কান্দাহার বিমান অপহরণ: কোণঠাসা বাজপেয়ী, ডোভালের কূটনীতি আর হিমস্রোত গল্প, সিনেমা দেখার আগে সত্যিটা জানুন

Kandahar Hijack: রানওয়ে ধরে দ্রুতগতিতে ছুটছিল ট্যাঙ্কারটি। এটিসির তরফে তাকে গতি কমাতে বলা হয়। নির্দেশ পেতেই বিমানের কাছাকাছি গিয়ে তড়িঘড়ি ব্রেক কষে চালক। এই ঘটনা নজর এড়ায়নি ককপিটে বসে থাকা সন্ত্রাসীদের। তাঁরা আন্দাজ করে নেয়, ভারত সরকার কোনও ফন্দি এঁটেছে।

কান্দাহার বিমান অপহরণ: কোণঠাসা বাজপেয়ী, ডোভালের কূটনীতি আর হিমস্রোত গল্প, সিনেমা দেখার আগে সত্যিটা জানুন
কীভাবে হাইজ্যাক করে কান্দাহারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বিমান?Image Credit source: TV9 বাংলা
Follow Us:
| Updated on: Sep 02, 2024 | 1:36 PM

সালটা ১৯৯৯। ২৪ ডিসেম্বর। পরেরদিনই খ্রিস্টমাস। দিন কয়েক পরে একবিংশ শতাব্দীতে পা রাখবে বিশ্ব। উৎসবের আমেজেই ছিল গোটা দেশ। ওই দিন নেপালের কাঠমাণ্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসছিল ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের ৮১৪ ফ্লাইট। সাধারণভাবে ১ ঘণ্টা ৫৫ মিনিট সময় লাগত নেপাল থেকে ভারতে আসতে। কিন্তু সেই বিমানই ভারতে ফিরল ৭ দিন পর, ৩১ ডিসেম্বরে। এতদিন তাহলে কোথায় ছিল ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বিমানটি? আফগানিস্তানের কান্দাহারে। সেখানেই ভারতীয় বিমানকে হাইজ্যাক করে নিয়ে গিয়েছিল ৫ সন্ত্রাসী। তাদের দাবি ছিল, ২০০ মিলিয়ন ডলার ও ৩৬ জন জেলবন্দি সন্ত্রাসবাদীর মুক্তি। ৭ দিন ধরে দর কষাকষির পর কীভাবে বিমানের যাত্রীদের উদ্ধার করে এনেছিল ভারত সরকার, তা রোমাঞ্চকর কোনও সিনেমার থেকে কম নয়।

কান্দাহার হাইজ্যাক ছিল ভারতের ইতিহাসে অন্যতম বড় ও সর্বশেষ বিমান অপহরণের ঘটনা। এই বিমান অপহরণের ঘটনা একদিকে যেমন দেশের জাতীয় নিরাপত্তাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছিল, তেমনই সন্ত্রাসীদের সঙ্গে পাকিস্তানের অশুভ আঁতাতকেও তুলে ধরেছিল। ১৯৯৯ সালেই কার্গিল যুদ্ধ হয়েছিল, যেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে মাথা নীচু করে হার মানতে হয়েছিল পড়শি দেশকে। সেটা যেমন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর সরকারের সাফল্য ছিল, সেখানেই সরকারকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছিল বছর শেষে এই কান্দাহার বিমান অপহরণের ঘটনা। বিমানে থাকা ভারতীয় যাত্রীদের উদ্ধার করে আনতে ভারত সরকারকে মুক্তি দিতে হয়েছিল মাসুদ আজহারের মতো কুখ্যাত জঙ্গিকে, যে পরবর্তীকালে সংসদ ভবনে হামলা থেকে শুরু করে ২৬/১১ মুম্বই হামলার মূল চক্রী ছিল।

ঠিক কী ঘটেছিল ফ্লাইট আইসি৮১৪-এ, জেনে নেওয়া যাক-

১৯৯৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর- ১১ জন ক্রু ও ১৭৯ জন যাত্রীকে নিয়ে কাঠমাণ্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দিকে রওনা দিয়েছিল আইসি ৮১৪ ফ্লাইট। ভারতীয় আকাশসীমায় প্রবেশ করে বিমানটি। সেই সময় যাত্রীদের খাবার পরিবেশন করা হচ্ছিল। হঠাৎই পাঁচজন যাত্রী উঠে দাঁড়িয়ে ক্রু সদস্যদের বলে, এই বিমান হাইজ্যাক করা হয়েছে। নির্দেশ দেওয়া হয়, যাত্রীদের খাবার যেন এখনই ফিরিয়ে নেওয়া হয়। স্কি মাস্ক পরা ওই সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের ভয়ে বিমানকর্মীরা সেই নির্দেশ মানতে শুরু করে।

এরপরে বিমানের ককপিটে ঢুকে পড়তেও বেশি সময় লাগেনি। বিমানের পাইলট ছিলেন ক্যাপ্টেন দেবী সরণ সিং। তাঁকে গানপয়েন্টে রেখে সন্ত্রাসীরা শুধু একটাই কথা বলে,”পশ্চিম দিশায় উড়তে থাকো“। কোথায় নিয়ে যাচ্ছিল তারা বিমানটিকে? পাকিস্তানে।

ভারতের আকাশসীমা পার করে পাকিস্তানে প্রবেশ করে বিমান। ক্যাপ্টেনকে বলা হয়, লাহোর বিমানবন্দরে বিমান অবতরণ করাতে। কিন্তু পাকিস্তানি এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের তরফে বিমান অবতরণের অনুমতি দেওয়া হয়নি। আকাশেই পাক খেতে থাকে বিমানটি। এদিকে, বিকেল ৪টে ৪০ মিনিট নাগাদ ভারতীয় এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলে খবর আসে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের দিল্লিগামী বিমানটিকে হাইজ্যাক করে নেওয়া হয়েছে। তৎকালীন প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি ব্রজেশ মিশ্রের কাছে আরও দেরীতে, প্রায় এক ঘণ্টা বাদে, বিকেল ৫ টা ২০ মিনিট নাগাদ বিমান হাইজ্যাকের খবর যায়।

সন্ধে ৬টা- ভারতীয় এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল আইসি ৮১৪ বিমানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। ক্যাপ্টেন দেবী সরণ সিং জানান, বিমানে জ্বালানি খুব কম। পাকিস্তানকে যেন অনুরোধ করা হয় বিমান অবতরণের অনুমতি দেওয়ার জন্য। হাইজ্যাকাররা হুমকি দিচ্ছে যাত্রীদের মেরে ফেলার।

সন্ধে সাড়ে ৬টা- ভারতীয় হাই কমিশন যোগাযোগ করে পাকিস্তানে। কিন্তু ভারতের অনুরোধ খারিজ করে দেয় পাকিস্তান। এদিকে ততক্ষণে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে কথা বলেন বিমানের ক্যাপ্টেন। তিনি বোঝান যে বিমানে অত্যন্ত কম জ্বালানি রয়েছে, আর বেশিক্ষণ ওড়া সম্ভব নয়। এরপরে তারা রাজি হয় অমৃতসরে বিমান অবতরণ করাতে। সন্ধে ৬ টা ৪৪ মিনিট নাগাদ বিমানটি পাকিস্তানের আকাশসীমা থেকে অমৃতসরের উদ্দেশে রওনা দেয়।

খেলা ঘোরাতে পারত অমৃতসর-

যারা বিমানটি হাইজ্যাক করেছিল, তারা কখনওই চায়নি বিমান ভারতে অবতরণ করাতে, কারণ এতে ভারত সরকারের অভিযান চালাতে সুবিধা হত। কিন্তু কিছু ভুলের কারণে সন্ত্রাসীদের সমস্যার বদলে সুবিধাই হয়। কী সেই ভুল? যোগাযোগ ও সমন্বয়ের অভাব।

সন্ধে ৭টা- অমৃতসর বিমানবন্দরে অবতরণ করে আইসি ৮১৪ ফ্লাইট। অনুরোধ জানানো হয় জ্বালানি ভরার। ভারত সরকার ইতিমধ্যেই একটি ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট গ্রুপ তৈরি করে। আলাদা একটি কমিটিও গঠন করা হয় , যাদের কাজই ছিল বিমানটিকে যতক্ষণ বেশি সম্ভব অমৃতসরেই আটকে রাখা।

এদিকে, বিমানে জ্বালানি ভরা হচ্ছে না। আধ ঘণ্টা কেটে যায়। হাইজ্যাকাররা এতক্ষণ যে হুমকি দিচ্ছিল, এবার তা সত্যি করে দেখায়। সতনাম সিং নামক এক যাত্রীকে ছুরি দিয়ে আক্রমণ করা হয়। পরিস্থিতি যখন জটিল হয়ে উঠছে, সেই সময় ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট গ্রুপ একটি পরিকল্পনা প্রস্তাব দেয়। বলা হয়, অয়েল ট্যাঙ্কারের ভিতরেই পঞ্জাব পুলিশের কয়েকজনকে পাঠানো হবে। বিমানে যখন জ্বালানি ভরা হবে, তখন তারা টায়ার লিক করে দেবেন, যাতে বিমানটি আর উড়তে না পারে। পরিকল্পনা ভাল হলেও, তা বাস্তবায়ন কঠিন ছিল। সেই সময় আরও একটি প্রস্তাব দেওয়া হয় যে অয়েল ট্যাঙ্কারটি বিমানের পথ আটকে দাঁড়াবে।

কান্দাহারে বিমান। সামনে গাড়িতে তালিবান সদস্যরা। AFP

অমৃতসর বিমানবন্দরে অপেক্ষা করা হচ্ছিল এনএসজি কম্যান্ডোদের। হাইজ্যাক হওয়া বিমানে জ্বালানি পৌঁছে দিতে রওনা দেয় একটি ট্যাঙ্কার। রানওয়ে ধরে দ্রুতগতিতে ছুটছিল ট্যাঙ্কারটি। এটিসির তরফে তাকে গতি কমাতে বলা হয়। নির্দেশ পেতেই বিমানের কাছাকাছি গিয়ে তড়িঘড়ি ব্রেক কষে চালক। এই ঘটনা নজর এড়ায়নি ককপিটে বসে থাকা সন্ত্রাসীদের। তাঁরা আন্দাজ করে নেয়, ভারত সরকার কোনও ফন্দি এঁটেছে। সঙ্গে সঙ্গে ক্যাপ্টেন দেবী সরণ সিংকে বলা হয় বিমান উড়িয়ে নিয়ে যেতে। ক্যাপ্টেন তখনও বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু বারংবার যাত্রীদের মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। বাধ্য হয়েই কোনওক্রমে অয়েল ট্যাঙ্কারের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়িয়েই ফের আকাশে ওড়ে আইসি ৮১৪ বিমান। এদিকে, তার জ্বালানি ভাঁড়ার ফাঁকা।

এক্ষেত্রে অভিযোগ ওঠে দেরীতে খবর পাওয়া ও তৎপরতার অভাবের। এক সূত্রে জানা গিয়েছিল, বিকেলেই বিমান হাইজ্য়াক হলেও, পঞ্জাবের তৎকালীন ডাইরেক্টর জেনারেল অব পুলিশ সরবজিৎ সিং সন্ধে ৬টা নাগাদ বিমান হাইজ্যাকের কথা জানতে পেরেছিলেন। তাও কোনও সরকারি সূত্রে নয়, টিভিতে খবর দেখে। এনএসজি কম্যান্ডোরাও দেরীতে পৌঁছয় বিমানবন্দরে, যার ফলে ততক্ষণে ফের আকাশে উড়ে যায় হাইজ্যাক হওয়া বিমানটি।

বিমানটি ফের একবার পাকিস্তানের দিকে রওনা দেয়। কিন্তু তারা কিছুতেই অবতরণ করতে দেবে না! ভারতীয় বিমানটি যাতে অবতরণ করতে না পারে, তার জন্য লাহোর বিমানবন্দরের সমস্ত লাইট পর্যন্ত নিভিয়ে দেওয়া হয়। এদিকে, জ্বালানি ফুরিয়ে আসায় অবস্থা সঙ্গীন। পাইলট বিমানটি নামাতে শুরু করেন, ক্যাপ্টেন সরণ দেখতে পান যে রানওয়ের বদলে তারা হাইওয়ের উপরে ক্র্যাশ ল্যান্ড করতে চলেছেন। শেষবারের মতো পাকিস্তানকে অনুরোধ করা হয়। এবার সাড়া মেলে। লাহোর বিমানবন্দরে অবতরণ করতে দেওয়া হয় রাত ৮টা ৭ মিনিটে। সেখানেই বিমানে অবশেষে জ্বালানি ভরা হয়।

আরও খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Tv9 বাংলা অ্যাপ (Android/ iOs)

ভারতে এই খবর পৌঁছতেই পাক সরকারের কাছে আবেদন করা হয় যে এই বিমানকে যেন আর উড়তে না দেওয়া হয়। পাকিস্তানি সেনা হাইজ্যাকারদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে। মহিলা ও শিশুদের ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করা হয়, কিন্তু সেই প্রস্তাবে কানও দেয়নি সন্ত্রাসীরা। ভারতের পরিকল্পনা ছিল, ইসলামাবাদে ভারতীয় হাইকমিশনার জি পার্থসারথীকে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে কথা বলার জন্য পাঠানো হবে। কিন্তু সেই পরিকল্পনাও ব্যাকফায়ার করে। পাকিস্তান ৩ ঘণ্টা দেরিতে হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করে। যতক্ষণে তিনি লাহোর পৌঁছন, ততক্ষণে ফের যাত্রীদের নিয়ে উড়ে গিয়েছে বিমানটি। এদিকে, দাবি পূরণ না হওয়ায় সন্ত্রাসীরা রূপেন কাটিয়াল বলে আরেক যাত্রীর উপরে হামলা করা হয়। মৃত্য়ু হয় ওই যাত্রীর।

এবার ওমানের দিকে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয় বিমানটিকে, কিন্তু সেখানেও অবতরণ করতে দেওয়া হয়নি। এরপর আমেরিকার জোরাজুরিতে দুবাইয়ে আল-মিনহাদ এয়ারবেসে রাত ৩টে নাগাদ বিমানটি অবতরণ করে। এখানে পৌঁছে ভারতের সঙ্গে কথা বলে হাইজ্যাকাররা। দীর্ঘক্ষণ দর কষাকষির পর ২৬ জন যাত্রীকে মুক্তি দেওয়া হয়। ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সেরই অন্য একটি বিমান দুবাই থেকে ওই যাত্রীদের দিল্লিতে ফিরিয়ে আনে। দুবাইতেই ভারতীয় কম্য়ান্ডোরা উদ্ধার অভিযান চালাতে চেয়েছিল, কিন্তু সংযুক্ত আরব আমিরশাহি সরকার তার অনুমতি দেয়নি।

কান্দাহার পৌছল বিমান-

দুবাই থেকে বাকি যাত্রীদের নিয়ে ফের ওড়ে বিমানটি। পরেরদিন, ২৬ ডিসেম্বর সকাল ৮টা নাগাদ আফগানিস্তানের কান্দাহার বিমানবন্দরে অবতরণ করে বিমান। সেই সময় আফগানিস্তানে তালিবানের শাসন। তালিব সরকার জানায়, তারা ভারত সরকার ও অপহরণকারীদের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে কাজ করবে। কিন্তু ভারত সরকার তো তালিবানকে সরকার হিসাবে স্বীকৃতি দেয় না! পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। বিমানবন্দরে তালিবানের সদস্যরা পৌঁছয়। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বিমান ঘিরে ফেলা হয়। তালিবানের দাবি ছিল, সন্ত্রাসীরা যাতে যাত্রীদের সঙ্গে খারাপ কিছু না করে, তার জন্যই পাহারা দিতে এসেছে। যদিও ভারতীয় কূটনীতিকদের দাবি ছিল, সাহায্য নয়, বরং ভারতীয় বাহিনী যাতে বিমানের ধারেকাছে পৌঁছতে না পারে,কোনও সামরিক অভিযান চালাতে না পারে, তার জন্যই বিমান ঘিরে রেখেছিল তালিবান।

ডোভালের মধ্যস্থতা ও মাসুদ আজহারদের মুক্তি-

২৭ ডিসেম্বর থেকে আবার শুরু হল দর কষাকষি। ইসলামাবাদ থেকে ভারতীয় হাই কমিশনার গেলেন কান্দাহার। ভারতীয় একটি টিমও পাঠানো হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তৎকালীন যুগ্ম সচিব বিবেক কাটজুর নেতৃত্বে। ওই টিমের সদস্য ছিলেন অজিত ডোভালও, যিনি ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর তৎকালীন অতিরিক্ত ডিরেক্টর ছিলেন। তিনিও কান্দাহার যান হাইজ্যাকারদের সঙ্গে আলোচনা করতে। হাইজ্যাকাররা ২০০ মিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ১৬৫০ কোটি টাকা দাবি করে। পাশাপাশি ৩৬ জন বন্দির মুক্তির দাবিও করে।

কান্দাহারে অপহৃত বিমান। AFP

উল্লেখ্য, অপহরণকারীরা সকলেই হরকত-ই-মুজাহিদ্দিনের সদস্য ছিল। যে ৩৬ জনের মুক্তির দাবি করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে ৩৩ জনই হরকতের সদস্য ছিল। মূলত পাক অধিকৃত কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিল হরকত।

এই সংগঠনের প্রধান সাজ্জাদ আফগানির মরদেহও তাদের হাতে তুলে দেওয়ার দাবি করে। দীর্ঘ আলোচনার পর ৩৬ জনের বদলে ৩ জন সন্ত্রাসীর মুক্তির বদলে বিমানের যাত্রীদের মুক্তি দিতে রাজি হয় হাইজ্যাকাররা। এরা হল মাসুদ আজহার, ওমর শেখ ও মুস্তাক আহমেদ জারগর।

৩০ ডিসেম্বর র(RAW)-র প্রধান জম্মু-কাশ্মীরে যান মাসুদ সহ বাকি দুইজনকে মুক্ত করে আনতে। সেই সময় জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লা এই মুক্তি নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন, কিন্তু পরিস্থিতি এতটাই কঠিন ছিল যে অপহরণকারীদের দাবি মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না ভারত সরকারের।

টাকার খেলা-

শুধু সন্ত্রাসীরা নয়, ভারত সরকারের থেকে টাকা আদায় করে তালিবানও। বিমানে জ্বালানি ভরা থেকে শুরু করে কান্দাহারে বিমান অবতরণ করানোর ফি বাবদ ৪০ হাজার মার্কিন ডলারের দাবি করে তালিবান। ভারত সরকার সেই প্রস্তাবে রাজিও হয়। মাসুদ আজহার, ওমর শেখ ও মুস্তাক আহমেদকে নিয়ে যে আধিকারিকরা ভারত থেকে কান্দাহার গিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে একজন জানিয়েছিলেন, সরকার আশঙ্কা করেছিল যে তালিবান আরও অর্থ দাবি করতে পারে। সেই জন্য ১ লক্ষ মার্কিন ডলার পাঠানো হয়েছিল তাদের সঙ্গে।

বিমান থেকে নামছে অপহরণকারী। AFP

তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী যশবন্ত সিং-ও ওই বিমানে যান। কান্দাহার বিমানবন্দরে পৌঁছনোর পরও প্রায় ৫০ মিনিট তাদের বিমানে অপেক্ষা করানো হয় কারণ তালিবানের বিদেশমন্ত্রী নমাজ পড়ছিলেন। এরপর যশবন্ত সিংকে বিমানবন্দরের লাউঞ্জে নিয়ে যাওয়া হয় এবং বিমানে থাকা বাকি আধিকারিকরা অপহৃত হওয়া বিমানের ভিতরে যান। সেখান থেকে যাত্রীদের উদ্ধার করে যশবন্ত সিংয়ের সঙ্গে বিমানে দিল্লিতে পাঠানো হয়। ৩১ ডিসেম্বর অবশেষে ভারতে এসে পৌঁছয় আইসি ৮১৪ বিমানটি।

হাইজ্যাকারদের কী হল?

দাবি পূরণ ও বন্দি যাত্রীদের মুক্তির পর ভারত সরকার আশা করেছিল, তালিবান ওই পাঁচজন সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করবে। তালিবানও বিবৃতিতে বলেছিল যে অপহরণকারীদের হয় আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত নয়তো অস্ত্র নামিয়ে আত্মসমর্পণ করা উচিত। কিন্তু মাসুদ সহ ৩ বন্দিকে হস্তান্তরের পর অপহরণকারীদের গ্রেফতার করা তো দূর, তালিবানের সুপ্রিম নেতার সঙ্গে গাড়িতে চাপিয়ে ওই পাঁচজন এবং মাসুদ আজহার সহ মুক্তি পাওয়া তিন সন্ত্রাসীকে নিয়ে পাকিস্তান সীমান্তে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকেই তারা পাকিস্তানে গা ঢাকা দেয়।

পাকিস্তানের ভূমিকা-

অপহরণকারী ও মুক্তি পাওয়া সন্ত্রাসীরা পাকিস্তানে আশ্রয় নিতেই গোটা ঘটনায় পাকিস্তানের ভূমিকা স্পষ্ট হয়ে যায় ভারতের কাছে। পরবর্তী সময়ে অজিত ডোভাল জানিয়েছিলেন, আইএসআই-র প্রত্যক্ষ মদত ছিল। সন্ত্রাসীদের সেফ এক্সিটের আশ্বাস দিয়েছিল তারা। আইএসআই সাহায্য না করলে, কান্দাহারে চিত্রটা অন্যই কিছু হত। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী বলেছিলেন বিমান অপহরণে পাকিস্তানের যোগ থাকার প্রমাণ মিলেছে। লালকৃষ্ণ আদবাণীও সাংবাদিক বৈঠক করে জানিয়েছিলেন যে হাইজ্যাকিংয়ে পাকিস্তান সরাসরিভাবে যুক্ত।

মাসুদ আজহারকে মুক্তি দিতে আল কায়েদা ও ওসামা বিন লাদেনও ভারতীয় বিমান অপহরণে মদত দিয়েছিল বলেও শোনা যায়। আবার দাউদেরও নাম জড়ায় এই ঘটনায়। গোয়েন্দা রিপোর্টে উঠে এসেছিল যে পাঁচ সন্ত্রাসীর মধ্যে দুইজনের ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট ছিল, যা সরাসরি কাটা হয়েছিল। বাকি তিনটি টিকিট ইকোনমিক ক্লাসের ছিল, যা কাঠমাণ্ডুর এক এজেন্টের মাধ্যমে কাটা হয়েছিল। এই টিকিট কাটতে ও বিমানবন্দরে অস্ত্র নিয়ে ঢুকতে সাহায্য করেছিল দাউদের সংগঠন।

যে তথ্য দিয়েছিল যাত্রীরা-

যারা হাইজ্যাক হওয়া বিমান থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন, তারা জানান বিমানের ভিতরে কী কী হচ্ছিল। জানা যায়,বিমানে মহিলা ও পুরুষদের আলাদাভাবে বসানো হয়েছিল। যাত্রীদের চোখ বেঁধে রাখা হচ্ছিল যাতে তাঁরা বুঝতে না পারেন যে বিমানটি কোথায় রয়েছে। তাদের নিয়মিত খাবারও দেওয়া হচ্ছিল না। সাতদিন বন্দি থেকে বিমানের অবস্থা বেহাল হয়ে গিয়েছিল। টয়লেট ওভারফ্লো হচ্ছিল, বিমানের মেঝেতেই মল-মূত্র ভাসছিল।

বিমানে মোট ৫ জন সন্ত্রাসী ছিল। এরা সকলে নিজেদের মধ্যে কোড নেমে কথা বলছিল। বিমান উদ্ধারের পর জানা গিয়েছিল অপহরণকারীরা ছিল ইব্রাহিম আখতার, শাহিদ আখতার সইদ, সানি আহমেদ কাজি, জহুর মিস্ত্রি ও শাকির। এরা সকলেই পাকিস্তানের নাগরিক ছিল। বিমানে তারা নিজেদের চিফ, ডক্টর, বার্গার, ভোলা ও শঙ্কর নামে ডাকছিল।

আঙুল ওঠে ভারত সরকারের দিকেও-

অমৃতসরেই বিমান উদ্ধারের ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছিল ভারত সরকারকে। অজিত দোভালও এই অভিযানকে ভারতের কূটনৈতিক ব্যর্থতা বলে উল্লেখ করেছিলেন। বিদেশমন্ত্রী যশবন্ত সিং চরম সমালোচনার মুখে পড়েন তালিবানের প্রশংসা করে।

সেই সময় অন্য একটি তথ্যও উঠে এসেছিল। জানা গিয়েছিল, অপহৃত বিমানে ছিলেন রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উংয়ের অফিসার শশী ভূষণ সিং তোমর, যিনি কাঠমাণ্ডুতে ভারতীয় দূতাবাসে ফার্স্ট সেক্রেটারি হিসাবে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি আবার প্রধানমন্ত্রীর সচিব এনকে সিংয়ের শ্যালক ছিলেন। একটি তত্ত্ব শোনা যায় যে তোমারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই বিমানটিকে অমৃতসর থেকে টেক অফ করতে দেওয়া হয়েছিল। যখন উদ্ধারকারী দল বিমানে যায়, তখন তাদেরও কড়া নির্দেশ ছিল কেউ যেন র-এর আধিকারিকের সঙ্গে চোখাচুখিও না হন, তাহলে অপহরণকারীরা বুঝতে পেরে তাঁকে হত্যা করতে পারে।

জইশ-ই-মহম্মদের গঠন-

কান্দাহারে যাত্রীদের প্রাণের বিনিময়ে মুক্তি পাওয়া মাসুদ আজহারই পরের বছর, ২০০০ সালে জইশ-ই-মহম্মদ জঙ্গি সংগঠন তৈরি করে, যা পরবর্তীকালে ২০০১ সালে ভারতীয় সংসদে হামলা, ২০০৮ সালে মুম্বই হামলা, ২০১৯ সালে পুলওয়ামায় হামলা চালায়।