ট্রান্সওম্যান, পুরুষ থেকে নারী হয়ে ওঠার জার্নি, শারীরিক লড়াইয়ের পাশাপাশি কতটা মানসিক যুদ্ধ?

শৈশব এবং কৈশোরে স্কুল আর পরবর্তীকালে কলেজেও মারাত্মক ভাবে বুলি হতে হয় ট্রান্সদের। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁরা পড়াশোনাটা শেষ করতে পারেন না।

ট্রান্সওম্যান, পুরুষ থেকে নারী হয়ে ওঠার জার্নি, শারীরিক লড়াইয়ের পাশাপাশি কতটা মানসিক যুদ্ধ?
মুম্বইয়ের বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার স্বপ্নিল শিণ্ডে এখন সাইশা।
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Jan 08, 2021 | 10:17 AM

সোহিনী চক্রবর্তী 

আমি যা আদতে আমি তা নই…

বয়ঃসন্ধির সময় এমন ভাবনা আসে অনেকেরই মনে। তিনি নারী নাকি পুরুষ সেই ভাবনা নিয়ে নিজের মনের সঙ্গেই চলতে থাকে এক অদৃশ্য এবং অসম লড়াই। তারপর আসে নিজেকে সঠিক ভাবে চিনে নেওয়ার মুহূর্ত। সেই সঙ্গে শুরু হয় সমাজের তথাকথিত নিয়মের বেড়াজাল ভেঙে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই।

জটিল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অনেকেই পুরুষ থেকে হয়ে ওঠেন নারী। শারীরিক ভাবে একদম ভিন্ন রূপে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার লড়াইটা মারাত্মক কঠিন। সেই সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে প্রায় সমস্ত ট্রান্সওম্যানকে লড়তে হয় এক সামাজিক যুদ্ধ। প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত হওয়ার পরেও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রতিবাদটা করে যান তাঁরা।

তাঁদেরই একজন মুম্বইয়ের বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার স্বপ্নিল শিণ্ডে। তবে আপাতত তাঁর পরিচয় সাইশা। নিজেকে ট্রান্সওম্যান হিসেবে সকলের সামনে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরে গর্বিত তিনি। সাইশার মতো আছেন অনেকেই। আর তাঁদের কারও জীবনই খুব একটা সহজ নয়।

ঠিক কী কী পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় ট্রান্সওম্যানদের? কীভাবেই বা এই অবস্থার বদল সম্ভব? এইসব নিয়েই কথা বলা হয়েছিল বাচিক শিল্পী, অভিনেতা ও গায়ক সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায় এবং প্রত্যয় জেন্ডার ট্রাস্টের ডিরেক্টর অনিন্দ্য হাজরার সঙ্গে।

anindya hazra and sujoyprasad chaterjee

অনিন্দ্য হাজরা (বাঁদিকে) এবং সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায় (ডানদিকে)

প্রশ্ন- পুরুষ হয়েও নিজের মধ্যে নারীসত্তা অনুভব করা, তারপর সেটা সমাজে প্রতিষ্ঠা করা, ঠিক কতটা রুক্ষ-নির্মম এই জার্নি?

সুজয়প্রসাদ- রুক্ষ এবং নির্মমের থেকেও বলব আমার কাছে এই জার্নিটা ভীষণ রকম ক্লিনিক্যাল। যদি কারও মনে হয় তাঁর মধ্যে নারী সত্তা রয়েছে এবং তিনি নিজেকে নারীরূপে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে চান, তাহলে তাঁকে অস্ত্রোপচার করাতে হবে। এক্ষেত্রে তাঁর শরীরের কোমর্বিডিটির ব্যাপারে নজর দেওয়াটা ভীষণ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

অনিন্দ্য- নাহ, রুক্ষ বা নির্মম বলে ওভাবে বিষয়টা জেনারেলাইজ করে দেওয়া যায় না। তবে হ্যাঁ এটা ঠিক যে শহরতলি বা মফঃস্বলের প্রত্যন্ত এলাকার একটি চাষি পরিবারের সন্তান যদি তাঁর জেন্ডার আইডেন্টিটি নিয়ে প্রশ্ন করেন এবং নিজেকে নিজের মতো করে প্রতিষ্ঠা করতে চান, তাহলে সেই ব্যাপারটা শহুরে প্রতিষ্ঠিত-শিক্ষিত পরিবারের সন্তানের তুলনায় অনেকটাই কঠিন এবং জটিল সমস্যা।

প্রশ্ন- জন্মগত ভাবে পুরুষ হয়েও আসলে আমি নারী, এই ভাবনা প্রকাশ পেলে কাছের মানুষগুলোও কি ভীষণ ভাবে বদলে যায়?

সুজয়প্রসাদ- এক্ষেত্রে দুটো ব্যাপারই হতে পারে। তাঁর পরিবার, কাছের মানুষরা তাঁকে প্রত্যাখান করতে পারেন। আবার আপন করেও নিতে পারেন। প্রথমটার সম্ভাবনাই অবশ্য এখনও অনেকটা বেশি। হয়তো কারও আত্মজন তাঁকে আঘাত করবেন না সেভাবে। তবে এই পরিবর্তনটা যাঁরা বুঝতে পারেন না তাঁদের ক্ষেত্রে বিষয়টা খুবই সমস্যার।

অনিন্দ্য- হ্যাঁ এই বদলে যাওয়ার ঘটনাটা তো হয়েই থাকে। যার জেরে একজন ট্রান্স মানুষ ভীষণ রকম ট্রমাটাইজ হতে পারেন। আসলে এখনও এদেশের বেশিরভাগ মানুষের কাছে গোটা ব্যাপারটাই একটা রোগ। এমনকি ডাক্তারদের ক্ষেত্রে বিশেষ করে মনোবিদদের অনেকেই পুরো বিষয়টাকে ক্লিনিকাল প্রসিডিওরে ফেলে দিয়ে রোগ সারাতে লেগে পড়েন।

Be yourself

নিজের মতো থাকুন।

অথচ বয়ঃসন্ধির সময় একজন যদি তাঁর জেন্ডার আইডেন্টিটি নিয়ে ক্রাইসিসে ভোগেন তাহলে তাঁর পরিবার, শিক্ষক, বন্ধু এবং ডাক্তাররা তাঁর সহমর্মী হয়ে তাঁকে সাহায্য করতে পারেন। কিন্তু এখানে হয় ঠিক উল্টোটা। মা-বাবা হয়তো সত্যিই বুঝতে পারেন না সন্তানের কী হয়েছে। তাই ডাক্তারের কাছেই নিয়ে যান। আর ডাক্তারদের অনেকেই গুচ্ছের ওষুধ, ইলেকট্রিক শক এসব দিয়ে ‘রোগ’ সারাতে শুরু করেন। সারা জীবনের মতো একটা মানুষ এইসব ট্রিটমেন্টের দরুণ থমকে যেতে পারেন।

এছাড়াও শৈশব এবং কৈশোরে স্কুল আর পরবর্তীকালে কলেজেও মারাত্মক ভাবে বুলি হতে হয় ট্রান্সদের। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁরা পড়াশোনাটা শেষ করতে পারেন না।

প্রশ্ন- এত সামাজিক বেড়াজালের মধ্যেও নিজের মানসিক দৃঢ়তা অটল রাখার উপায় কী? অস্তিত্বের লড়াইয়ে নিজেকে কীভাবে স্ট্রং রাখা সম্ভব?

সুজয়প্রসাদ- যেহেতু ব্যাপারটা খুবই ক্লিনিকাল তাই আমার মতে সঠিক ভাবে কাউন্সেলিং করাটা খুবই প্রয়োজন। সামাজিক বাধা তো থাকবেই। সমাজের স্রোতের উল্টো দিকে হাঁটলে সমস্যা তৈরি হবে। তবে আমার উত্তরণের পথে কীভাবে আমি এগোবো সেটা আমাকেই ঠিক করতে হবে। যেহেতু এই পরিবর্তন শুধু শারীরিক নয়, ভীষণ ভাবে মানসিক, তাই মন ভাল রাখার জন্য সঠিক ভাবে চিকিৎসকের কাছে গিয়ে কাউন্সেলিং করার পর ক্লিনিকাল প্রসিডিওরে যাওয়া উচিত।

creative

অনিন্দ্য- চিকিৎসা প্রণালীর মধ্যে না ঢুকিয়ে দিয়ে, পুরো ব্যাপারটা মেডিকালাইজ না করে বরং একটু খোলামেলা আলোচনা হওয়া প্রয়োজন এই জেন্ডার চেঞ্জের ব্যাপার নিয়ে। একজন পুরুষ যখন বুঝতে পারবেন যে তিনি আদতে নারী এবং সেই ভাবনাটা প্রকাশ করবেন, তখন সবার আগে তাঁর আশেপাশের ঘনিষ্ঠজনদেরই তাঁর হাতটা শক্ত করে ধরতে হবে, পাশে থাকতে হবে। আর পাঁচটা সাধারণ, স্বাভাবিক বিষয়ের মতোই এটাকেও দেখা প্রয়োজন।