Historic blunder and Jyoti Basu: জ্যোতি বসুকে কেন প্রধানমন্ত্রী করা হয়নি? সত্যিই কি ‘ঐতিহাসিক ভুল’ ছিল?
PM Proposal for Jyoti Basu: ১৯৯৬ সালের ১১ মে। ক্ষমতা যখন দুয়ারে কড়া নাড়ছে, দিল্লিতে দু’দিন ধরে বসেছে পলিটব্যুরোর বৈঠক। আলোচনার বিষয়বস্তু, কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে তৃতীয় ফ্রন্টের সরকার গঠন। সেই সরকারে সিপিএম-এর ভূমিকা এবং জ্যোতি বসু প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন কিনা!
কাটা ঘায়ে নুনের ছিটের মতো শনিবার সীতারাম ইয়েচুরির স্মরণসভায় বিতর্ক উস্কে দিয়েছিলেন ছিয়াশি বছরের ফারুক আবদুল্লা। যে দিন ভাল ভাল কথা বলাই রীতি, সেদিন উল্টো গেয়ে ফেলেছেন উপত্যকার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু যা সত্য, তা তো যে কোনও মুহূর্তেই বেরিয়ে আসতে পারে। স্থান-কাল-পাত্র ভেবে বা দিনক্ষণ পাঁজি দেখে যে আসে না তার প্রমাণ সেদিনের দিল্লির তালকাটোরা স্টেডিয়াম। ১৯৯৬ সালে ‘সোনার হরিণ’ হাত ছাড়া হওয়ার প্রসঙ্গ বেশ অযাচিতভাবেই সীতারামের স্মরণসভায় তুললেন ন্যাশনাল কনফারেন্সের ‘ঠোঁটকাটা’ নেতা ফারুখ আবদুল্লা। সভায় উপস্থিত অনেকেই সিপিএমের বা বলা ভাল বামফ্রন্টের ‘সোনার হরিণ’ হাতছাড়া হওয়ার সাক্ষী। আবদুল্লা বললেন, “যখন আমরা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী করতে চেয়েছিলাম, তখন এই দলের নেতারা তাতে সায় দেননি।” হঠাৎ এ প্রসঙ্গ তুললেন কেন? স্মরণ যদি করতেই হয়, সত্যকেই স্মরণ করা উচিত, তাই হয়ত আবদুল্লা শুধু সীতারামের ভালটাই স্মরণ করেননি, তার পিছনে যে বিতর্ক, সেটাও মনে করিয়ে দিয়েছেন সবার সামনে। জ্যোতি বসু কেন প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি, তার অন্তরায় যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম সীতারাম ইয়েচুরি। সেই দলে অবশ্যই ছিলেন প্রকাশ কারাট, ভিএস অচ্যুতানন্দন, এস আর পিল্লাইরাও।
এদিন সেই প্রকাশ কারাটদের সামনে আবদুল্লা আরও বললেন, ‘সে দিন জ্যোতি বসু প্রধানমন্ত্রী হলে, দেশের নকশাই অন্য রকম হত।’ জ্যোতি বসু প্রধানমন্ত্রী হলে দেশ কেমন হত, এ চর্চা নিরন্তর। কিন্তু কেন জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী করা গেল না, যেখানে সব দিক থেকে গ্রিন সিগন্যাল ছিল? কেন ৭ রেস কোর্স যাওয়ার পথে লাল কার্ড দেখিয়ে জ্যোতি বসুকে মহাকরণেই বসিয়ে রাখা হল? মজা করে সাংবাদিক এম জে আকবর বলেছিলেন, লাল কেল্লায় জ্যোতিবাবুকে যেতে দিননি লাল ফৌজই। সত্যি কি তাই?
এক বার নয়, চার চারবার সুযোগ:
‘নায়ক’ সিনেমায় অনিল কাপুর ওরফে শিবাজী রাও গায়কোয়াড় মাত্র ২৪ ঘণ্টার জন্য মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। রাজ্য শোধরাতে পারেননি, কিন্তু ২৪ ঘণ্টার মুখ্যমন্ত্রিত্বে কতটা কী করা যায়, তা সুন্দরভাবে দেখানো হয়েছিল। আর সেখানে জ্যোতিবাবুর কাছে চার চারবার প্রধানমন্ত্রীত্বের প্রস্তাব আসে। ভাব যায়! নায়ক সিনেমা ২০০১ সালে রিলিজ হয়েছিল। যদি নব্বইয়ের দশকে রিলিজ হত, তাহলে তাত্ত্বিক আলোচনা ছেড়ে কিছুটা ‘অনুপ্রেরণা’ নিতেই পারত রক্ষণশীল সিপিএম।
১৯৯০: রামমন্দির তৈরির আবেগ উস্কে রথযাত্রা নিয়ে উত্তাল গো-বলয়। বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণীর নেতৃত্বে রথযাত্রা শুরু হয়। বেশ কিছু জায়গায় সাম্প্রদায়িক হিংসা শুরু হয়ে যায়। বিহারে লালকৃষ্ণ আডবাণীকে গ্রেফতার করে লালু প্রসাদের সরকার। আর তার প্রতিবাদে প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহের সরকারের উপর থেকে সমর্থন তুলে নেয় অটল বিহারী বাজপেয়ীর বিজেপি। এমন সময় পরিস্থিতি সামলাতে জ্যোতি বসুর কাছে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন রাজীব গান্ধী। কিন্তু সে প্রস্তাব পত্রপাঠ খারিজ করে দিয় সিপিএম-এর কেন্দ্রীয় কমিটি।
আবার সাত মাস পর চন্দ্রশেখর সিং সরকারের উপর থেকে কংগ্রেস সমর্থন তুলে নিলে। সে সময়ও রাজীব গান্ধী প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু সে দিনও নাকি আর্জি মঞ্জুর করেনি সিপিএম-এর কেন্দ্রীয় কমিটি। এই তথ্য পাওয়া যায়, প্রাক্তন আমলা তথা তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্তর উপদেষ্টা অরুণ প্রসাদ মুখ্যোপাধ্যায়ের আত্মজীবনী থেকে।
১৯৯৬: ছিয়ানব্বইয়ের সাধারণ নির্বাচনের আগেই টের পাওয়া যাচ্ছিল কংগ্রেস ভাল ফল করবে না। দুর্নীতির কাঁটাতারে জেরবার কংগ্রেস। অন্যদিকে, হিন্দুত্বের পালে হাওয়া লাগিয়ে বিজেপির রথ দৌড়াচ্ছে। যে কোনও মুহূর্তে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে পারে বাজপেয়ীরা, এমন আশঙ্কা কংগ্রেস-সহ আঞ্চলিক দলগুলির মধ্যে প্রবলভাবে তৈরি হয়েছিল। তাই অবিজেপি, অকংগ্রেসি একটা তৃতীয় ফ্রন্টটের ভাবনা দানা বাঁধছিল। নির্বাচনের ফল সেই সম্ভাবনাকে আরও মজবুত করে তোলে। কেউ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। ১৬১ আসন পায় বিজেপি। এক ধাক্কায় বৃদ্ধি পায় ৪১টি আসন। কংগ্রেসের (ইন্দিরা) আসন কমে দাঁড়ায় ১৪০। জনতা দল ৪৬। সিপিএম ৩২। ফ্রন্ট হিসাবে দেখলে বামফ্রন্টই তৃতীয় সর্বোচ্চ শক্তি। এ অবস্থায় রাষ্ট্রপতি শঙ্কর দয়াল শর্মা বিজেপিকেই প্রথম সুযোগ দেয় সরকার গড়ার। দু’সপ্তাহ সময় দেওয়া হয়। শত চেষ্টা করেও আস্থা অর্জন করতে পারেননি অটল বিহারী বাজপেয়ী। ১৩ দিনের বাজপেয়ী সরকারের পতন হয়।
এরপরে সুযোগ আসে কংগ্রেসের। এই ১৩ দিনে গঙ্গা-যুমনা দিয়ে আরও জল বয়ে গিয়েছে। অকংগ্রেসি তৃতীয় ফ্রন্ট তৈরির সম্ভাবনা আরও পোক্ত হয়েছে। তাই পি ভি নরসীমার কংগ্রেস ১৪০ আসন নিয়ে সরকার গড়ার স্বপ্নই দেখেনি। রিলে রেসের মতো ক্ষমতার মশাল আসে জনতা দলের দোরগোড়ায়। ভি পি সিং দ্বিতীয় বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আর্জি খারিজ করে দেন পত্রপাঠ। সঙ্গে পরামর্শ, এই মুহূর্তে এই মশাল এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যোগ্য উত্তরসূরি একমাত্র জ্যোতি বসু। অতএব মশাল এসে পৌঁছয় সিপিএম-র দুয়ারে। এরপর…
নাম যখন জ্যোতি বসুর
ক্ষমতা বলে হয়তো বামফ্রন্ট সরকার গঠনে সাহায্য করতেই পারে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর পদ! এই ‘পরশমণি’ হাতে নেওয়ার স্পর্ধা সিপিএম-এ আর কার আছে! জ্যোতি বসুর যোগ্যতা নিয়ে বিতর্ক হয়তো দলের অন্দরে ছিল না। জ্যোতি বসু পারতেন। কারণ, প্রায় দু’দশকের সফল জোট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী তিনি। জ্যোতি বসু সম্বন্ধে এমজে আকবর লিখছেন, “জওহরলাল নেহেরু জমানা দিয়ে সংসদীয় রাজনীতি, ইন্দিরা গান্ধী জমানায় তা আরও পোক্ত। তাঁর ঝুলিতে রয়েছে কমিউনিজমকে জাতীয় স্তরে তুলে ধরার দীর্ঘ লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা। তাই তাঁর সরকার থেকে সহজে হাত তুলে নিতে দু’বার ভাবত কংগ্রেস। আই কে গুজরালের সরকারের উপর সমর্থন তুলে নিতে কংগ্রেস কিন্তু ভাবেনি। কংগ্রেস জানত, জ্যোতি বসুর কাছে আছে ‘স্ট্রিট অ্যান্ড স্টেট ক্রেডেবিলিটি’।”
জ্যোতির পক্ষে এবং বিপক্ষে তর্কবিতর্ক:
১৯৯৬ সালের ১১ মে। ক্ষমতা যখন দুয়ারে কড়া নাড়ছে, দিল্লিতে দু’দিন ধরে বসেছে পলিটব্যুরোর বৈঠক। আলোচনার বিষয়বস্তু, কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে তৃতীয় ফ্রন্টের সরকার গঠন। সেই সরকারে সিপিএম-এর ভূমিকা এবং জ্যোতি বসু প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন কিনা!
ভোটের প্রচারে বারবার জ্যোতি বসু বলেছেন, কোয়ালিশন যুগ এসে গিয়েছে। এ নিয়ে নদিয়া পুরভোটের প্রচারে এসে প্রণব মুখোপাধ্যায় কটাক্ষের সুরে বলেছেন, ৬০-৬৫টি বামপন্থী আসন নিয়ে জ্যোতিবাবু কি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন? কিন্তু বাস্তবে জ্যোতি বসু এই প্রস্তাবে না-হ্যাঁ কিছু বলেননি। পার্টির উপর ছেড়ে দিয়েছিলেন। একটা সুশৃঙ্খল কমিউনিস্ট পার্টির এটিই বৈশিষ্ট। নেতা যতই বড় হোক না কেন,নিয়ন্ত্রণ করবে পার্টিই। জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী করার প্রস্তাবে লালু প্রসাদ যদব, মুলায়ম সিং, পাসোয়ানদের পূর্ণ সমর্থন ছিল। কিন্তু পালিটব্যুরোয় দেখা গেল নানা ফ্যাঁকড়া।
১) পার্টি কর্মসূচির ১১২ খ ধারা অনুযায়ী, যে সরকারকে প্রভাবিত করার শক্তি নেই, সেখানে যাবে না সিপিএম। সেই কারণেই, মোরারজি সরকার গঠনের সময়ও সরকারে অংশগ্রহণ করেনি সিপিএম। কংগ্রেস সমর্থিত যুক্ত ফ্রন্টের সরকারের স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন ছিল। এই সরকার ব্যর্থ হলে পুরো দায় চাপবে সিপিএম-এর উপর। আর যদি জ্যোতিবাবু প্রধানমন্ত্রী হন, ষোলোআনা দায়ই সিপিএম-এর উপর বর্তাবে।
২) উদার অর্থনীতির পথে হাঁটবে কিনা সেটাও ভেবে দেখেছিল কেন্দ্রীয় কমিটি। মনমোহন সিং যে অর্থসংস্কারের রূপরেখা তৈরি করেছিলেন, সেই বাজেট পেশ করতে হতে পারে জ্যোতিবাবুকে। প্রণব মুখোপাধ্যায় তাই সাবধানবাণী শুনিয়ে রেখেছিলেন, ধর্মনিরপেক্ষ সরকারকে সমর্থন করবে কংগ্রেস, যদি অর্থসংস্কারের পথে হাঁটে। অর্থাৎ প্রতি পদে পদে কংগ্রেসকে সমঝে চলতে হবে। না হলে যে কোনও মুহূর্তে সমর্থনের হাত তুলে নেবে।
৩) পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্টের অন্যতম হাতিয়ার ছিল ভূমি সংস্কার। এ ক্ষেত্রে জাতীয় স্তরে কোনও নীতি নিতে গেলে বাধা আসতে পারে লালুপ্রসাদ, করুণানিধির মতো রাজ্যভিত্তিক নেতার তরফ থেকে। সিপিএম যদি তাদের কোর ইস্যুগুলো বাস্তবায়ন না করতে পারে, তাহলে তো ঠুঁটো জগন্নাথ বলবে সবাই।
৪) সিপিএম-এর রাজনৈতিক শত্রু কংগ্রেস। সেই কংগ্রেসের সমর্থনে সরকার গড়লে কেরল, ত্রিপুরা এবং পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম-এর হাতিয়ার কী পড়ে থাকবে? এ রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সোমেন মিত্ররা যতটা বিড়ম্বনায়, ততটা সিপিএম-ও। রাজ্যে মানুষের কাছে কী বার্তা যাবে, তা নিয়ে চিন্তিত ছিল কেন্দ্রীয় কমিটির। ছিয়ানব্বই সালে কংগ্রেসই প্রধান বিরোধী দল এ রাজ্যে। মমতা-সোমেনের বিরুদ্ধে লড়তে হয় সিপিএমকে। আর দিল্লিতে সেই কংগ্রেসের হাত ধরবে সিপিএম! নীচু তলার কর্মীদের লড়ার হাতিয়ার ছিনিয়ে নেওয়া যাবে না। ত্রিপুরা এবং কেরলের ক্ষেত্রেও একই দৃষ্টিভঙ্গি প্রযোজ্য ছিল।
৫) জ্যোতি বসুর ব্যক্তিত্ব এবং পাণ্ডিত্য প্রশ্নাতীত। কিন্তু রাজ্য চালানো আর দেশ চালানোয় তফাৎ রয়েছে। একসঙ্গে ১৩টি রাজনৈতিক দলকে নিয়ে সংসার করতে হবে এখানে। অবশ্যই বামফ্রন্ট নিয়ে সরকার চালাচ্ছেন তিনি। কিন্তু বামফ্রন্টের শরিকরা সমমনভাবাপন্ন। কিন্তু যুক্তফ্রন্টের শরিকরা যতই ধর্মনিরপেক্ষতার বুলি আওড়াক, সুযোগ পেলে বিজেপির হাত ধরতেও কুণ্ঠাবোধ করবে না। এছাড়া আর একটি সমস্যা ছিল হিন্দি। এই ভাষাকে রপ্ত করা জ্যোতি বসুর কাছে অগ্নিপরীক্ষা ছিল। দক্ষিণের মানুষ হলেও নরসীমা রাও সুন্দর হিন্দি বলতে পারতেন।
তৎকালীন সিপিএম সাধারণ সম্পাদক হরকিষেণ সিং সুরজিতের মতো জ্যোতি বসুর পক্ষে যাঁরা ছিলেন, তাঁরাও বেশ কিছু যুক্তি খাঁড়া করেছিলেন।
১) সিপিএম-এর প্রাসঙ্গিকতা: পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা এবং কেরলে সীমাবদ্ধতার বাইরেও পার্টির গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে নিঃসন্দেহে। গোটা দেশে পার্টির শক্তি বাড়ানোর এটাই উৎকৃষ্ট সময়।
২) সিপিএম শৃঙ্খলাবদ্ধ দল। সরকারে থাকলে স্থায়িত্ব বাড়বে বলে মনে করছিলেন সিপিএম-এর একাংশ। পলিসি তৈরিতে সিপিএম নতুন দিশা দেখাতে পারত দেশকে।
৩) যদি সরকারে না থাকে, কিংবা প্রধানমন্ত্রীর সুযোগ আসা সত্ত্বেও হাতছাড়া করা হয়, তাহলে রাজ্যের মানুষের কাছে কী জবাবদিহি করবে পার্টি। মানুষ তো এই জন্য ভোট দিয়েছিল, সরকারে গিয়ে কাজ করবে, কেউ প্রধানমন্ত্রী হলে এর থেকে বড় আনন্দের কী আছে! এরপরে নির্বাচনে মানুষের কাছে কী বার্তা নিয়ে পৌঁছবে পার্টি, এ নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। তবে, সীতারামদের বক্তব্য ছিল, যদি সরকারে না থাকে পার্টি, তাতে স্পষ্ট বার্তা যাবে, তারা ক্ষমতালোভী নয়, চেয়ার লোভী নয়।
৪) বিজেপিকে আটকানো এই মুহূর্তে সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ। যে ভাবে মেরুকরণের রাজনীতি করে বিজেপি উঠে আসছে, তাকে আটকানোর প্রয়োজন রয়েছে। বিজেপিকে রোখার জন্যই সিপিএম-এর সরকারে থাকা উচিত।
৫) কংগ্রেসের মতো বাইরে থেকে সমর্থন করে লাভ নেই। যদি সমর্থন করতেই হয় ভেতরেই থাকা উচিত। লালুপ্রসাদ-মুলায়মদের হাতে সরকার না দিয়ে, যতদিন সম্ভব চালিকাশক্তি বামফ্রন্টের হাতেই থাকা উচিত। এতে দেশজুড়ে সরকার চালনায় গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে সিপিএম-এর। ভোটবক্সে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। একটা দৃষ্টান্ত তো তৈরি হবে।
দু’দিন ধরে অনেক আলোচনা হল। সাত মণ তেলও পুড়ল, কিন্তু রাধা নাচল না। অর্থাৎ সিপিএম ঠিক করল তারা বাইরে থেকে সমর্থন জানাবে যুক্তফ্রন্টকে। এই সরকারের কোনও দায় তারা নেবে না। বাইরে থেকে যেখানে সমর্থন জানাবে, সেখানে জ্যোতিবাবুর প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রশ্নই ওঠে না।
জ্যোতি বসু সেদিন বুকে পাথর চেপে সেই মশাল এগিয়ে দিলেন এইচ ডি দেবগৌড়ার দিকে। করুণানিধিকে প্রধানমন্ত্রী করার প্রস্তাব উঠলে, জ্যোতি বসুই পরামর্শ দেন দেবগৌড়াকে প্রধানমন্ত্রী করার। তাঁর প্রস্তাব কেউ ফেলতে পারেননি। সমর্থন জানিয়েছিলেন লালু প্রসাদ-মুলায়মরা। কিন্তু তাঁরা মন থেকে জ্যোতিকেই চেয়েছিলেন। না-হলে একবছর পরও মুলায়ম সিং বলেন, “আমি চার বছর ধরে বলে আসছি, জ্যোতি বসুরই প্রধানমন্ত্রী হওয়া উচিত।” রামবিলাস পাসোয়ান বলেন, “যুক্তফ্রন্টের স্বাভাবিক নেতা জ্যোতি বসু। প্রাধনমন্ত্রী পদে তিনিই সবচেয়ে যোগ্য।” আই কে গুজরালের কথায়, জ্যোতি বসু হলে ভালই হতো।
জ্যোতি বসুও জানতেন সেই কথা। তাই কয়েক মাসের মধ্যে পার্টির যান্ত্রিক শৃঙ্খলা থেকে বেরিয়ে অত্যন্ত আবেগের সুরেই এম জে আকবরকে দেওয়া সাক্ষাতকারেই বলে ফেলেছিলেন, ‘ঐতিহাসিক ভুল’ করেছে সিপিএম।
ইতিহাসের পরিমাপ এক দুই পাতা দিয়ে বিচার করা যায় না। হ্যাঁ, সে দিন যুক্তফ্রন্টের সরকার টেকেনি। দু’বছরে দুটো প্রধানমন্ত্রী বদল হয়েছে। কংগ্রেস প্রত্যাশা মতোই হাত তুলে নিয়েছিল। কিন্তু জ্যোতিপন্থীরা যে সিঁদুরে মেঘের আশঙ্কা করেছিলেন, আজ আঠাশ বছরে কী কিছুই ফলেনি!
যুক্তফ্রন্টের সরকার পড়ার পরেই বাজপেয়ীর সরকার আসে। হিন্দুত্বের জোয়ার আটকাতে পারেনি তারা। দেড় দশকের মধ্যেই ত্রিপুরা-পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা হারায় সিপিএম। সময়ের সঙ্গে ছোট হতে হতে এখন শূন্য দাঁড়িয়েছে সিপিএম। গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে।
এরপরও আর একবার আটানব্বইতে জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। ‘ঐতিহাসিক ভুল’ শুধরানোর চেষ্টা করে সিপিএম। কিন্তু বিলম্বিত বোধদয়। কংগ্রেস পত্রপাঠ সে প্রস্তাব খারিজ করে দিয়েছিল।
জ্যোতি বসু প্রধানমন্ত্রী না হওয়ায় দেশ কী হারাল জানা নেই, কিন্তু বাঙালি সে সুযোগ হারিয়েছে। বাঙালির নোবেল আছে, বাঙালির অস্কার আছে, বাঙালির রাষ্ট্রপতি আছে, বাঙালির বিশ্বসুন্দরী আছে, নেই শুধু একটা প্রধানমন্ত্রী…