অক্টোবর এলেই কেন বাড়ে বায়ুদূষণের মাত্রা?

লকডাউন চলাকালীন দিল্লিতে বায়ুদূষণের মাত্রা কমলেও যান চলাচল বৃদ্ধি পেতেই ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে বায়ুদূষণ। মূলত কৃষিজমিতে অবশিষ্ট খড়কুটো জ্বালানোর ফলেই এই দূষণের সৃষ্টি হয়।

অক্টোবর এলেই কেন বাড়ে বায়ুদূষণের মাত্রা?
শীত পড়তেই বাতাসে দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি পায় ।
Follow Us:
| Updated on: Nov 27, 2020 | 7:33 AM

TV9 বাংলা ডিজিটাল: শীতের এখনও প্রবেশ করেনি, তার আগেই প্রাণ ওষ্ঠাগত দিল্লিবাসীর। একে তো করোনার দাপট, তার উপর ফের মাথাচাড়া দিয়েছে বায়ুদূষণ (Air Pollution in Delhi)। প্রতিবছরই অক্টোবর মাস থেকে দিল্লি জানান দেয়, কতটা দূষিত সেই শহরের বাতাস। এরপরই দূষণ নিয়ে নেতা-মন্ত্রীদের মধ্যে দোষারোপের খেলাও শুরু হয়ে যায়।

ব্যতিক্রম হল না এই বছরও। ১৫ অক্টোবর দিল্লির বায়ু মান সূচক (AQI) এ বছরের সর্বনিম্ন মাত্রায় পৌঁছায়। এরপরই কেন্দ্রীয় পরিবেশমন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর জানান, সেইদিন খড়কুটো জ্বালানি থেকে সৃষ্ট দূষণের মাত্রা ছিল কেবল চার শতাংশ। তাঁর এই মন্তব্যের পরই প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় অরবিন্দ কেজরিওয়ালের সরকারকে। যদি খড়কুটো জ্বালানোর ফলে কেবল চার শতাংশ দূষণ হয়, তবে বিগত কয়েকদিন ধরে দিল্লির বাতাসের মান নিম্নমুখী কেন, প্রশ্ন তোলেন অনেকে।

দিল্লির বায়ুদূষণ নিয়ে বহু চর্চা-আলোচনা হলেও দূষণের কারণ জানেন না অনেকেই। দিল্লিতে বায়ুদূষণ (Air Pollution in Delhi) ঘটে বিভিন্ন কারণে। এর প্রধান কারণ অবশ্যই বাতাসে দূষিত কণার উপস্থিতি। পাশাপাশি আবহাওয়া ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির উপরও নির্ভর করে দূষণের হার।

প্রতিবছর অক্টোবরেই কেন বায়ুদূষণ (Air Pollution) বৃদ্ধি পায়?

অক্টোবর মাসেই উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে বর্ষাকাল বিদায় নেয়। বর্ষা চলাকালীন বাতাসের অভিমুখ পূর্বমুখী হয়। বঙ্গোপসাগর থেকে আসা এই বায়ুতে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ বেশি থাকায় দেশের এই অংশে বৃষ্টিপাত হয়। বর্ষাকাল শেষ হতেই বায়ুরও দিক পরিবর্তন হয়, উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে বাতাস বইতে শুরু করে। গ্রীষ্মকালেও বাতাসের অভিমুখ একই থাকে, ফলে রাজস্থান থেকে ধূলিঝড়ও এসে পড়ে এই অঞ্চলে। কখনও কখনও পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকেও ধূলিকণা বাতাসে বাহিত হয়ে চলে আসে। ২০১৭ সালে ইরাক, সৌদি আরব ও কুয়েতে হওয়া ঝড়ের ফলে কয়েকদিনের মধ্যেই দিল্লির বাতাসের গুণমানের বিপুল পতন হয়।

ন্যাশনাল ফিজ়িক্যাল ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানীরা একটি গবেষণার মাধ্যমে দেখেন যে, শীতকালে দিল্লির বাতাসের ৭২ শতাংশ আসে উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল থেকে এবং বাকি ২৮ শতাংশ আসে গাঙ্গেয় অঞ্চল থেকে। বাতাসের দিক পরিবর্তনের পাশাপাশি তাপমাত্রার পতনও দিল্লির বায়ুদূষণের একটি বড় কারণ। তাপমাত্রা কমতে শুরু করলে ইনভার্সনের উচ্চতা (যে স্তরের পর দূষিত কণা উপরিস্তরে মিশে যেতে পারে না) কমে যায়। এরফলে বাতাসে দূষিত কণার ঘনত্ব বৃদ্ধি পায়।

বাতাসের বেগ থাকলে ধূলিকণা ও দূষিত কণা ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু শীতকালে গতিবেগ বেশী না থাকায় দূষিতকণা বেশি দূর ছড়িয়ে পড়তে পারে না। মূলত এই বিষয়গুলির কারণেই দিল্লিতে বায়ুদূষণের মাত্রা বেশী। উপরি পাওনা হিসাবে খড়কুটো জ্বালানো এবং ধুলোর ঝড় দূষণের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয় ।

খড়কুটো জ্বালানোর ফলে কী হয়?

দীর্ঘদিন ধরেই দিল্লির বায়ুদূষণের (Air Pollution in Delhi) জন্য খড়কুটো জ্বালানোকেই দায়ী করা হয়। মূলত কৃষিজমিতে চাষের অবশিষ্টাংশ, যাকে আমরা চলতি খড়কুটো বলে থাকি তা চাষের জমি থেকে সহজেই ও কম খরচে পরিষ্কার করার জন্য আগুন লাগিয়ে লাগিয়ে দেওয়া হয়। একসঙ্গে ফসল কাটার পদ্ধতিতে ফসলটুকু কেটে নিয়ে বাকি অংশ রেখে দেওয়া হয়, যা বেশ কিছুটা লম্বা হয় । নতুন করে চাষ শুরুর আগে সেই অবশিষ্টাংশ পরিষ্কার করতে হয়। ভূমিগর্ভের জল সংরক্ষণের জন্য পঞ্জাব ও হরিয়ানা সরকার ২০০৯ সালে ধান বপনের সময় পিছিয়ে দেওয়ার আইন জারি করে। এই আইনের মূল উদ্দেশ্য ছিল নতুন বীজ বপনের সময় ভূগর্ভস্থ জল অতিরিক্ত মাত্রায় ব্যবহার না করে যাতে বৃষ্টির জলেই কাজ করা যায়। তবে এই নিয়মে জমি পরিষ্কারের সময় আরও কমে গেলে কৃষকদের মধ্যে এই পদ্ধতি আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিগত ১১ বছর ধরে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার এই পদ্ধতি বন্ধ করতে চাইলেও বিকল্প উপায়, যেমন হ্যাপি সিডার মেশিন যা বাজারে সহজে মেলে না এবং ছোট কৃষকদের জন্য সময় ও মূল্য সাপেক্ষ হওয়ায় জমি পরিষ্কারের জন্য এই পদ্ধতিই জারি রয়েছে ।

২০১৫ সালে আইআইটি কানপুরের (IIT Kanpur) একটি গবেষণায় দেখা যায়, শীতকালে দিল্লির বায়ুদূষণের ১৭ থেকে ২৪ শতাংশই জৈবপদার্থ জ্বালানোর ফলে হয়। বিগত কয়েক বছরে সিস্টেম অব এয়ার কোয়ালিটি অ্যান্ড ওয়েদার ফোরকাস্টিং অ্যান্ড রিসার্চ (SAFAR)একটি সিস্টেম তৈরি করেছে যা দিল্লির বায়ুদূষণে কত শতাংশ খড়কুটো জ্বালানোর মাধ্যমে হয়, তা জানাবে ।

গতবছর দেখা গিয়েছে মোট দূষণের ৪০ শতাংশই হয়েছিল কৃষিজমিতে চাষের পর পড়ে থাকা অবশিষ্ট অংশ জ্বালানোর মাধ্যমে । বিগত কয়েকদিনে দেখা গিয়েছে খড়কুটো জ্বালানোর ফলে দূষণের মাত্রা দুই থেকে চার শংতাশের মধ্যে রয়েছে , যা অন্যান্য কারণেও বায়ুদূষণের ইঙ্গিত দেয় । নভেম্বর মাসে এই দূষণের মাত্রা আরও বৃদ্ধি পাবে । মূলত ৪৫ দিন ধরে এই কৃষিজমিতে খড়কুটো জ্বালানো হয়, তবে এর প্রভাব থেকে যায় ফ্রেবুয়ারি মাস অবধি ।

দিল্লির বায়ুদূষণের (Air Pollution in Delhi) অন্যান্য কারণগুলি কী কী?

শীতকালে দিল্লিতে বায়ুদূষণের (Air Pollution in Delhi) অন্যতম দুটি উপাদান হল ধুলো এবং গাড়ির ধোঁয়া । শুষ্ক ও ঠান্ডা আবহাওয়া থাকার কারণে সমগ্র অঞ্চলজুড়ে ধূলিকণা ছড়িয়ে থাকে। IIT কানপুরের গবেষণায় দেখা গিয়েছে, PM১০-র ৫৬ শতাংশ আসে ধূলিকণার মাধ্যমেই। দিল্লিতে বায়ুদূষণের দ্বিতীয় কারণ হল যানবাহন। IIT কানপুরের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, PM২.৫-র ২০ শতাংশ আসে যানবাহনের মাধ্যমেই। সরকারের তরফ থেকে যানবাহনের দ্বারা দূষণ কমানোর নানা প্রচেষ্টা করা হয়েছে। বাজারে BS VI ফুয়েল আনা, ইলেকট্রনিক গাড়ি কেনার উপর জোর দেওয়া, এমনকি জোড়-বিজোড় পদ্ধতিও প্রয়োগ করা হয়েছে দূষণ কমানোর জন্য।

লকডাউন চলাকালীন দিল্লির বাতাসে দূষণের পরিমাণ হ্রাস পায় ও পরিষ্কার আকাশ দেখা যায় । ২০১৫ সালের পর এই প্রথম দিল্লির বাতাস এতটা পরিষ্কার ছিল। সেপ্টেম্বর মাসেও শহরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি ছিল, যার মাধ্যমে বোঝা যায় যে পরিষ্কার বাতাসের উপস্থিতি তখনও ছিল। তবে লকডাউন উঠে যাওয়ায় রাস্তায় ফের গাড়ি নেমেছে। তাপমাত্রা কমার পাশাপাশি খড়কুটো জ্বালানোর কাজ শুরু হওয়ায় দিল্লির বায়ু ফের দূষিত হতে শুরু করেছে।