SLST Protest: ধর্মতলা যেন বেলতলা, বারবার ঠকেই ন্যাড়া হলেন চাকরিপ্রার্থীরা!

SLST: গোটা রাজ্য থেকে মানুষ ধর্মতলা আসেন কাজের জন্য। কেন্দ্রীয় সরকারি বেশিরভাগ অফিস এখানেই। হাইকোর্ট থেকে শুরু করে রাজ্যেরও একাধিক দফতরের ঠিকানা ধর্মতলা। তবে কিছু মানুষ রোজ কাকভোরে আসেন ধর্মতলার ধরনাতলায়। ট্রেন-বাস, তারপর পায়ে হেঁটে সকাল ১১ টার মধ্যে 'হাজিরা' দিতে হয় মেয়ো রোডের গান্ধীমূর্তিতে। এরা জানেন না কতদিনে এই হাজিরা খাতা বন্ধ হবে।

SLST Protest: ধর্মতলা যেন বেলতলা, বারবার ঠকেই ন্যাড়া হলেন চাকরিপ্রার্থীরা!
বিক্ষোভ চলছে। Image Credit source: TV9 Bangla
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Dec 09, 2023 | 10:43 PM

কলকাতা: গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে ২০০৩ সালে রোমের যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলনের উল্লেখ আছে। ওই যুদ্ধ-বিরোধী মিছিলে ১৫ লক্ষ মানুষ পা মিলিয়েছিলেন। ২০১৯ সালের অক্টোবরে ইরাকের কলেজ পড়ুয়াদের আন্দোলনের জেরে স্বেচ্ছায় গদি ছাড়তে হয়েছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আদেল আব্দুল মাহদিকে। তখন আন্দোলনের বয়স ছিল আড়াই বছর। এছাড়া খুব বেশিদিন ধরে চলেছে এমন আন্দোলনের নজির রয়েছে ফ্রান্স ও হংকংয়ে। গোটা বিশ্বের সাম্প্রতিক ইতিহাসে নাম উঠেছে ভারতের কৃষক আন্দোলনেরও। নাগরিকত্ব আইন নিয়েও ভারতের আন্দোলন বহু মানুষকে একত্রিত করেছিল। তবে সক্রিয়তার নিরিখে সেই আন্দোলনের বয়স মেরেকেটে ৫ মাস। আর এদিকে বাংলার শিক্ষক নিয়োগের আন্দোলন আজ ১ হাজার দিন পূর্ণ করে ফেলল। এই হাজার দিনে চাকরিপ্রার্থীদের হাজারো কাহিনি এখানে লেখা যায়। আর প্রত্যেকের কাহিনিতে একটাই কমন বিষয়, না পাওয়ার যন্ত্রণা।

গোটা রাজ্য থেকে মানুষ ধর্মতলা আসেন কাজের জন্য। কেন্দ্রীয় সরকারি বেশিরভাগ অফিস এখানেই। হাইকোর্ট থেকে শুরু করে রাজ্যেরও একাধিক দফতরের ঠিকানা ধর্মতলা। তবে কিছু মানুষ রোজ কাকভোরে আসেন ধর্মতলার ধরনাতলায়। ট্রেন-বাস, তারপর পায়ে হেঁটে সকাল ১১ টার মধ্যে ‘হাজিরা’ দিতে হয় মেয়ো রোডের গান্ধীমূর্তিতে। এরা জানেন না কতদিনে এই হাজিরা খাতা বন্ধ হবে। তবে এটা জানেন, চাকরিটা না পাওয়া পর্যন্ত এই হাজিরা খাতায় সই করা বাধ্যতামূলক। নাহলে, আবার যদি কেউ তাদের মুখের গ্রাসটা কেড়ে নেয়। তাই তাঁরা রোজ আসেন।

শরীর-মন অবশ হয়ে এলেও তাঁরা আসেন। আজ ১,০০০ দিনে তাঁদের অভিনব প্রতিবাদের সাক্ষী থেকেছে গোটা রাজ্য। কতজন যে আজ কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে মাথা ঠুকেছেন, এত ভিড়ে ওই হিসেবটা ঠিক করা যায়নি। তবে এটুকু বলা যায়, ২০১৯ সালের আন্দোলন আজ অনেকের মতেই ‘ঐতিহাসিক’ তকমা পেয়েছে। গবেষণা বলছে, গোটা বিশ্বে যত আন্দোলন হয়, তার মাত্র ২৩ শতাংশ ৩ মাসের গণ্ডি পেরতে পারে। সেখানে বাংলার শিক্ষক নিয়োগের আন্দোলন ৩ বছরের পথে। যাঁরা দৃঢ়তার সঙ্গে আন্দোলনটাকে এতদিন চালিয়ে গেলেন তাঁদের জীবনের কাহিনি শুনলে বোঝা যাবে সমস্যা ঠিক কত ধরনের হয়। যা অনেকেই হয়ত কল্পনাও করতে পারেন না।

এই ধরুন গঙ্গারামপুরের রেহেসান আলির কথা। বয়স ৩৬। বাবা অসুস্থ। কষ্ট করে যে বাবা-মা রেহেসানকে নেট পাশ করিয়েছেন, সেই বাবা-মাকে মাসে ১ টাকাও তুলে দিতে পারেন না রেহেসান। উল্টে আন্দোলনে যোগ দিতে আসার জন্য বাবার কাছেই হাত পাততে হয় তাঁকে। লজ্জায় মাথা নীচু হয়ে এলেও উপায় নেই। রেহেসান জানেন না কবে চাকরি হবে। বাবার খুব ইচ্ছে পুত্রবধূ দেখবেন, কিন্তু যে পরিবারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, সেখানে ইচ্ছের কি কোনও দাম আছে? দিনহাটার প্রণব অবশ্য মাথার ওপর ছাতার মতো পেয়েছিলেন দাদাকে। দিনকয়েক হল দাদা আর নেই। সংসারের বেহাল দশা। তবু প্রণবের কিচ্ছু করার নেই। শুধু রোজ বালিশে মাথা রেখে চোখ বুজে বলেন, ইসস্, যদি চাকরিটা থাকত!

কোচবিহারের সিতাই থেকে আন্দোলনে যোগ দিতে কলকাতা আসেন পরভিনা। পরভিনা টিউশন পড়ান। যা টাকা আসে, তা কলকাতার আন্দোলনে আসতেই শেষ। সংসার, সন্তানের জন্য কিছু করার ইচ্ছে থাকলেও উপায় কই? একই জেলার মারুফা বানুর সমস্যা তো যে কোনও সমাজবিজ্ঞানের গবেষকের কাছে নিঃসন্দেহে একটা থিসিস পেপার হতে পারে। এই যে তিনি কলকাতা আসেন, পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলন করেন, তা ভাল চোখে দেখে না তাঁর গ্রাম। বাড়ির স্ত্রী হয়ে কেন প্রতি মাসে শহরে ছুটে আসা? এই প্রশ্নের উত্তরের চেয়েও তাঁকে বেশি ভাবায় তাঁর ছোট্ট ছেলের আবদার। সে শুধু একটা ঘড়ি আর ব্যাগ চেয়েছিল। মারুফা তা দিতে পারেননি। একজন মায়ের কাছে এর চেয়ে বেশি কষ্টের আর কী হতে পারে।

এরকম হাজারো না পারার কাহিনি বলতে শুরু করলে হয়তো মন খারাপের দিস্তা দিস্তা দলিল তৈরি হবে। কিন্তু প্রত্যেকটা গল্প নিষ্ঠুর হলেও সত্যি। আজ হাজার দিনে অবস্থান মঞ্চে তিল ধারনের জায়গা ছিল না। একটা ছোটখাটো সর্বদল সমন্বয়ও হয়ে গিয়েছে ধরনামঞ্চে। আজ ছিল নেতাদের আগে গিয়ে রাসমণির পাশে বসার সুপ্ত প্রতিযোগিতা। রাসমণি কে? রাসমণি শিক্ষাবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। বিএড পাশ করে অপেক্ষমান মেধা তালিকায় নাম তোলার পরও আজ তাঁকে হকের চাকরির জন্য নিজের মাথা ন্যাড়া করতে হয়েছে।

হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ১০-১২ টা ক্যামেরার সামনে নাপিত ডেকে মাথা মুড়িয়েছেন ‘শিক্ষিত বেকার’ রাসমণি পাত্র। ক্যামেরার সামনে তিনি চোখে জল নিয়ে উচ্চকণ্ঠে বলেছেন, “যে জীবনের কোনও দাম নেই, সেখানে চুলের সৌন্দর্য রেখে হবেটা কী!” নাপিত যখন ক্ষুর দিয়ে রাসমণির মাথা কামাচ্ছিলেন, খুব মনোযোগ দিয়ে দেখেছি এত ক্যামেরা দেখে তাঁর হাত কাঁপছিল। অন্য মহিলা চাকরিপ্রার্থীরা তখন হাউ হাউ করে কাঁদছিলেন। এই কান্না ‘মেকি’ বা ক্যামেরা আকর্ষণের জন্য নয়।

এই চাকরিপ্রার্থীদের অনেকের বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে। বেকার স্বামীর সঙ্গে মেয়েকে আর ঘর করতে দিতে চান না, এমন বাবার আবদার শুনে ময়দানে বসে থাকা চাকরিপ্রার্থীকেও দেখেছি। চাকরিটা হলে বাবার চিকিৎসা হবে, এই আশায় দক্ষিণ ভারতে চিকিৎসকের খোঁজ নেওয়া চাকরিপ্রার্থীকেও চিনি। এমন প্রেমিক চাকরিপ্রার্থীকে চিনি, যিনি অনেক ঝগড়া করে চাকরি হওয়া পর্যন্ত প্রেমিকার বিয়েটা কোনওরকমে আটকে রেখেছেন। এত কিছুর পরেও সব হচ্ছে, শুধু চাকরিটা ছাড়া।

আপনারা তো শিক্ষিত, চাইলে অন্য কিছুও তো করা যায়? প্রশ্নটা শেষপর্যন্ত করতেই হল। চোখের জল লুকিয়ে উত্তর এল। সুন্দরবনের এক অজপাড়া গাঁয়ের মহিলা চাকরিপ্রার্থী বললেন, ‘মেয়ে বলেছে মা তোমাকে দিদিমণি হতেই হবে।’ আসলে এঁদের প্রত্যেকের মাথায় শিক্ষক হওয়ার ‘ভূত’ চেপেছে। ভূত-ই। আর তা পুলিশের লাঠিতে নামবে না। আন্দোলনের ১০০০তম দিনে তা যেন আরও স্পষ্ট হল।