Dumdum: দুই ফুটফুটে মেয়ের মৃত্যু, আর্তনাদ, ক্ষতিপূরণ, রাজনীতি… ৪৮ ঘণ্টায় যা যা দেখল বান্ধবনগর

Dumdum Electocution Death: রাজনীতিকদের 'আমরা-ওরা' চাপা পড়ে গেল সন্তানহারা দুই মায়ের বুকফাটা আর্তনাদে।

Dumdum: দুই ফুটফুটে মেয়ের মৃত্যু, আর্তনাদ, ক্ষতিপূরণ, রাজনীতি... ৪৮ ঘণ্টায় যা যা দেখল বান্ধবনগর
একজন মা তাঁর ঔরসজাত সন্তান, স্নেহ, সহায়, সম্বল হারালেন। সেই ক্ষতির মেরামতি কি কোনও ২ লক্ষ টাকার চেক করতে পারে?
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Sep 24, 2021 | 11:04 PM

সুমন মহাপাত্র: ক্ষতিপূরণ ২ লক্ষ টাকা। কিন্তু সব ক্ষতি কি আদৌ পূরণ করা যায়? এই প্রশ্নটাই আরও একবার প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠল দমদমের বান্ধবনগরের ঘটনার পর। দু’টো ফুটফুটে তরতাজা প্রাণ হঠাৎ করেই আর নেই। বিকেলে পড়তে বেরিয়ে স্নেহা ও অনুষ্কাকে ফিরতে হল শববাহী গাড়িতে। রাজনীতিকদের ‘আমরা-ওরা’ চাপা পড়ে গেল সন্তানহারা দুই মায়ের বুকফাটা আর্তনাদে।

“আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দিন, আমি ওকে ছাড়া বাঁচবো না”, শেষ ৪৮ ঘণ্টায় এই আর্তনাদ শুনেছে সারা বাংলা। কিন্তু তা রাজনীতিকদের কানে পৌঁছতে ১৮ ঘণ্টার বেশি সময় কেটে গেল। অবশেষে বান্ধবনগরের ঝিলপাড়ে এক গোড়ালি জলে পা ভেজালেন বিধায়ক, সাংসদ। ঘোষণা করলেন ২ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ। যা এলাকাবাসীদের মধ্যেই একটা প্রশ্ন তুলে দিল, কতটা যথার্থ এই ক্ষতিপূরণ? একজন মা তাঁর ঔরসজাত সন্তান, স্নেহ, সহায়, সম্বল হারালেন। সেই ক্ষতির মেরামতি কি কোনও ২ লক্ষ টাকার চেক করতে পারে?

২২ সেপ্টেম্বর বিকেল প্রায় সওয়া ৫ টা তখন। বান্ধবনগরের ফ্ল্যাটবাড়ি থেকে বেরিয়েছিল ক্লাস সিক্সের অনুষ্কা। সপ্তাহের বাকি পাঁচটা দিনও এই সময়েই সে বাড়ি থেকে বেরোত। প্রথমে যেত বন্ধু পাখির বাড়ি। সেখান থেকে প্রাইভেট টিউশন। এই বিকেলটা যে বাকি পাঁচটা বিকেলের মতো হবে না, সেটা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি অনুষ্কার মা প্রিয়াঙ্কা।

ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি তখন থেমে গিয়েছে। পড়ার ব্যাগ নিয়ে অনুষ্কা গেল বন্ধু স্নেহা বণিক (পাখি)-এর বাড়ি। টিউশন শুরুর সময় তখনও হয়নি। দুই বন্ধু খেলার ছলেই গিয়েছিল জল দেখতে। বান্ধবনগর চার মাথার মোড়ে তখন হাঁটু সমান জল। উল্টো দিক দিয়ে একটা গাড়ি আসছিল (কেউ বলছে লরি, কেউ বা বলছে দুধের গাড়ি)। সেই গাড়ি থেকে ছিটিয়ে আসা জল থেকে বাঁচতে গিয়ে ড্রেনে পড়ে যায় পাখি। ল্যাম্পপোস্ট ধরে ওঠার চেষ্টা করতেই শরীরে ধাক্কা মারে ২২০ ভোল্টের কারেন্ট। পাখির ওই অবস্থা দেখে তার দিকে হাত বাড়ায় অনুষ্কা। কয়েক মুহূর্তেই সব শেষ।

রাতে এই খবর ছড়াতেই একাধিক সংবাদ মাধ্যম ভিড় জমায় বান্ধবনগরে। তখনও দক্ষিণ দমদমে হাঁটু জল। পরদিন সকাল হতেই পাখির বাড়ি থেকে অনুষ্কার বাড়ি পর্যন্ত লম্বা লাইন ক্যামেরা আর সাংবাদিকের। TV9 বাংলা অনুষ্কার বাড়ি গিয়ে দেখল, প্রিয়াঙ্কা নন্দীর চোখের জল ততক্ষণে শুকিয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণ আবেগ আটকে রাখার পর বুক ফেটে বেরিয়ে এল শুধুই হতাশা। আমাদের প্রতিনিধিকে প্রথমেই তিনি জানালেন, স্থানীয় কাউন্সিলর (বর্তমানে পুর প্রশাসক মণ্ডলীর সদস্য) সুরজিৎ রায় চৌধুরীর শাস্তি চাই! কারণ “জলটা না জমলে আমায় তো আর মেয়েকে হারাতে হত না।” পুর প্রতিনিধির বিরুদ্ধে তাঁর বিস্তর ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, রাস্তার যা অবস্থা কাল অন্য কোনও মায়েরও কোল খালি হয়ে যেতে পারে।

ততক্ষণে ওই এলাকার সাংসদ সৌগত বেফাঁস মন্তব্য করে বলে বসেছেন, “ওই দু’টি মেয়ের বেরনোর কথা ছিল না!” যা শুনে শোকাতুর মায়ের চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরছে। পাল্টা তিনি বলেন, “সৌগত রায় কি তান্ত্রিক? স্পটে না থেকে তিনি কী করে এই মন্তব্য করছেন।” পরক্ষণেই মায়ের আবেদন, “যদি তান্ত্রিক হন, আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দিন।” তখনও মৃত স্নেহা বণিক বা প্রিয়াঙ্কা নন্দীর বাড়িতে সাংসদ-মন্ত্রীর পা পড়েনি।

আরও কয়েক ঘণ্টা বাদে প্রিয়াঙ্কা নন্দীর বাড়ির সামনে তোড়জোড়। এলেন পুর প্রতিনিধি। তাঁকে দেখেই ক্ষোভ উগরে দিলেন স্নেহার মা। এরপর ফের শুরু প্রস্তুতি। সৌগত রায় ও ব্রাত্য বসু আসছেন। স্নেহা বণিকের বাড়ির সামনে চেয়ার পাতা হল। কেটলিতে চা বসল। সাংসদ এসে স্নেহা বণিকের দাদুকে আশ্বাস দিলেন। সংবাদ মাধ্যমের সামনে ২ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করলেন। তখনও এই মৃত্যুতে রাজনীতির রঙ লাগেনি। কিন্তু এরপর সাংসদের সামনেই জমা জল, খোলা বিদ্যুতের ল্যাম্প পোস্ট নিয়ে প্রশ্ন তোলা শুরু করেন সাধারণ মানুষ। হাজির হন মহিলা কংগ্রেসের নেতৃত্বও। ব্যাস, তারপর মৃত্যু-শোক সব ভুলে দুই পক্ষের হাতাহাতি। স্নেহা বণিকের বাড়ির সামনে চরম বিশৃঙ্খলা। শোকের আবহ মুহূর্তেই বদলে গেল রাজনৈতিক বচসায়।

স্নেহা বণিকের বাড়ির পর অনুষ্কা নন্দীর বাড়ি যান সাংসদ-মন্ত্রী, সঙ্গী পুরসভার চেয়ারম্যান। ২ লক্ষ টাকার ক্ষতিপূরণের আশ্বাস সেখানেও। কিন্তু সন্তানহারা মা বলেন, “আমি জায়গা জমি বাড়ি বিক্রি করে ৪ লক্ষ টাকা দিচ্ছি। আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দিন।”

২৩ সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর ২৪ সেপ্টেম্বর বান্ধবনগরে পা পড়ে পদ্ম শিবিরের। ৩৬ ঘণ্টা পর খোদ রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার ও সাংসদ অর্জুন সিং ‘পাশে আছি’ বলতে যান। প্রিয়াঙ্কাও সাফ জানিয়ে দেন, কোনও ‘পার্টি পলিটিক্স’ চাই না। পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েই ফিরে আসেন বিজেপি নেতারা।

দুই ফুটফুটে মেয়ের বেঘোরে মৃত্যু, শোক, সন্তাপ, রাজনৈতিক দড়ি টানাটানি; গত ৪৮ ঘণ্টায় সবই দেখে নিল দমদমের বান্ধবনগর। কিন্তু সাধারণ মানুষের মনে যে প্রশ্নগুলো এই দুর্ঘটনার আগে থেকে ঘুরপাক খাচ্ছিল, তার কোনও সদুত্তর মিলল না। দীর্ঘদিন ধরে জমা জল, কেন হুঁশ নেই প্রশাসনের? একাধিক ল্যাম্প পোস্টের তার খোলা, কী করছে পুরসভা? পাশে দাঁড়ানো, বা নৈতিক দায় নেওয়ার বদলে কেন দায় অন্যের ঘাড় চাপাতে ব্যস্ত জনপ্রতিনিধিরা? ঘটনার পর ৩৬ ঘণ্টা কেটে যাওয়ার পরই বা বিরোধী দলের ঘুম ভাঙল কেন? মৃত্যু নিয়ে আর কতদিন, কেনই বা রাজনীতি হবে এই রাজ্যে?

মানুষের মনে প্রশ্ন অনেক। কিন্তু মানুষের ভোটে নেতা হওয়া জনপ্রতিনিধিদের কাছে আপাতত এই প্রশ্নগুলির উত্তর নেই। অদূর ভবিষ্যতেও উত্তর মিলতে পারে, এমন কোনও আশা দেখা যাচ্ছে না।

আরও পড়ুন: Dumdum: ‘ভিক্ষা করে টাকা দেব, মেয়ে ফিরিয়ে দিন’, পুর প্রতিনিধির বিরুদ্ধে আইনি যুদ্ধে দমদমের পরিবার