিশ্বস্ত

বিধান

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশের জাতীয় সঙ্গীত বেছে নেওয়ার সময় এভাবেই ‘বন্দেমাতরম’ অন্যতম দাবিদার হয়ে উঠে এসেছিল। জওহরলাল নেহরু ও বিধানচন্দ্র রায়ের মধ্যে এই চিঠি বিনিময়ের মধ্যেই তা উঠে এসেছে। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে ‘বন্দেমাতরম’-এর গুরুত্ব অনস্বীকার্য, সে কথা মেনে নিয়েও কেন ‘জন-গণ-মন’কেই জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে বেছে নেওয়া হল, তারও একটা আভাস পাওয়া যায় এই চিঠিগুলির মাধ্যমে।