ক্যাবেও মিলবে স্যানিটারি ন্যাপকিন, ট্যাবু ভাঙছেন ‘প্যাডম্যান’ ও ক্যাবচালক কলেজ ছাত্র
কলকাতার ক্যাবে এবার থেকে থাকবে স্যানিটারি ন্যাপকিন। ইতিমধ্যেই তিনটি ক্যাবে এই পরিষেবা চালু হয়েছে। আর এর পিছনে রয়েছেন এই শহরেরই দুই তরুণ: শোভন মুখোপাধ্যায় এবং অভ্র ভদ্র।
রাস্তায় বেরিয়ে আচমকাই হয়তো বুঝতে পারলেন আপনার পিরিয়ড শুরু হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গেই খেয়াল হল ব্যাগে প্যাড নেই। কোনও কারণে ‘ডেট’ ভুলে গিয়েছেন। অথবা আপনার পিরিয়ড চলছে, এমন সময় মাঝরাস্তায় ‘হেভি ফ্লো’ শুরু হল। প্যাড বদলানো দরকার। কিন্তু স্যানিটারি ন্যাপকিন সঙ্গে নেই। দোকান খুঁজে কিনে তারপর প্যাড বদলানো কার্যত অসম্ভব। সকলে না হলেও কালেভদ্রে এমন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন অনেক মহিলাই।
এ বার মহিলাদের জন্য সুখবর। কলকাতার ক্যাবে এবার থেকে থাকবে স্যানিটারি ন্যাপকিন। ইতিমধ্যেই তিনটি ক্যাবে এই পরিষেবা চালু হয়েছে। আর এর পিছনে রয়েছেন এই শহরেরই দুই তরুণ: শোভন মুখোপাধ্যায় এবং অভ্র ভদ্র। ‘কলকাতার প্যাডম্যান’ হিসেবে ইতিমধ্যেই জনপ্রিয় শোভন। এ বার তাঁর সঙ্গী অভ্র, যিনি পেশায় ক্যাবচালক এবং তৃতীয় বর্ষের কলেজ-ছাত্র। এই অভ্রর ক্যাবেই স্যানিটারি ন্যাপকিনের প্রথম বক্স বসিয়েছেন শোভন।
পাবলিক টয়লেট অর্থাৎ সুলভ শৌচালয়ে ইতিমধ্যেই স্যানিটারি ন্যাপকিন রাখার বক্স বসিয়েছেন ‘প্যাডম্যান’ শোভন। এ বার ক্যাবেও থাকবে স্যানিটারি ন্যাপকিনের বক্স। শোভনের কথায়, “রাস্তাঘাটে বেরিয়ে অনেকেই আচমকা বুঝতে পারেন তাঁদের পিরিয়ড হয়েছে। হয়তো সঙ্গে প্যাড থাকে না। এ রকম সমস্যায় পড়েছেন, এমন মহিলা যদি এই ক্যাবে চড়েন, তাহলে হাতের কাছে স্যানিটারি ন্যাপকিন পাবেন। আর চালককে সমস্যা বললেই তিনি কোনও সুলভ শৌচালয়ের সামনে গাড়ি নিয়ে যাবেন। অনায়াসে সমস্যার সুরাহা হবে।”
শোভনের আরও সংযোজন, “মূলত মহিলাদের সমস্যার সুরাহার জন্যই এই ব্যবস্থা রাখছি। তাছাড়াও আমার উদ্দেশ্য হল সোশ্যাল ট্যাবুগুলো ভাঙা। এই যে একুশ শতকে দাঁড়িয়েও ওষুধের দোকানে গিয়ে স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনলে কালো প্যাকেট এবং কাগজে মুড়ে দেওয়া হয়, সেটা তো ঠিক নয়। এই ভাবনাচিন্তাগুলো বদলানো দরকার। তাই ক্যাবে যদি স্যানিটারি ন্যাপকিনের বক্স রাখা হয়, সেটা সকলের চোখের সামনেই থাকবে।”
যাদবপুর বিশ্ববিদ্য়ালয়ের উইমেন স্টাডিজ় বিভাগের গবেষক তথা অভিনেত্রী উষসী চক্রবর্তী এই উদ্য়োগ প্রসঙ্গে বলেন, “এটা নিঃসন্দেহে ভাল উদ্যোগ। আমি যদিও খুব একটা ক্যাব ব্যবহার করি না। তবে মাঝেমধ্যে ক্যাবে চড়ি। সেক্ষেত্রে আমার যদি প্রয়োজন হয় আমি প্যাড চেয়ে নেব। এ নিয়ে তো লুকোছাপার কিছু নেই। এটা স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় ব্যাপার। লজ্জা পাওয়ার কিছুই নেই। আমরা তো দোকান থেকেই কিনি। আর আমি ওসব কালো প্যাকেট-কাগজ এসবে মুড়ে স্যানিটারি ন্যাপকিন দেওয়ার ঘোর বিরোধী। গণপরিবহণ হোক বা ক্যাব, স্যানিটারি ন্যাপকিন রাখার উদ্যোগ সত্যিই ভাল।” তবে উষসী মনে করিয়ে দিয়েছেন আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাঁর কথায়, “কোথায় প্যাড বদল করা সম্ভব, সেটাও খেয়াল রাখতে হবে। শুধু প্যাড রাখলেই হবে না। বাসে করে যেতে-যেতে যদি বুঝতে পারি আমার পিরিয়ড শুরু হয়েছে, সেক্ষেত্রে শুধু ন্যাপকিন নিয়ে কী হবে? কোথায় গিয়ে প্যাডটা বদলাবো, সেই দিকটা নিয়েও ভাবতে হবে।”
এই অভিযানে শোভনের কমরেড অভ্র বাণিজ্য শাখা (বি.কম.)-র তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। অভ্র অনেকদিন ধরেই শোভনের নানা কাজের সঙ্গে যুক্ত। এ বার এই নতুন কর্মযজ্ঞের সঙ্গী হতে পেরে উচ্ছ্বসিত তিনি। অভ্র বলছেন, “আমার ক্যাবে চড়ে একজন মহিলাও যদি উপকৃত হন, তাহলে আমার ভাল লাগবে। এর মধ্যেই মিশ্র প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। একজন স্কুল শিক্ষিকা চড়েছিলেন ক্যাবে। দারুণ প্রশংসা করেছেন এই কাজের। তিনি বলেছেন, ওঁর মেয়ে এবার থেকে রাস্তাঘাটে বেরোলে উনি নিশ্চিন্ত থাকবেন যে, এ ধরনের সুবিধা পাবেন। আর একজন তরুণীও বলেছেন রাতবিরেতে ক্যাবে উঠে যদি দেখি যে আচমকা পিরিয়ড হয়েছে, তাহলে অন্তত সুবিধা পাওয়ার আশা রাখতে পারব।” অভ্রর ক্যাবের পিছনে কাচের উপর লেখা রয়েছে, এই ক্যাবে স্যানিটারি ন্যাপকিন রাখা হচ্ছে। সেই সঙ্গে সামনের দু’টো সিটের পিছনের অংশে লাগানো হচ্ছে দু’টি প্ল্যাকার্ড। সেখানে লেখা সচেতনতার বার্তা।
ভূগোলের গবেষক এবং নিত্য ক্যাব-ব্যবহারকারী সৌমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই উদ্যোগ সম্পর্কে বলেন, “সত্যিই যেসব মহিলারা রোজ রাস্তায় বেরোন, এমনকি যাঁরা মাঝেমধ্যেও বেরোন, সকলের জন্যই এমন উদ্যোগ খুবই প্রয়োজনীয়। ভাবতে ভাল লাগে যে এই অভিনব ভাবনা একজন পুরুষের মস্তিষ্কপ্রসূত। দেখুন, আমার মতে, এবার থেকে ক্যাবে উঠে পিরিয়ড হয়েছে এটা আচমকা বুঝতে পারলে বা কারও প্রয়োজন হলে অন্তত তিনি একটা অপশন পাবেন। আর যেসব ক্যাবচালক এই উদ্যোগে সম্মতি দেবেন, তাঁরা নিশ্চিত যথেষ্ট সচেতন মানুষ। তাই চালকের থেকে প্যাড চেয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে কারও অসুবিধা হবে বলে আমার মনে হয় না।” সেই সঙ্গে সৌমিতা মনে করিয়ে দিয়েছেন আরও একটি বিষয়। তাঁর কথায়, “আরও একটা জিনিস বলব যে, ক্যাব কর্তৃপক্ষেরও উচিত এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া। ব্যক্তিগত উদ্যোগের পরিবর্তে সমষ্টিগত উদ্যোগ হলে হয়তো মানুষের ভাবনচিন্তা সামান্য হলেও বদলাবে।”
সত্যিই কি এই ভাবনা আমজনতার দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে পারবে? বাস্তবে এই ভাবনার গুরুত্ব কতটা? অর্থনীতির অধ্যাপক তথা নারী-আন্দোলনকর্মী শাশ্বতী ঘোষের কথায়, “এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রয়োজনীয় এবং প্রশংসনীয়। আর আমরা তো দোকানে গিয়ে স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুরুষ দোকানদারই জিনিসটা দেন। তাই সেক্ষেত্রে যদি সংকোচ না হয়, তাহলে ক্যাবের ক্ষেত্রেও সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তবে হ্যাঁ কোথায়, কীভাবে প্যাডটা পাওয়া যাচ্ছে, সেইসব তথ্য যাত্রীর কাছে আগে থেকে থাকাটা আবশ্যক।” তাঁর আরও বক্তব্য, “আর যদি ক্যাব কর্তৃপক্ষের তরফে বুকিংয়ের সময়েই যাত্রীকে আগাম তথ্য দেওয়া হয় যে, এই ক্যাবে স্যানিটারি ন্যাপকিন আছে, তাহলে ব্যাপারটা আরও ভাল হবে। এই উদ্যোগ বৃহত্তর ভাবে বাস্তবায়িত হলে সত্যিই উপকৃত হবেন মহিলারা।”
এর মধ্যেই অ্যাপ ভিত্তিক তিনটি ক্যাবে স্যানিটারি ন্যাপকিনের বক্স বসানো সম্ভব হয়েছে। আগামী দেড় মাসে শোভন-অভ্রর টার্গেট অন্তত ১০০টা বক্স বসানো। অভ্রও নিজের বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তবে বাধাও আসছে। অভ্রর কথায়, “ক্যাবে উঠে এক ভদ্রলোক বলেছেন, এভাবে প্রকাশ্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন রাখা অনুচিত।” শোভন বলছেন, “অল্প বয়সী ক্যাব চালকরা যেভাবে উৎসাহী হচ্ছেন, একটু বয়স্ক চালকরা একেবারেই রাজি হচ্ছেন না।” তবে নিজেদের লক্ষ্যে স্থির এই দুই তরুণ। আগামী দিনে শহরের মহিলারা সুদিন দেখবেন বলেই আশা করছেন তাঁরা।
কিন্তু আদৌ কি মহিলারা একজন পুরুষ চালকের থেকে স্যানিটারি ন্যাপকিন চেয়ে নিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন? জনস্বাস্থ্য গবেষক তথা ফ্রেঞ্চ ইনস্টিটিউট অফ পণ্ডিচেরীর রিসার্চ অ্যাফিলিয়েট অমিতাভ সরকার বলেন, “গোটা বিষয়টার তিনটে দিক রয়েছে। প্রথমত, চালকের সমাজগত অবস্থান। দ্বিতীয়ত, যাত্রীর সমাজগত অবস্থান এবং তৃতীয়ত, পিরিয়ডস এবং সতীত্ব ও নারীত্ব। একজন চালক কীভাবে তাঁর মহিলা যাত্রীকে দেখছেন (এখানে একজন স্ত্রী লিঙ্গের মানুষের প্রতি পুংলিঙ্গের মনোভাব)-তার উপরেই নির্ভর করবে একজন মহিলা যাত্রী একজন পুরুষ চালকের থেকে স্যানিটারি ন্যাপকিন নিতে কতটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন।”
আপাতত ১০ থেকে ১২টি ক্যাবে স্যানিটারি ন্যাপকিন রাখার ব্যবস্থা চলছে। ক্যাবের পিছন দিকে যেখানে টিস্যু পেপারের বক্স থাকে, সেখানেই বসছে এই বক্স। এই মুহূর্তে বিনামূল্যে পাওয়া গেলেও পরবর্তী কালে ৫ টাকার বিনিময়ে কিনতে হবে প্যাড। বদল হবে বক্সের জায়গাও। চালকের সামনে (স্টিয়ারিংয়ের উপর ফাঁকা জায়গায়) রাখা থাকবে বক্স। শোভনের কথায়, “যাত্রী এবং চালকের মধ্যে কথোপকথন হবে—এটাই আমি চাই। ট্যাবু ভাঙতে গেলে আগে এই লুকোচুরির ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলতে হবে।”
ট্যাবু প্রসঙ্গে সাইকোলজিস্ট শতাক্ষী ঘোষালের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “এখনও আমাদের সমাজে পিরিয়ড নিয়ে অসংখ্য ট্যাবু রয়েছে। তাই হয়তো কিছু সংখ্যক মহিলা যাত্রী পুরুষ চালকের থেকে প্যাড নিয়ে গাড়ি দাঁড় করিয়ে সুলভ শৌচালয়ে যেতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন না। তবে এইসব উদ্যোগ শুরু হওয়া প্রয়োজন। ধীরে ধীরে হলেও মানুষের চিন্তাভাবনার বদল হবে। দীর্ঘমেয়াদি ভাবে এইসব প্রজেক্ট চালাতে পারলে উপকার পাওয়া যাবে।” ট্য়াবু প্রসঙ্গে শতাক্ষীর বক্তব্যের স্পষ্ট রেশ অমিতাভর কথাতেও। তাঁর কথায়, “এখনও পিরিয়ড এবং সতীত্ব ও নারীত্ব নিয়ে আমাদের সমাজে প্রচুর ট্যাবু রয়েছে। সেক্ষেত্রে এমন ক্যাবে ওঠার আগে কোনও যাত্রী (পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে) শুচি-অশুচির প্রসঙ্গ টেনে আপত্তি করতে পারেন। তবে যাই হোক না কেন, এই উদ্যোগ এবং প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে প্রয়োজনীয়।”
ক্যাব থেকে আরও এক ধাপ এগিয়ে বৃহত্তর গণ-পরিবহণ ব্যবস্থায় স্যানিটারি ন্যাপকিনের অন্তর্ভুক্তিকরণের পরামর্শ দিয়েছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক স্যমন্তক দাস। স্যমন্তক বলেন, “আমি বিশেষ ক্যাবে চড়ি না। তবে আমার সহযাত্রী কোনও মহিলা যদি এমন পরিস্থিতিতে পড়েন যে তাঁর প্যাড প্রয়োজন এবং বদল করা দরকার, তাহলে আমি বিন্দুমাত্র আভাস দেব না যাতে সেই মহিলা অস্বস্তি বোধ করেন। এটা স্বাভাবিক শারীরিকবৃত্তীয় বিষয়। যেকোনও মহিলার যেকোনও সময়েই প্রয়োজন হতে পারে। গণ-পরিবহণের ক্ষেত্রে মেট্রোয় এই ব্যাপারটা চালু করা যেতে পারে। কারণ সেক্ষেত্রে প্যাড বদলানোর জন্য চেঞ্জিং রুম সহজেই তৈরি করে নেওয়া যেতে পারে।”
গণ পরিবহণে স্যানিটারি ন্যাপকিনের বক্স-
বাসে-ট্রেনে বিশেষ করে ট্রেনের মহিলা কামরায় স্যানটারি ন্যাপকিনের বক্স রাখার প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে করেন অমিতাভ। তাঁর কথায়, “কতজন ব্যবহার করবেন জানি না, হয়তো লজ্জার খাতিরেই অনেকে পিছিয়ে যাবেন, তবু বোধহয় গণ পরিবহণে এমন ব্যবস্থা থাকলে অনেক মানুষ উপকৃত হওয়ার সুযোগ পাবেন।”
এই প্রসঙ্গে শতাক্ষী অবশ্য বলছেন, “ভাবনাটা সত্যিই ভাল। তবে এর ফলে সমস্যা বাড়বে বই কমবে না। কারণ শুধুমাত্র টিটকিরি শোনার ভয়েই হয়তো অনেক প্রগতিশীল মহিলা বক্স থেকে স্যানিটারি ন্যাপকিন নেবেন ভেবেও পিছিয়ে যাবেন।”
আর গোটা ব্যাপারটা কাণ্ডারী শোভনের কথায়, “গণ-পরিবহণের ক্ষেত্রে বাস বা ট্রেন (দুরপাল্লার না-হলে) সেটাকে তো পাবলিক টয়লেটের সামনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই আপাতত ক্যাব দিয়েই শুরু করেছি। তবে দূরের জার্নিতে ট্র্যাভেলার গাড়ির ক্ষেত্রেই এই প্রকল্প চালু করার কথা ভাবছি। কথাবার্তাও চলছে।”
গ্রাফিক্স ও অলকরণ- অভীক দেবনাথ ও অভিজিৎ বিশ্বাস