বিশ্লেষণ: নিজের হাতে গড়ে তুলেছিল আফগানিস্তানকে, সেখানেই আজ ‘গুরুত্বহীন’ কেন ভারত?

পরিস্থিতি সামাল দিতে তালিবানদের সঙ্গে আলোচনার দরজা খুলে দিয়েছে ভারত। কাবুলে ভারতীয়দের সুরক্ষা ও আফগানিস্তানের সঙ্গে সুসম্পরিক বজায় রাখতেই তালিবানের সঙ্গে আলোচনায় বসার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বিশ্লেষণ: নিজের হাতে গড়ে তুলেছিল আফগানিস্তানকে, সেখানেই আজ 'গুরুত্বহীন' কেন ভারত?
অলঙ্করণ: অভীক দেবনাথ।
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Jul 17, 2021 | 1:18 PM

নয়া দিল্লি: আফগানিস্তানে বিস্তৃত হচ্ছে তালিবানি অবস্থান। একের পর এক প্রদেশ দখল নিচ্ছে তালিবান (Taliban) সন্ত্রাসবাদীরা। তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে পাকিস্তান(Pakistan)-ও। আফগান সরকারের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি জারি করেছে ইসলামাবাদ। জানানো হয়েছে, সীমান্ত থেকে তালিবানদের সরানোর চেষ্টা করলে পাল্টা আগাত হানবে পাক বায়ুসেনা। টুইট করে এ কথা জানিয়েছেন আফগানিস্তানের ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালেহ। তাঁর দাবি, সীমান্তে তালিবানকে মদত জোগাচ্ছে পাক বায়ুসেনাই। ইতিমধ্যেই আফগান-পাক সীমান্তে স্পিন বলডক এলাকা তালিবানিদের দখলে চলে গিয়েছে। এই পরিস্থিতি বড়ই টালমাটাল অবস্থান “মিত্র দেশ” ভারতের। কয়েক দশক ধরে সাহায্যের হাত বাড়ালেও আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনও ভূমিকাই রাখতে পারছে না ভারত। কিন্তু কেন এমন হল?

আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি ও ভারতের অবস্তান সম্পর্কে জানতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে কিছুটা। বিগত ২০ বছর ধরে সযত্নে যে সম্পর্ক গড়া হল, তা এক নিমিষে কীভাবে “গুরুত্বহীন” হয়ে পড়ল?

আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের সূচনা:

১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল অবধি তালিবান শাসনে থাকার পর মার্কিন সেনার নেতৃত্বে ন্যাটোবাহিনী যখন আফগানিস্তান পুনরুত্থানের কাজ শুরু করেছিল, তখন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল ভারতও। আফগানিস্তানই একমাত্র দেশ, যেখানে ভারত প্রায় ৪০০-রও বেশি প্রকল্পে কাজ করেছে। সেখানের রাস্তাঘাট থেকে বাঁধ, বিদ্যুৎ, স্কুল ও হাসপাতাল-সবকটি ক্ষেত্রকেই পুনর্গঠিত করতে সাহায্য করেছিল ভারত। এখনও অবধি ভারত প্রায় ৩০ লক্ষ ডলার খরচ করেছে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে।

আফগানিস্তানের উন্নয়নে ভারতের সাহায্য:

২০১১ সালে ভারত আফগানিস্তান কূটনৈতিক চুক্তির মাধ্যমে ভারত উন্নয়নমূলক কাজে বিনিয়োগ করতে থাকে। আফগানিস্তানে ভারতের তৈরি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলি হল-

সালমা বাঁধ- ২০১৬ সালে হেরাতে ৪২ মেগাওয়াটের এই হাইড্রোপাওয়ার প্রকল্পটির উদ্বোধন করা হয়। এটি ফ্রেন্ডশিপ বাঁধ হিসাবেও পরিচিত।

জ়ারান্জ-দেলারাম হাইওয়ে- আফগানিস্তান-ইরান সীমান্তের কাছে বিআরও-র অধীনে ২১৮ কিমির এই হাইওয়েটি তৈরি করা হয়। কাজ করতে গিয়ে ১১ জন ভারতীয় ও ১২৯ জন আফগানিস্তানের কর্মীরও মৃত্যু হয়। আফগানিস্তানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সড়কপথ এটি।

সংসদ- কাবুলে অবস্থিত আফগানিস্তানের সংসদ ভবনটিও ভারতের তৈরি। ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই সংসদ ভবনের উদ্বোধন করেন। ভবনের একটি ব্লকের নাম প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর নামে নামাঙ্কিত করা হয়।

স্তর প্রাসাদ- ২০১৬ সালে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসরাফ ঘানি ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই প্রাসাদটির উদ্বোধন ও সংরক্ষণের দায়িত্ব নেন। ১৯ শতাব্দীতে তৈরি এই প্রাসাদটি আফগানিস্তানের স্বাধীনতার সাক্ষী।

বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা- কাবুলে বিদ্যুৎ সংযোগ বাড়ানোর জন্য ২২০ কিলোভোল্টের একটি ট্রান্সমিশন লাইনও তৈরি করা হয় পুল-ই-খুমরি থেকে।

স্বাস্থ্যক্ষেত্রে উন্নয়ন- কাবুলে ইন্দিরা গান্ধীর নামে তৈরি হাসপাতাল পুনর্গঠনে যেমন সাহায্য করেছিল ভারত, তেমনই ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল মিশনের অধীনে হাজারো মানুষের চিকিৎসা করা হয়, যারা যুদ্ধে গুরুতর আহত হয়েছিলেন। বাদাখাস্তান, কান্দাহার, কুনার, নিমরুজ়, নুরিস্তান, পাখতিয়া সহ একাধিক জায়গায় ভারত চিকিৎসাকেন্দ্র তৈরি করেছে।

পরিবহন ক্ষেত্রে সাহায্য- আফগানিস্তানে পরিবহন ব্যবস্থায় সুবিধার জন্য ভারতের তরফে ৪০০টি বাস, ২০০টি মিনিবাস, ২৮৫টি মিলিটারি যান, ১০টি অ্যাম্বুলেন্স, ৩টি এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান দিয়েছে।

এছাড়াও স্কুলের জন্য বেঞ্চ, বিভিন্ন গ্রামে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থা ও কাবুলে সুলভ শৌচালয়ও তৈরি করেছে ভারত। এছাড়াও আফগান পড়ুয়াকে বৃত্তি, বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করেছে ভারত সরকার। বর্তমানে কাবুলে শাটুট বাঁধের কাজ চলছে, যা ২০ লক্ষ মানুষের পানীয় জলের সংস্থান করবে।

অলঙ্করণ: অভীক দেবনাথ।

দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পর্ক:

পাকিস্তানের হাজারো আপত্তি ও বাধা উপেক্ষা করেই ২০১৭ সাল থেকে এয়ার ফ্রেট করিডরের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক আদানপ্রদান শুরু করা হয়। ভারত থেকে প্রায় ৯০০ মিলিয়ন ডলার ও আফগানিস্তান থেকে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য আদান প্রদান হয়েছে। আফগানিস্তান থেকে মূলত ফল ও ড্রাইফ্রুট রফতানি করা হয় ভারতে। এ দিকে, ভারত থেকে ওষুধ, চিকিৎসা সামগ্রী, কম্পিউটার, সিমেন্ট ও চিনি রফতানি করা হয়।

কান্দাহার বিমান হাইজ্যাক:

সুসম্পর্ক স্থানের প্রচেষ্টার মাঝেই তালিবান শাসন চলাকালীনই ঘটে যায় কান্দাহার বিমান হাইজ্যাকের ঘটনা। যেখানে তৎকালীন অটলবিহারী বাজপেয়ীর সরকার বাধ্য হয় মাসুদ আজহার, মুস্তাক আহমেদ জাগির ও উমর সইদের মতো জঙ্গিদের ছেড়ে দিতে।

১৯৯৯ সালে নেপালের কাঠমান্ডু থেকে দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসছিল ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের এয়ারবাস এ৩০০। কিন্তু উড়ান শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই বিমানের দখল নিয়ে যায় পাঁচ মুখোশধারী জঙ্গি। প্রথমে অমৃতসর, তারপর লাহোর ও দুবাই হয়ে শেষে আফগানিস্তানের কান্দাহারে বিমান অবতরণ করতে বাধ্য করা হয়।

পরিস্থিতি সামাল দিতে ছুটে যান তৎকালীন বিদেশ মন্ত্রী যশবন্ত সিংহ। সঙ্গে যান ভারতের বর্তমান নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল। তাঁর নেতৃত্বেই বন্দি যাত্রীদের উদ্ধার করা হয়। তার বদলে ছেড়ে দিতে হয় ভারতে বন্দি থাকা কুখ্যাত জঙ্গি হয় মাসুদ আজহার, মুস্তাক আহমেদ জাগির ও উমর সইদকে। সেই সময় অজিত দোভাল বলেছিলেন, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই যদি মদত না দিত, তবে সহজেই ভারত গোটা বিষয়টি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারত এবং জঙ্গিদের মুক্তি ছাড়াই বন্দি যাত্রীদের উদ্ধার করে আনতে পারত।

Kandahar Plane hijack

অলঙ্করণ: অভীক দেবনাথ।

ভারতের অবস্থান:

মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের পর থেকেই ভারতের অবস্থান নিয়ে উঠেছিল প্রশ্ন। চলতি বছরেই মার্কিন সফরে গিয়ে বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেছিলেন, “আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার নিয়ে তাড়াহুড়ো যেন না করে আমেরিকা। সেনা প্রত্যাহারের বিষয়টি যথেষ্ট স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বিগত ২০ বছরে আফগানিস্তানে যে সুরক্ষা ও সুবিধাব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে, তা রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি।”

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সম্প্রতিই জানিয়েছেন যে, ৯/১১ হামলার ২০ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই আফগানিস্তান থেকে সম্পূর্ণরূপে সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। কেবল দূতাবাস ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান মিলিয়ে হাজার খানেক সেনা আফগানিস্তানে মজুত থাকবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিগত ২০ বছর ধরে আফগানিস্তানে সেনা অবস্থানের জন্য আমেরিকার বিপুল অর্থ খরচ হয়েছে। সেই খরচ আর বহন করতে চায় না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেই কারণেই এই সিদ্ধান্ত।

এ দিকে, মার্কিন সেনা একবার ফিরে গেলেই আইএসআই-র নিয়ন্ত্রণাধীন হাক্কানি গোষ্ঠী ফের একবার ভারত বিরোধী কার্যকলাপে সক্রিয় হতে পারে। পশ্চিম এশিয়ার ইসলামি জঙ্গিগোষ্ঠীগুলিও তালিবানদের মদতে ফের হামলা চালাতে পারে। এই চুক্তি বাস্তবায়িত হলে কাশ্মীরে জেহাদিদের কার্যকলাপ বাড়বে এবং সেই কাজে মদত জোগাবে পাকিস্তান।

পরিস্থিতি সামাল দিতে তালিবানদের সঙ্গে আলোচনার দরজা খুলে দিয়েছে ভারত। কাবুলে ভারতীয়দের সুরক্ষা ও আফগানিস্তানের সঙ্গে সুসম্পরিক বজায় রাখতেই তালিবানের সঙ্গে আলোচনায় বসার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে গত সপ্তাহেই রাশিয়া সফরে গিয়ে সে দেশের বিদেশমন্ত্রীর সঙ্গেও আফগানিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। বৈঠকে রাশিয়ার বিদেশমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ জয়শঙ্করকে জানান, তালিবানরা আফগানিস্তানেই আধিপত্য সীমাবদ্ধ রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সুতরাং রাশিয়াও সে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাবে না। কিন্তু ভারতের বিদেশমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যের বিরোধিতা করে জানান, হিংসার পথ আশ্রয় করে যদি আফগানিস্তান দখল নেয় তালিবান, তবে তা সমর্থন করা যায় না।

অলঙ্করণ: অভীক দেবনাথ।

এই মন্তব্যের পরই তালিবানদের সঙ্গে বৈঠক যে বিশ বাঁও জলে চলে গিয়েছে, তা বোঝাই যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে ভারতের মার্কিন প্রীতি নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। দীর্ঘদিন ধরেই পরিস্থিতি খারাপ হওয়া সত্ত্বেও কেন ভারতীয় নাগরিকদের আগেই আফগানিস্তান থেকে সরিয়ে আনা হয়নি, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। তবে অতীতে সাহায্যের খতিয়ান দেখে বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েও ফের একবার আফগান সরকারের দিকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে ভারত সরকার, এমনটাই ধারণা কূটনীতিবিদদের।

গত সপ্তাহেই বিদেশমন্ত্রকের বিবৃতিতে বলা হয়, “আফগানিস্তানের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে ভারত। ভারতীয় কর্মীদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমাদের কাছে।” বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচীও এক বিবৃতিতে বলেন, “কান্দাহারে ভারতের দূতাবাস বন্ধ করা হয়নি। তবে কান্দাহার শহরের কাছে তালিবানি অভ্যুত্থানের কারণে ভারতীয় কর্মীদের আপাতত ফিরিয়ে আনা হয়েছে। পরিস্থিতি স্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত দূতাবাসের কাজকর্ম সচল রাখার জন্য একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। আফগানিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার দেশ হিসাবে ভারত সেখানে শান্তিপূর্ণ, সার্বভৌম ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফেরানোর জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”

অন্যদিকে, আফগানিস্তানের তরফেও তালিবানদের সঙ্গে আলোচনায় বসার কথা রয়েছে। সেই আলোচনা বিফল হলে ভারতের কাছ থেকে সাহায্য চাইতে পারে আফগানিস্তান। ভারতে আফগানিস্তানের রাষ্ট্রদূত জানিয়েছেন, প্রযুক্তিগত সাহায্য বা সামরিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সাহায্য করতে পারে ভারত। আরও পড়ুন: কেরল থেকে কলকাতা আসতে কতক্ষণ? ‘জ়িকা’ নিয়ে কতটা প্রস্তুত বাংলা?

COVID third Wave