অভিন্ন দেওয়ানি বিধি: বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলি হাঁটলেই কি সুগম হবে কেন্দ্রের পথ?

Uniform Civil Reforms: যেমন, গোয়া সিভিল কোডে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ। কিন্তু, গোয়ার বাসিন্দা কোনও হিন্দু পুরুষের পুত্র সন্তান না হলে তিনি দ্বিতীয় বিবাহ করতে পারেন।

অভিন্ন দেওয়ানি বিধি: বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলি হাঁটলেই কি সুগম হবে কেন্দ্রের পথ?
ছবি: সংবাদ সংস্থা
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: May 13, 2022 | 10:54 PM

সো ম না থ দা স

তিন তালাক বিরোধী আইন হয়েছে। সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ উঠে যাওয়ার পর বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা হারিয়ে কাশ্মীর এখন কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর রামমন্দির নির্মাণের কাজও শুরু হয়ে গিয়েছে। সেই জনসঙ্ঘের সময় থেকেই গেরুয়া শিবিরের স্লোগান এক বিধান, এক প্রধান, এক নিশান। এই এক বিধানের মধ্যেই পড়ে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বা ইউনিফর্ম সিভিল কোড, ইউসিসি। দেশের প্রথম রাজ্য হিসাবে বিজেপি-শাসিত উত্তরাখণ্ডে যে কাজ চলছে। জোরকদমে। বিধানসভা ভোটের আগে উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামী প্রতিশ্রুতি দেন, ক্ষমতায় এলে রাজ্যে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কার্যকর করবেন। সম্প্রতি তিনি জানিয়েছেন, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালুর জন্য কমিটি তৈরি হয়েছে। খুব তাড়াতাড়িই সেই কমিটি তাদের প্রথম খসড়া রিপোর্ট সরকারের কাছে জমা দেবে। সূত্রের খবর, উত্তরাখণ্ডের ধাঁচেই অন্যান্য বিজেপি-শাসিত রাজ্যেও অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালুর ভাবনা আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। ভোপালে দলীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে মধ্য প্রদেশে এই আইন চালুর জন্য পদক্ষেপের নির্দেশ দিয়েছেন অমিত শাহ। মনে করিয়ে দিয়েছেন, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করা, লোকসভা ভোটের আগে দেওয়া বিজেপির রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি। এই বিল সংসদে এলেই, প্রবল বিরোধের সম্ভাবনা। তাই বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে আগে আইন পাশ করিয়ে পরিস্থিতির আঁচ পাওয়ার চেষ্টা। পরে আগামী লোকসভা ভোটের আগেই তা সংসদে আনার ভাবনা। বিজেপি এই পথেই হাঁটছে বলে অনেকেই মনে করছেন।

কী দেওয়ানি বিধি:

বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার, দত্তক নেওয়ার মতো কয়েকটি ক্ষেত্রে দেশে নানা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের আলাদা আলাদা নিজস্ব আইন বা পার্সোনাল ল’ আছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রায় দুশো জনজাতির মানুষ তাঁদের নিজস্ব আইন মেনে চলেন। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু হলে সব ধর্মের সকলেই বিবাহ, উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিষয়গুলিতে একইরকম পারিবারিক আইন মানতে বাধ্য হবেন। অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ডের অস্তিত্ব থাকবে না। পুষ্কর সিং ধামীই শুধু নন। অন্যান্য বিজেপি-শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরাও ইউনিফর্ম সিভিল কোড নিয়ে সরব হতে শুরু করেছেন। যেমন আমাদের প্রতিবেশী রাজ্য অসম। লোয়ার অসমের নানা ঘটনার রেশ মাঝেমধ্যেই উত্তর বাংলায় এসে পড়ে। জাতীয় নাগরিকপঞ্জি কিংবা সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে জটিল বিতর্কের গোড়াটাই তো অসমে। এই মুহূর্তে অসম রাজনীতির এক পরীক্ষাগার। উত্তরাখণ্ডের তুলনায় এখানে জনবিন্যাসও অনেকটাই অন্যরকম। পঁয়তিরিশ শতাংশ মুসলিম এবং চার শতাংশ খ্রিস্টান রয়েছেন। যে যুক্তিতে তিন তালাক নিষিদ্ধ হয়েছে অনেকটা সেই ঢঙেই অভিন্ন দেওয়ানি বিধির পক্ষে মুখ খুলেছেন অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা। কোনও মুসলিম মহিলা কি চান যে তাঁর স্বামী একাধিক বিয়ে করুন? প্রশ্ন ছুড়েছেন তিনি। তবে, দেওয়ানি বিধি সংশোধন করা নিয়ে বিজেপির শরিক দলগুলির মধ্যেই আপত্তি রয়েছে। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার এ নিয়ে মুখ খোলেননি। তবে, তাঁর ঘনিষ্ঠ নেতা বিহারের মন্ত্রী অশোক চৌধুরীর মন্তব্য, অভিন্ন দেওয়ানি বিধির কোনও প্রয়োজন নেই। এতে সামাজিক সংহতির ক্ষতি হবে।

নানা ধর্মে নানা আইন

হিন্দু, মুসলিম, খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ব্যক্তিগত আইন বা নিজস্ব দেওয়ানি বিধির সাংবিধানিক স্বীকৃতি রয়েছে। হিন্দুদের ব্যক্তিগত আইনে নাবালক সন্তানের প্রথম অভিভাবক বাবা, দ্বিতীয় অভিভাবক মা। কিন্তু, বিবাহ বহির্ভূত সন্তানের ক্ষেত্রে আবার প্রথম অভিভাবক মা, দ্বিতীয় অভিভাবক বাবা। কোনও অভিভাবক যদি হিন্দুধর্ম ত্যাগ করেন, তাহলে তিনি অভিভাবকত্ব হারাবেন। পুত্র সন্তান না থাকলে হিন্দু দম্পতি পুত্র সন্তান দত্তকও নিতে পারেন। মুসলিম ব্যক্তিগত আইনেও দত্তক নেওয়া যায়। কিন্তু, যাকে দত্তক নেওয়া হচ্ছে তাকে কখনই পুত্র বলা যায় না। কোনও মুসলিম স্ত্রী ও সন্তানের সম্মতি ছাড়া সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশের বেশি অন্য কাউকে উইল করে দিয়ে যেতে পারেন না। শিয়া ও সুন্নিদের ব্যক্তিগত আইনেও ফারাক আছে। যেমন, সুন্নি ব্যক্তিগত আইনে গর্ভস্থ সন্তান উত্তরাধিকারী বলে বিবেচিত হয় না। হিন্দু ব্যক্তিগত আইনে বহুবিবাহের সংস্থান না থাকলেও মুসলিম আইনে সেটা আছে। খ্রিষ্টানদের ব্যক্তিগত আইনে স্বামী ধর্ম পরিবর্তন করলে স্ত্রী বিবাহবিচ্ছেদ চাইতে পারেন। সবমিলিয়ে বিষয়টা খুবই জটিল।

ব্যক্তিগত আইনে মহিলাদের অবমাননা

যে দেশে সংবিধান সাম্যের কথা বলে, সে দেশে ধর্মীয় পরিচিতির ভিত্তিতে ব্যক্তিগত আইন আদৌ থাকতে পারে কিনা এনিয়ে বিতর্ক বরাবরই রয়েছে। সংবিধান আমাদের মৌলিক অধিকার দিয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে, সাম্যের অধিকার। যার মধ্যে রয়েছে ধর্মাচরণের অধিকারও। এই দুই অধিকারের সূত্র ধরেই ব্যক্তিগত আইন থাকা না থাকার বিষয়টি বারবার সামনে এসেছে। সুপ্রিম কোর্ট তাৎক্ষণিক তিন তালাক নিষিদ্ধ করার পরে বিভিন্ন ব্যক্তিগত আইন, সাংবিধানিক আর্দশের বিরুদ্ধে কিনা এ নিয়ে বিতর্ক আরও তীব্র হয়েছে। নানা ব্যক্তিগত আইনের বিরুদ্ধে শীর্ষ আদালতে নানা সময়ে মামলা হয়েছে। নানা আইনের নানা ধারা অসাংবিধানিক বলে অতীতে আদালত খারিজও করেছে। যেমন হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে বাবার সম্পত্তিতে মেয়েদের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে লতা মিত্তল মামলায় শীর্ষ আদালতের রায়ে। মূল আইনে যে সমানাধিকার ছিল না। ব্যক্তিগত আইনগুলি সব সময় মহিলাদের প্রতি বৈষম্য করে এসেছে বলে আদালতে বহুবার পিটিশন হয়েছে। যেমন, খ্রিস্টান ব্যক্তিগত আইনে স্বামীর অন্য মহিলার সঙ্গে সম্পর্ক থাকলে স্ত্রী বিবাহবিচ্ছেদ চাইতেই পারেন না। কিন্তু, উল্টোটা হলে স্বামী সহজেই বিবাহিত সম্পর্কে ইতি টানতে পারেন। ব্রিটিশ আমলারা ব্রিটেনে তাঁদের স্ত্রীদের রেখে আসতেন। আর ভারতে এসে অন্য সম্পর্কে জড়াতেন। তাঁদের স্বার্থরক্ষায় ব্যক্তিগত আইনের দোহাই দিয়ে মহিলাদের প্রতি বৈষম্যমূলক এই প্রথা দীর্ঘদিন চালু ছিল। অনেক পরে এই আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পার্সি মহিলারা, পার্সি নন এমন কাউকে বিয়ে করলে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হন। আবার, নন-পার্সি কোনও মহিলা, কোনও পার্সিকে বিয়ে করলে, স্বামীর সম্পত্তির অর্ধেক পান। বাকিটা পান না। এই বৈষম্য নিয়ে পার্সি সম্প্রদায়ের মধ্যেই বিতর্ক চলছে। প্রায় সব ধর্মেই ধর্মাচরণের নামে পিতৃতন্ত্রের উপাদানে ভরা মহিলাদের প্রতি অবমাননাকর নানা প্রথা রয়েছে। সুতরাং, ধর্মাশ্রিত আইনেও যে তা থাকবে, এতে আর আশ্চর্য কী।

নির্দেশমূলক নীতি

স্বাধীনতার পর গণপরিষদে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করা নিয়ে বিতর্ক হয়। বহু ধর্মীয় সম্প্রদায়, জনজাতির মানুষ যে দেশে থাকেন। যে দেশের সবেমাত্র নতুন জন্ম হয়েছে। সেখানে সাধারণ মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা চিন্তা করে শুরু থেকেই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালুর পক্ষে রায় দেয়নি গণপরিষদ। কিন্তু, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সেই দায়িত্ব দিয়ে যায় তারা। দেশ চালাতে সরকারের নীতি কী হবে। সংবিধানের ছত্রিশ থেকে একান্ন নম্বর অনুচ্ছেদে তা বলা আছে। যাকে বলা হয়, নির্দেশমূলক নীতি। এই নির্দেশমূলক নীতির চুয়াল্লিশ নম্বর অনুচ্ছেদে বলছে, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালুর জন্য রাষ্ট্রকে উদ্যোগ নিতে হবে। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কি ধর্মাচরণের মৌলিক অধিকার ভঙ্গ করবে? রয়েছে এ প্রশ্নও। তবে, ১৯৭৬ সালে সংবিধান সংশোধন করে বলা হয় নির্দেশমূলক নীতি প্রয়োগ করার জন্য আইন তৈরি হলে তা মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী বলে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। গণপরিষদে, মুসলিম সদস্যরা চাননি যে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু হোক। হিন্দু সদস্যরাও যে সবাই চেয়েছিলেন, এমন কিন্তু নয়। বাবাসাহেব আম্বেদকর বলেন, কোনও সরকারেরই উচিত হবে না যে এমনভাবে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করা যাতে মুসলিমরা বিদ্রোহ করেন। আবার গণপরিষদ সভাপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদের মত ছিল, মুসলিমদের প্রগতিশীল করার জন্য অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু হলে তা হিন্দুদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে। সর্দার প্যাটেল, পট্টভি সীতারামাইয়া, মদনমোহন মালব্য, কৈলাসনাথ কাটজুরা সেদিন হিন্দু আইন সংস্কারের বিরোধিতাই করেছিলেন। তবে, দেশের নানা হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্ট নানা সময়ে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালুর কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। ২০১৯-এর সেপ্টেম্বরে একটি মামলায় সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ ছিল, সর্বত্র অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু, রাষ্ট্রের কাজ। কিন্তু, এখনও তা করা হয়নি। মনে রাখা দরকার তুরস্ক, মিশরের মতো মুসলিম-প্রধান দেশেও সম্পত্তির অধিকার সংক্রান্ত আইনে ধর্মের প্রভাব নেই।

শাহ বানো মামলা

কংগ্রেস আমলের একটা ঘটনার কথা না বললে দেওয়ানি বিধি নিয়ে কিছু বলাই হবে না। সালটা ১৯৭৮। ইনদওরে বাষট্টি বছরের বৃদ্ধা শাহ বানো বিবাহবিচ্ছেদের পর প্রাক্তন স্বামীর কাছে খোরপোশ চেয়ে মামলা করেন। মুসলিম পার্সোনাল ল’-এ ইদ্দত নামে মোটের ওপর তিনমাসের একটি সময়সীমা রয়েছে। বিচ্ছেদের পর কিংবা স্বামী মারা গেলে এই তিন মাস অপেক্ষা করার পর কোনও মুসলিম মহিলা আবার বিয়ে করতে পারেন। শাহ বানোর প্রাক্তন স্বামী মহম্মদ আহমেদ খান আদালতে নিজের প্রাক্তন স্ত্রীর পিটিশন চ্যালেঞ্জ করেন। তাঁর যুক্তি ছিল প্রথা অনুযায়ী তিনি শুধুমাত্র ইদ্দতের সময়টুকুর জন্য খোরপোশ দিতে বাধ্য। তা তিনি দিয়েওছেন। এরপরে আর কোনও খোরপোশ তিনি দেবেন না। এই যুক্তিতে খানের পাশে দাঁড়িয়ে আদালতে সওয়াল করে অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড। হাইকোর্টে খান হারেন। হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে ১৯৮৫ সালে সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয়, বিচ্ছেদের পর সাধারণ আইন অনুযায়ী সব ভারতীয়ই প্রাক্তন স্ত্রীকে খোরপোশ দিতে বাধ্য। তাই শাহ বানো খোরপোশ পাবেন। সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওয়াইভি চন্দ্রচূড় এই রায় দেন। প্রধানমন্ত্রী তখন রাজীব গান্ধী। তাঁর ওপর প্রবল চাপ তৈরি হয়। রাতারাতি পাশ হয় নয়া আইন। Muslim Women Protection on Divorce Act, 1986. যে আইনে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে নস্যাৎ করে দেওয়া হয়। বলা হয়, ইদ্দতের পর স্বামীকে আর খোরপোশ দিতে হবে না। স্ত্রী যদি আর্থিক ভাবে অক্ষম হন তাহলে ওয়াকফ বোর্ড খোরপোশ দেবে। শাহ বানো সুপ্রিম কোর্টে এই আইনকে চ্যালেঞ্জ করেন। সুপ্রিম কোর্ট আইন বহাল রাখে। পরে শাহ বানো খোরপোশের মামলা প্রত্যাহার করে নেন। ভোটের কথা ভেবে সেদিন রাজীব গান্ধী পিছিয়ে যান। আর মহিলাদের সমানাধিকারের বিষয়টিও চলে যায় পিছনের সারিতে।

কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগ

মোদী সরকারের আমলে কেন্দ্রীয় স্তরেও অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে ইতিমধ্যেই নড়াচড়া হয়েছে। ২০১৬ সালেই ভাবনাচিন্তা শুরু করে দেয় সরকার। বিষয়টি আইন কমিশনের কাছে পাঠানোও হয়। তবে, একুশতম আইন কমিশন তাদের রিপোর্টে জানায়, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালুর প্রয়োজন নেই। আর তা কাম্যও নয়। ২০১৮ সালে ২১তম আইন কমিশনের মেয়াদ ফুরিয়ে যায়। পরে সরকার সংসদে জানায় অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালুর বিষয়টি বাইশতম আইন কমিশনের কাছে পাঠানো হবে। যদিও, বাইশতম আইন কমিশন এখনও তার কাজ শুরু করেনি। দেশজুড়ে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করা হবে। একথা জন্মলগ্ন থেকেই বলে আসছে বিজেপি। সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে ইউনিফর্ম সিভিল কোড চালু করার দাবি তোলেন। বাজেট অধিবেশনে আবার আরেক বিজেপি সাংসদ কিরোরীলাল মিনা রাজ্যসভায় এ নিয়ে প্রাইভেট বিল আনার জন্য নোটিস দেন। হিজাব বিতর্কের সূত্রেও বিভিন্ন মহল থেকে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির দাবি তোলা আরম্ভ হয়েছে। তবে, বিরোধীরা সরকারের উদ্দেশ্য নিয়েই প্রশ্ন তুলছে। তাদের অভিযোগ আসলে একটি সম্প্রদায়কে টার্গেট করতে চাইছে বিজেপি। কিছুদিন আগেই দিল্লিতে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির পক্ষে সওয়াল করেন সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরও শবরীমালা মন্দিরে মহিলাদের পুজো দেওয়া রুখতে পথে নেমেছিল বিজেপি। সেই উদাহরণ সামনে রেখে দ্বিচারিতার অভিযোগ করছে বিরোধীরা।

রাজ্য কি পারে?

দেশের কোনও রাজ্য কি আলাদাভাবে নিজেদের রাজ্যে ইউসিসি চালু করতে পারে? যখন কোনও কেন্দ্রীয় আইন নেই, তখনও পারে কি? যেমন, উত্তরাখণ্ড বলছে। এনিয়েও রয়েছে দ্বিমত-বিতর্ক। বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, দত্তক, উত্তরাধিকারের মতো দেওয়ানি বিধির গোড়ার বিষয়গুলি সংবিধানে যৌথ তালিকায় রয়েছে। যৌথ তালিকায় থাকা কোনও বিষয়ে রাজ্যের আইনের সঙ্গে কেন্দ্রের আইনের সংঘাত তৈরি হলে রাজ্যের আইন বাতিল হয়ে যায়। তবে, রাজ্যের ওই আইনে যদি রাষ্ট্রপতি সম্মতি দেন, তাহলে সেই আইন চালু থাকে। শাহ বানো মামলায় রাজীব গান্ধী সংসদে Muslim Women Protection on Divorce Act পাস করিয়েছিলেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন কোনও রাজ্য, যদি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি পাস করায়, তা হলে, এইরকম আইনের সঙ্গে সংঘাত বাধতে পারে। সে ক্ষেত্রে, রাজ্যওয়াড়ি ভিত্তিতে সম্মতি লাগবে রাষ্ট্রপতির। যা কিছুটা হলেও বেনজির বটে। সংবিধানে, নির্দেশমূলক নীতিতে বলা আছে, স্টেট সারা দেশে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কার্যকর করবে। সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখানে স্টেট শব্দের অর্থ, কেন্দ্র। রাজ্য নয়। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালুর আর্জি নিয়ে ২০১৯ সালে বিজেপি নেতা অশ্বিনী উপাধ্যায় দিল্লি হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা করেন। সে মামলাতেও কেন্দ্র হলফনামা দিয়ে বলে, এই বিষয়ে আইন তৈরির অধিকার একমাত্র সংসদের আছে। সংসদের এক্তিয়ারে আদালত যেন হস্তক্ষেপ না করে।

গোয়া সিভিল কোড

বিতর্ক-আলোচনা নেহাৎ কম হয়নি। আগামী দিনেও হবে। তবে, এই দেশেই এমন একটা রাজ্য রয়েছে, যেখানে বকলমে ইউনিফর্ম সিভিল কোড চালু। গোয়া। অন্য নামে অবশ্যই। ইউসিসি-র যে সাধারণ ধারণা তার থেকেও বেশ কিছুটা আলাদা। তবুও বলা যায়, মোটের ওপর গোয়ার প্রায় সমস্ত বাসিন্দাকেই একটিই কোড মেনে চলতে হয়। ১৯৬১ সালে গোয়া ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। সাবেক পর্তুগিজ কলোনি ঠিক করে, তারা পর্তুগিজ সিভিল কোডই ফলো করবে। সেইমতো, ১৯৬২ সালে, গোয়া-দমন-দিউ প্রশাসনিক আইন পাস হয়। যার জেরে গোয়ায় হিন্দু এবং মুসলিমদের ব্যক্তিগত আইন কার্যত খারিজ হয়ে যায়। তবে, ওই যে আগে বলা হল, ইউনিফর্ম সিভিল কোড থেকে গোয়া সিভিল কোড কিছুটা হলেও আলাদা। যেমন, গোয়া সিভিল কোডে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ। কিন্তু, গোয়ার বাসিন্দা কোনও হিন্দু পুরুষের পুত্র সন্তান না হলে তিনি দ্বিতীয় বিবাহ করতে পারেন। স্বাধীনতার চোদ্দো বছর পর বিস্তর কাঠখড় পুড়িয়ে গোয়াকে ভারতের অংশ করা হয়। ফলে, সেখানকার পরিস্থিতি অনেকটাই আলাদা ছিল। কিন্তু, ভারত এক বিশাল এবং বৈচিত্রে ভরা দেশ। নানা ধর্ম, নানা, জাতি, নানা সংস্কৃতি, নানা প্রথা। এই বৈচিত্র, এই সহাবস্থানকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আলাদা আলাদা দেওয়ানি বিধি কি জরুরি? নাকি সাম্যের অধিকার, নারী-পুরুষের সমানাধিকারের মত সংবিধানের গোড়ার বিষয়গুলি যাতে কখনও এতটুকুও লঙ্ঘিত না হয়, সেইজন্য অভিন্ন দেওয়ানি বিধিই কাম্য? রাষ্ট্র ও বৃহত্তর সমাজকেই এর উত্তর খুঁজতে হবে।