BOWBAZAR: ‘ওপেন টি বায়োস্কোপ আর দেখিনা, দেখলেই মনে পড়ে যায় আমার দুর্গা পিতুরি লেনটাকে…’
ফিরে এলাম বলছি ঠিকই। কিন্তু মুখ ফিরিয়ে থাকা কি যায়? এরপরেও ১০ থেকে ১২ বার গিয়েছি দুর্গা পিতুরি লেনে।দাঁড়িয়ে থেকেছি। একা।চোখ দিয়ে নাগাড়ে জল পড়ছিল। যতবার গিয়েছি,ততবার।কান্নার আওয়াজ? হাজার হাজার মেশিন, ইট-কাঠ-ধুলোয় সেই আওয়াজ পৌঁছয়নি। কোথাও পৌঁছয়নি।
কলকাতাঃ সামনে দিয়ে এখনও টং টং করে আওয়াজ করে এগিয়ে চলে ট্রাম। করোনা কাটিয়ে এখনও গোয়েঙ্কা কলেজ অফ কমার্সের সামনে ভিড় জমান তরুণ-তরুণীরা। বিকেল হলেই ম ম করে তেলেভাজার গন্ধ। কিন্তু ওরা সেই গন্ধ পায় না। ওরা মানে দুর্গা পিতুরি লেনের সেই বাসিন্দারা। যাঁরা ৩ বছর আগেই পাড়া ছাড়া হয়েছেন। মেট্রো টানেলের কাজের জেরে তাঁদের বাড়ি প্রায় ধ্বংসস্তূপের আকার নিয়েছে। আজ যখন টিভি , কাগজ বা মোবাইলের দিকে চোখ রাখেন, তখন ভেসে ওঠে নতুন করে সেখানকার বিপর্যয়ের কথা। মনে পড়ে যায় পুরনো কথা। মনে পড়ে যায় ৩ বছর আগের এক রাতের কথা, যা বদলে দিয়েছে পরিবারগুলোর যাপনটাই। এমনই এক পরিবারের সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করল Tv9 বাংলা ডিজিটাল। তিনি তরুণী। যার জন্ম থেকে বড় হওয়া, এমনকি চাকরি জীবনের শুরুটাও এই দুর্গা পিতুরি লেন থেকেই। নাম প্রকাশে তিনি অনিচ্ছুক। তাই তাঁর ইচ্ছাকে সম্মান রেখেই তাঁর জবানবন্দি তুলে ধরলাম-
এখনও দিনটা স্পষ্ট মনে আছে। ১লা সেপ্টেম্বর,২০১৯। রাতের বেলা হঠাৎ করে দেখলাম কেঁপে উঠছে আমাদের বাড়িটা। মনে হচ্ছে ভূমিকম্প। কিছুক্ষণ হওয়ার পর বন্ধ হয়ে গেল। প্রথমে আমরা পাত্তা দিইনি। পরের দিন সকালে আমার ভাই একটি কাজের জন্য বাড়ি থেকে বেরোয়। কিছুক্ষণ পরেই আমাদের ফোনে জানায়, পাড়াতে বাড়ি ভেঙে পড়েছে।একটার পর একটা। পাড়া মানে আমাদের দুর্গা পিতুরি লেন।বেরিয়ে দেখলাম, পুলিশ, অ্যাম্বুলেন্সের গাড়িতে ছয়লাপ আমাদের পাড়ার ছোট্ট গলিটা। পা রাখার জায়গা নেই। এক লহমায় চেনা পাড়া যেন অচেনা হয়ে উঠল আমার কাছে।
অনেকেই জানেন না, এই ঘটনার কয়েকদিন আগে মেট্রো কর্তৃপক্ষ আমাদের পাড়ায় এসেছিলেন। বলেছিলেন, কয়েকদিনের জন্য হোটেলে থাকতে হবে। আমরা মাত্র ১ দিনের জন্য পুরো পরিবার হোটেলে ছিলামও। তারপর ফিরে এসেছিলাম। তখন সত্যি কোনও সমস্যা ছিল না আমাদের বাড়িতে। এরপর সেই দিনটা। যখন আমার পাড়াটা হয়ে উঠল অচেনা।
হাসিমুখে যে প্রতিবেশীদের দেখতাম, তাঁদের মুখ থমথমে। বাড়ি জুড়ে ফাটলের সিরিজ। নিজভূমে রাতটুকু কাটানোটাও তখন জীবনের সবচেয়ে বড় আতঙ্কের নাম। দিনের যে কোনও সময় শুনতাম দুমদাম আওয়াজ। আজ একজনের বাড়ির দোতলার বারান্দাটা ভেঙে পড়ছে তো কারও তেতলার শোওয়ার ঘরটা। জমজমাট দুর্গা পিতুরি লেন তখন গোটা কলকাতার নজরে। আর দুর্গা পিতুরি লেনের বাসিন্দাদের কাছে চেনা পাড়ায় শ্মশানের নিঃস্তব্ধতা।
এর মধ্যেই একদিন মেট্রো কর্তৃপক্ষ এসে বলল, বাড়ি ছাড়তে হবে। আমরা হোটেলের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আমার শোওয়ার ঘর, ঘরের কোনায় থাকা আমার সাধের টেবল-চেয়ার। ঘরে ছড়িয়ে থাকা আমার বড় হওয়া-সবটা, সবটা ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। সঙ্গে মা, বাবা, ভাই। অস্থায়ী ঠিকানা হল সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের একটা হোটেল। সেখান থেকে আবার একটা হোটেল। সেটাও সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ে। এভাবে ২ মাস চলল। ঘুরতে গিয়ে হোটেলে থাকতে আমার দিব্যি লাগতো। সেদিন যখন হোটেলের ঘরটায় ঢুকলাম- তার যে কি যন্ত্রণা বলে বোঝাতে পারব না। হোটেলে থাকতে এত খারাপ লাগাও তৈরি হয়! সেদিন বুঝতে শুরু করলাম।
এরই মাঝে একদিন মেট্রোর এক আধিকারিক আমাদের বললেন, আপনারা নিজেদের বাড়িতে ফিরে যান। আমরা তখন বলি, আমাদের বাড়ির ফিট সার্টিফিকেট দিন, আমরা চলে যাব। এরপরেই শুরু হল অভব্যতা। মেট্রোর এক আধিকারিক আমাদের নাগাড়ে অপমান করতে থাকে। তখনও আমরা হোটেলবন্দি।এরপর শুরু হল চিঠি চালাচালি। দুপক্ষের মধ্যেই। সে এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া। প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হতে থাকল। সমস্যা ততই সমাধানের থেকে দূরে চলে যেতে থাকল।
মেট্রোর সেই আধিকারিকের নির্দেশেই আমাদের হোটেলে থাকা কার্যত কঠিন হয়ে উঠেছিল। তবুও হোটেলের কর্মীরা এত ভালো ছিল, যে আমাদের যাবতীয় সমস্যায় ওঁদের পাশে পেয়েছিলাম। সবাই যেমন ৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছিল, আমরাও পেলাম। কিন্তু….
দুর্গা পিতুরি লেনে আমাদের যে বাড়িটা ছিল, সেটা কি ৫ লক্ষ টাকায় ক্ষতিপূরণ সম্ভব। দু পা হাঁটলেই বড় রাস্তা। বাস, ট্রাম-দু পা হাঁটলেই। ৫ মিনিট হাঁটলেই সেন্ট্রাল মেট্রো স্টেশন। আপনিই বলুন, যে জায়গায় আমাদের বাড়ি, সেটা ৫ লক্ষ টাকায় ক্ষতিপূরণ সম্ভব? অগত্যা দীর্ঘ লড়াই চলল। যত দিন চলল, ততই বুঝতে পারছিলাম, নিজের বাড়ি আর নিজের রইল না। পাখি আর নীড়ে ফিরতে পারবে না। ক্লান্ত হয়ে পড়লাম, এই অসম লড়াইয়ে। একদিকে মেট্রোর আধিকারিকদের শক্তিশালী জোট। অন্যদিকে আমাদের ৪জনের পরিবার। বুঝলাম, আম আদমির আসল মানে। ‘পাওয়ার অব কমন ম্যান’-এই গাল ভরা শব্দটা বোধ হয় ফিল্মেই ভালো লাগে।
লড়াই ছেড়ে দিলাম। জমজমাট উত্তর কলকাতা ছেড়ে আপাত শান্ত দক্ষিণ কলকাতায় একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিলাম আমরা। রোজগার আর বাকি থাকা খানিক সঞ্চয় জোগাড় করে নতুন ঠিকানায় আশ্রয় নিলাম। গত ২ বছর আমরা এখানেই রয়েছি। মাঝে আধ ভাঙা বাড়িটায় গিয়ে কয়েকটি আসবাবপত্র আর কিছু টুকিটাকি জিনিস নিয়ে এসেছিলাম। ব্যস, আর কিছুই নয়। আমার শৈশব-কৈশোর-যৌবন-সবকটা অস্তিত্বকে বিদায় জানিয়ে ফিরে এলাম।
ফিরে এলাম বলছি ঠিকই। কিন্তু মুখ ফিরিয়ে থাকা কি যায়? এরপরেও ১০ থেকে ১২ বার গিয়েছি দুর্গা পিতুরি লেনে।দাঁড়িয়ে থেকেছি। একা।চোখ দিয়ে নাগাড়ে জল পড়ছিল। যতবার গিয়েছি,ততবার।কান্নার আওয়াজ? হাজার হাজার মেশিন, ইট-কাঠ-ধুলোয় সেই আওয়াজ পৌঁছয়নি। কোথাও পৌঁছয়নি।
এখন কি মনে হয় জানেন? মনে হয় ভগবান বাঁচিয়েছে।শান্তিতে থাকতে চেয়েছিলাম। সেটাই থাকছি আপাতত। শেষবার গিয়েছিলাম ২০২২ সালে জানুয়ারি মাসে। তখন কোভিডের তৃতীয় ঢেউ আছড়ে পড়েছিল কলকাতায়। চোখের সামনে সেই শেষবার দেখেছিলাম, আমার গর্ব, আমার আভিজাত্য ,আমার বসতবাড়ি একটু একটু করে ধ্বংসস্তুপের চেহারা নিচ্ছে।আর যাইনি।আর যেতে চাই না।
জানেন তো, ছুটির বিকেলে ছাদে উঠে খোলা আকাশটা মিস করি। খোলা আকাশের পেট চিরে উড়ে বেড়ানোর ঘুড়ি দল। পেটকাটি-চাঁদিয়াল-মোমবাতি-কত রকমারি ঘুড়ি উড়ত দুর্গা পিতুরি লেনের আকাশে। এখনও ওড়ে। আমারই শুধু চোখে পড়েনা। ছাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আর তো আকাশ দেখিনা আমি।
জানেন তো, আজও বাড়ির কথা, দুর্গা পিতুরি লেনের কথা উঠলেই মা-বাবা অঝোরে কেঁদে ফেলেন। প্রতিবেশী এখনও আছে। কিন্তু খড়খড়ি জানলা সরিয়ে এ বাড়ি- ওবাড়ির আড্ডা তো আর হবে না। কোনওদিনই হবে না।
হবে না বলেই আজ দুবছর হয়ে গেল আমার প্রিয় সিনেমা ‘ওপেন টি বায়োস্কোপ’ আর দেখি না। ওখানেও তো সেই উত্তর কলকাতার গল্প। সেখানকার জেতার গল্প। হারার গল্প। সবশেষে একটা পাড়ার বদলে যাওয়ার গল্প।একদম আমার দুর্গা পিতুরি লেনের মত। ‘ওপেন টি বায়োস্কোপ’ আমাকে দুর্গা পিতুরি লেন মনে করায়। আমি তো আর মনেই করতে চাই না সেই গলির কথা। তাই- জলছবি, রংমশাল,স্কুল ছুটি, হজমিরা……থাক না ওসব কথা!
(অনুলেখক: রক্তিম ঘোষ)