অ্যাটমের থেকেও ভয়ঙ্কর করোনা, এত কাছ থেকে এ কটা দিন দেখে যা বুঝেছি…
আরও একা হয়ে পড়লাম। ফ্ল্যাটে একা থাকি। অফিসের গাড়ি আসে। গাড়ির মধ্যে আমরা তিনটি প্রাণী। রাস্তাঘাট শুনশান। মাঝে মাঝে পুলিস বসে আছে। আর হাসপাতালে চিকিৎসক, নার্স, কর্মী এবং আমরা কয়েকজন
তন্ময় প্রামাণিক: করোনা!!! চোখে না দেখা এক ভাইরাসের আতঙ্কে হঠাৎই দরজা বন্ধ করে নিভৃতবাসে গেল গোটা পৃথিবী। মাস্ক এর পিছনে মুখ লুকালো মানুষ। আমিও তার ব্যতিক্রম ছিলাম না। আর পাঁচটা মানুষের মতো ভয়ে মুখ লুকালাম। তবে, সাংবাদিক হওয়ার দরুন, সবাই যেভাবে করোনার থেকে দূরে থাকতে পেরেছে, আমার ক্ষেত্রে তার উল্টোটাই হয়েছে। প্রায় এক বছর ধরে করোনাকে খুব কাছ থেকে দেখলাম। বুঝলাম। বলা ভাল, করোনার (COVID-19) থেকে অনেক কিছু শিখলামও।
আজ নতুন বছরের প্রথম দিনে তাই ভাবতে ইচ্ছে করছে সেই দিনগুলির কথা। হতে পারে সেই দিনগুলো বড় আতঙ্কের। কষ্টের। একাকীত্বের। প্রিয়জন হারানোর জমাট বাঁধা যন্ত্রণার প্রতিধ্বনি শুনে কত রাত যে কেটেছে, তার ইয়ত্তা নেই। তা বলে সে সময়কে কখনও উপেক্ষা করতে পারিনি। যা গিয়েছে তা যাক বলে অবলীলায় সরিয়ে দিতে পারিনি। এই সময়ই আগামী দিনে আমায় ঋদ্ধ করবে বলে আমি বিশ্বাস করি। তাই এক দিকে করোনাকে (Novel Coronavirus) ধন্যবাদও জানাই।
খবর সংগ্রহের পেশা। কুড়ি বছরের এই পেশাগত জীবনে এদিক ওদিক ভাসতে-ভাসতে স্বাস্থ্য নিয়ে খবর শুরু করি। মানে ‘হেলথ বিট’। করোনা পর্বের মধ্যে দিয়ে গিয়ে বুঝলাম, ‘হেলথ বিট’ আর পাঁচটা ইনসিডেন্ট কভার করার রোমাঞ্চের মতো কম কিছু নয়। মধ্য প্রাচ্যের বধ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে সাংবাদিক যে রোমাঞ্চকতা অনুভব করেন, আমিও গত কয়েক মাস ধরে সেই অনুভবই করে আসছি। করোনার বিরুদ্ধে প্রথম সারির যোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে অন্তত ‘হেলথ বিটের’ সাংবাদিক হিসাবে এখন গর্ব অনুভবই করি।
২০২০ সালের ২ মার্চ। অফিসের ফোন এল। করোনা-ভাইরাস নিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের একটা লাইভ অনুষ্ঠান করতে হবে ৩০ মিনিটের। তখন ভাইরাসের নাম মুখস্থ করছি। কোভিড নাইনটিন কিংবা নোভেল করোনাভাইরাস। ভাইরাসের জীবনপঞ্জি নিয়ে পড়াশুনা করতে উইকিপিডিয়া ঘাঁটছি। কী তার উপসর্গ। কতদিন থাকবে, কতটা ভয়ঙ্কর, একপ্রকার অন্ধকারে ঢিল ছুড়ে গভীরতা বোঝার চেষ্টা করা ছাড়া আর উপায়ও ছিল না।
দিন পাঁচেক পরেই ছোটাছুটি। কলকাতায় এক চিনা তরুণী জ্বরাক্রান্ত। নিয়ে যাওয়া হয়েছে বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে। যেটাকে রাজ্য সরকার করোনার চিকিৎসার জন্য কোভিড হাসপাতাল হিসাবে চিহ্নিত করেছে। অফিসের নির্দেশ আসতেই সাতসকালে ছুটলাম বেলেঘাটা আইডিতে। হাসপাতালের ভেতরে ঢুকতে ভয় করছে। করোনা রোগী ভর্তি হয়েছে এমন খবরে হাসপাতাল প্রায় জনমানব শূন্য। দুই-একজন কর্মী ইতস্তত ঘোরাঘুরি করছেন। চিকিৎসকদের দেখা যাচ্ছে হাতে গ্লাভস। মাথায় ক্যাপ। মুখে মাস্ক। সকলেই সকলকে দেখে দূরে দূরে চলে যাচ্ছেন। এ এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। আমারও বেশ ভয় করছিল। এই ভাইরাস কেমন, কীভাবে ছড়ায় সবই তো শোনা কথা। এ এক অজানা আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল।
এরপর ১৪ মার্চ ফের বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে এক পর্যটক এবং তিন ভারতীয়র ভর্তির খবর এল। বিমানবন্দরে নামার পর তাঁদের নিয়ে আসা হয়েছে বেলেঘাটা আইডিতে। শোনা গেল, তাঁদের শরীরে করোনা সংক্রমণের লক্ষণ রয়েছে। তবে, রিপোর্ট নেগেটিভ আসায় তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হল। দেখলাম, চিকিৎসক যোগীরাজ রায় সাহস জোগাচ্ছেন অন্যান্য চিকিৎসকদের। অনেকেই প্রাথমিকভাবে রোগী দেখা বন্ধ করে দিলেন। একের পর এক হাসপাতাল অধিগ্রহণ শুরু করে রাজ্য সরকার। এর মধ্যে কয়েকজন চিকিৎসক সামনে দাঁড়িয়ে লড়াইটা শুরু করলেন।
কলকাতার ফ্ল্যাট থেকে মা-সন্তান-সহ পরিবারের অন্যান্যদের পাঠালাম অন্য জায়গায়। আমি একা থাকতে শুরু করলাম। কারণ, হাসপাতালে ঘুরে বেড়াচ্ছি । করোনা সংক্রমণ সন্দেহে যাদের নিয়ে আসা হচ্ছে, তাদের বক্তব্য সংগ্রহ করছি। সংস্পর্শে যাচ্ছি। সব মিলিয়ে আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল, পরিবার-পরিজন কিংবা পরিচিতদের কাছে আমি যেন বিপদ না হয়ে উঠি। নিজেকে অপরাধী মনে হত। একলা জীবনের পথ চলার সিদ্ধান্ত নিলাম।
এরপর ১৭ মার্চ কলকাতায় বলা ভাল এ রাজ্যে প্রথম করোনা আক্রান্তের সন্ধান মিলল। এক আমলা পুত্র। ব্রিটেন ফেরৎ। ভর্তির আগে তাঁদের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলাম। ভয় আরও বাড়ল। অফিসে ঢোকাও নিষিদ্ধ হয়ে গেল। অফিস পুরোপুরি জানিয়ে দিল, করোনার বিষয় না মেটা পর্যন্ত এবং অফিসের পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত, অফিসেই ঢুকতে পারব না। শুধু আমি নয়, আমার সঙ্গে চিত্র সাংবাদিক এবং গাড়ির চালকের একই অবস্থা।
আতঙ্ক ছড়াতে শুরু করল মানুষের মধ্যে। এরই মধ্যে একদিন রাত্রিতে আলো নেভানো এবং বাজি পটকার শব্দ। শুরু হল করোনা সম্পর্কে সচেতনতা বিতর্ক। মার্কেট থেকে উধাও হয়ে গেল স্যানিটাইজার। আকাল শুরু হল ডেটল স্যাভলনের মতো নানা প্রোডাক্টের। তার সঙ্গে শুরু হল কালোবাজারিও। এক একটি মুখের মাস্ক এর দাম পৌঁছল ৩০০ টাকা ৪০০ টাকা এমনকী ৫০০ টাকা পর্যন্ত। আজ যেটা খুব জোর ৫০ টাকায় পাওয়া যায়।
পরিচিত বন্ধুবান্ধব থেকে শুরু করে অফিস কলিগ, এমনকী অফিসের নেতৃস্থানীয় যাঁরা আছেন, তাঁরাও সকলে ফোনে রিকোয়েস্ট করছেন একটা মাস্ক জোগাড় করে দেওয়ার জন্য। দু-একদিনের মধ্যেই শহর এবং জেলার আত্মীয়দের ফোন আসতে শুরু হল মাস্ক পাঠাতে হবে। যে সে মাস্ক নয়, n95 হতে হবে। কিছুটা পরিচিতির জোরে বিভিন্ন দোকান ও হাসপাতাল ঘুরে শুরু হল মাস্ক সংগ্রহ। এরই মধ্যে ২৩ মার্চ ঘোষণা হল লকডাউন। দেশজুড়ে।
আরও একা হয়ে পড়লাম। ফ্ল্যাটে একা থাকি। অফিসের গাড়ি আসে। গাড়ির মধ্যে আমরা তিনটি প্রাণী। রাস্তাঘাট শুনশান। মাঝে মাঝে পুলিস বসে আছে। আর হাসপাতালে চিকিৎসক, নার্স, কর্মী এবং আমরা কয়েকজন। কোনও বনধ নয়। এই প্রথম পরপর প্রতিদিন দেখতে শুরু করলাম জনমানবহীন কলকাতা। নতুন নতুন শব্দ ভেসে আসতে শুরু করল। কনটেইনমেন্ট জো়ন। কোয়ারেন্টাইন। আইসোলেশন। অক্সিমিটার। পি পি ই। অক্সিজেন স্যাচুরেশন ইত্যাদি ইত্যাদি। অভিধানে ছিল। কিন্তু অভ্যেসে ছিল না। সেগুলোও দৈনন্দিন জীবনে ঢুকে পড়ল। আর কলকাতার আকাশকে অত্যন্ত পরিষ্কার হতে দেখলাম জীবনে এই প্রথম। বিকেল হতেই আকাশের রঙের খেলা শুরু হল কয়েক দিনের মধ্যেই।
আরও পড়ুন- “করোনা যুদ্ধে ব্যাপক সাহায্য করবে”! ভারতের টিকা অনুমোদনকে সাধুবাদ হু-র
আর এসবের মধ্যেই শুরু হয়ে গেল ভয়ের চোটে একাধিক অমানবিক ঘটনার সাক্ষী হওয়া। জ্বর নিয়ে ৭৪ বছর বয়সী এক বৃদ্ধ পড়েছিলেন বনগাঁ হাসপাতালে। করোনা হয়েছে সন্দেহে হাসপাতাল ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। কোনও অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার তাঁকে গাড়িতে তুলতে রাজি হচ্ছিলেন না। একা পড়েছিলেন ওই বৃদ্ধ। পরে স্থানীয় তৃণমূল নেতা গোপাল শেঠের তত্ত্বাবধানে বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে পাঠানো হয় ওই বৃদ্ধকে। বৃদ্ধের বক্তব্য সংগ্রহ করলাম। তা টেলিভিশনে দেখানো হল। আর পাড়ায় ফিরতেই পড়লাম আরেক বিপত্তিতে। দু’একজন পরিচিত দরজা ঠেলে এগিয়ে এসে বললেন ,করোনা হাসপাতালে যাচ্ছেন। করোনা রোগীদের বক্তব্য নিচ্ছেন কাছে দাঁড়িয়ে। পাড়ায় ঢোকা কি ঠিক হচ্ছে? পরদিন সকালে অফিস যাওয়ার আগে অফিসের পাঠানো মাস্ক-স্যানিটাইজার সেই প্রতিবেশীদের কাছে পৌঁছে যাওয়া মাত্রই তাঁরাই আবার হাসিতে ডগোমগো। আর কোনও কথা বলেননি কোনওদিন।
এই করোনা পরিস্থিতিতে দেখেছি, হাসপাতাল চত্বরে পড়ে বেওয়ারিশ লাশ। আবার কত লাশের সৎকার হয়েছে পরিবার-পরিজন ছাড়াই। কেউ মরে গিয়েও হাসপাতালে দিব্যিই বেঁচে রয়েছেন। কেউ বা নিজের শ্রাদ্ধের দিনে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। টাকার অভাবে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যু হয়েছে এমন ঘটনার ইয়ত্তা নেই। প্রতিদিন এ সবই খবর ব্রেকিং দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। কাজ শেষ করে যখন বাড়ি ফিরতাম, আতঙ্কে পাড়া শুনশান। ফ্লাটের লিফট ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কারণ ফ্ল্যাটে অনেক প্রবীণ মানুষ থাকেন। সিঁড়ি বেয়ে ওঠা নামা করতাম। একাই রান্না খাওয়া। আর রাত্রিবেলায় দেখতাম, পাড়ার কিছু বেকার যুবক লুকিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস বিক্রি শুরু করছে। চাল, ডাল, আলু, তেল, নুন। বেশি দামে।