চিকিৎসাধীন ৬০ শতাংশ করোনা রোগী ‘হাই রিস্ক’ তালিকায়, চরম উদ্বেগে স্বাস্থ্য দফতর
রোগীদের মধ্যে ৬০ শতাংশই স্বাস্থ্য দফতরের পরিভাষায় ‘হাই রিস্ক’ তালিকার অন্তর্গত। আর তাই দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা দু’হাজারের ঘরে এলেও স্বস্তিতে থাকতে পারছেন না স্বাস্থ্য দফতরের (West Bengal Health Department) কর্তাব্যক্তিরা
সৌরভ দত্ত: আপাত স্বস্তির আড়ালে কি উদ্বেগের পরিসংখ্যান! স্বাস্থ্য ভবন সূত্রে খবর, বঙ্গে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে কোভিড (COVID 19) আক্রান্ত চিকিৎসাধীন রোগীদের মধ্যে ৬০ শতাংশই স্বাস্থ্য দফতরের পরিভাষায় ‘হাই রিস্ক’ তালিকার অন্তর্গত। আর তাই দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা দু’হাজারের ঘরে এলেও স্বস্তিতে থাকতে পারছেন না স্বাস্থ্য দফতরের (West Bengal Health Department) কর্তাব্যক্তিরা।
শনিবার রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের তথ্য বলছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ২১৫৫ জনের দেহে করোনা ভাইরাসের (Coronavirus) অস্তিত্ব মিলেছে। মৃত্যু হয়েছে ৪৩ জনের। স্বাস্থ্য দফতরের টুইটার হ্যান্ডেলে শনিবার রাতের সর্বশেষ আপডেট বলছে, আক্রান্তদের মধ্যে ৩৯২৫ জন রোগী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। সেই চিকিৎসাধীন রোগীদের মধ্যে ৬০ শতাংশ রোগী স্বাস্থ্য দফতরের পরিভাষায় ‘হাই রিস্ক’ বা সঙ্কটজনক। শুক্রবার সন্ধ্যায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছিল, ৩৫০৮ জন। সেই তালিকায় শুধু সঙ্কটজনক রোগীর সংখ্যাই হল ২২০৭! ‘মিডিয়াম রিস্কে’র তালিকায় ৫৫৬ জন এবং ‘লো রিস্ক’ ৭৪৫ জন কোভিড আক্রান্তের রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, শারীরিক অবস্থার নিরিখে করোনা আক্রান্তদের তিন ভাগে ভাগ করেছে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। স্বাস্থ্য দফতরের ড্যাশবোর্ডে তিন পর্যায়ের রোগীকে চিহ্নিতকরণের ক্ষেত্রে ভিন্ন রং ব্যবহার করা হয়েছে। সঙ্কটজনক রোগীর নামের পাশে রয়েছে লালকালি। মিডিয়াম এবং লো রিস্কের রোগী বোঝাতে ব্যবহার করা হয়েছে কমলা এবং হলুদ রং। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, শুক্রবার সন্ধ্যার তথ্য অনুযায়ী কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ১৮৫ জন সঙ্কটজনক রোগী চিকিৎসাধীন ছিলেন। এম আর বাঙুরের ক্ষেত্রে সেই সংখ্যা ২০৮। বেসরকারি হাসপাতালগুলির মধ্যে আমরি গ্রুপের তিনটি হাসপাতালে সঙ্কটজনক করোনা রোগী রয়েছেন ৯১ জন। পিয়ারলেস এবং আর এন টেগোরে সেই সংখ্যা যথাক্রমে ৭৭ এবং ৪৭ জন।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের একাংশের বক্তব্য, নভেম্বরের শেষেও বাংলায় দৈনিক করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছিল সাড়ে তিন হাজার। তিন সপ্তাহের মধ্যে তা দু’হাজারের ঘরে চলে আসা বড় দিনের আগে স্বস্তির খবর। কিন্তু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের মধ্যে ৬০ শতাংশ রোগী ‘আশঙ্কাজনক’ হলে তা কার্যত অস্বস্তিরই নামান্তর। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, কোভিডে যে সকল রোগীর মৃত্যু হচ্ছে, তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগই ‘আশঙ্কাজনক’ তালিকার অন্তর্গত।
এ ধরনের রোগীর সংখ্যায় এই বৃদ্ধির কারণ কী? জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের একাংশ জানাচ্ছেন, নমুনা পরীক্ষা করানো নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে অনীহার কারণে হাসপাতালে সিসিইউ-আইসিইউ রোগীর সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। শীতের মরসুমে করোনা উপসর্গকে সাধারণ জ্বর-কাশি ভেবে অনেকে ভুল করছেন। যতক্ষণে করোনার উপস্থিতি টের পাচ্ছেন ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। উল্টোদিকে নমুনা পরীক্ষায় ‘ফাঁকি’ দেওয়ার প্রবণতা রোধে যে দাওয়াই প্রয়োগের জরুরি ছিল তা ভ্যাকসিনের মতোই এখনও অমিল। স্বাস্থ্য দফতরের পরিসংখ্যানের মধ্যেই সেই আভাস রয়েছে। গত ৬ ডিসেম্বর ৪৪১৮৬ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৩১৪৩ জন কোভিড পজিটিভের সন্ধান মিলেছিল। পরদিন এক ধাক্কায় একদিনে নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা দশ হাজার কমে যায়! স্বাস্থ্য দফতরের করোনা বুলেটিন থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ৭ ডিসেম্বর চব্বিশ ঘণ্টায় ৩১৪৫৩ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ২২১৪ জনের দেহে ভাইরাসের অস্তিত্ব মিলেছে। ১৩ এবং ১৪ ডিসেম্বরের পরিসংখ্যানেও একই জিনিস লক্ষ্য করা গিয়েছে। ১৩ ডিসেম্বর ৪১২১৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করে কোভিড পজিটিভ হয়েছেন ২৫৮০ জন। পরদিন একচল্লিশ হাজার থেকে চব্বিশ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩১৬৭১। আর করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ২৫৮০ থেকে কমে হয়েছে ১৮৩৪! প্রশ্ন হল, একদিনের ব্যবধানে এই তারতম্য কী ভাবে সম্ভব?
আরও পড়ুন: পোলিও-সচেতনতায় নিউটাউনে হল সাইকেল ব়্যালি
কমিউনিটি মেডিসিনের প্রফেসর কুণাল মজুমদার বলেন, “হাই রিস্ক ক্যাটেগরির রোগীদের মধ্যে পঞ্চাশোর্ধ্ব কো-মর্বিডিটি রোগীর সংখ্যা বেশি। এ ধরনের রোগীরা উপসর্গ থাকা সত্ত্বেও সময়ে টেস্ট না করায় সমস্যা বাড়ছে। হাসপাতালে যখন আসছেন তখন শারীরিক জটিলতা অনেক বেড়ে গিয়েছে। এ জন্যই রাজ্যে দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যা কমলেও প্রতিদিনের মৃত্যুর সংখ্যায় খুব একটা হেরফের ঘটেনি। মানুষে আগের মতো আর সতর্ক নন সেটাও ঘটনা।”
শনিবার হাতেকলমে সেই অভিজ্ঞতা হয়েছে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ তথা চিকিৎসক অনির্বাণ দলুইয়ের। তিনি জানান, এদিনই এমন এক রোগীকে তিনি দেখেছেন যিনি করোনা উপসর্গের উপস্থিতিকে গত সাতদিন ধরে অগ্রাহ্য করেছেন। শেষ পর্যন্ত শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়ায় ওই চিকিৎসকের দ্বারস্থ হন। তাঁর কথায়, “কোভিড পজিটিভ ধরা পড়ার পরে চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে যাঁরা রয়েছেন তাঁরা কিন্তু তুলনামূলক ভাবে ভাল আছেন।” স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ, নমুনা পরীক্ষা নিয়ে সরকারি স্তরে আরও প্রচার হওয়া উচিত। রোগীকে নমুনা পরীক্ষার গুরুত্ব বোঝানোর ক্ষেত্রে চিকিৎসকদেরও ভূমিকা রয়েছে।
আরও পড়ুন: অটো খুঁজে কর মকুবের প্রচার করতে হবে না চিকিৎসকদের, নতুন বার্তা স্বাস্থ্য বিভাগের
মেডিকা’র ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটের চিকিৎসক অমিতাভ সাহা বলছেন, নমুনা পরীক্ষায় অনীহা একটা দিক আরেকটা দিক হল অল্পবয়সী করোনা আক্রান্তদের খুব একটা হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছে না। অন্য শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি কোভিডে আক্রান্ত বয়স্ক রোগীরা গুরুতর অসুস্থতার শিকার হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। এই সংখ্যাটা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাঁর মতে, “ইনফ্লুয়েঞ্জা নিউমোনিয়ার মতো একটা সময় আসবে যখন কোভিডে হাই রিস্ক ক্যাটেগরির রোগীরাই ভর্তি হবেন!”