শিক্ষা দরকারি, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই ভাল মানুষ হওয়ার একমাত্র মাপকাঠি নয়

কিছু লোকের অজ্ঞতা দেখে আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়ি, যাঁরা প্রশ্ন করেন নরেন্দ্র মোদী স্নাতোকোত্তর কি না। অথচ ওঁর বক্তৃতা শুনলেই বোঝা যাবে যে বেদান্ত দর্শন সম্পর্কে ওঁর অগাধ জ্ঞান রয়েছে।

শিক্ষা দরকারি, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই ভাল মানুষ হওয়ার একমাত্র মাপকাঠি নয়
ছবি প্রতীকী।
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Dec 28, 2021 | 2:21 PM

প্রবীর কে বসু (প্রাক্তন সচিব, কৃষিমন্ত্রক)

নতুন বছরে বিভিন্ন সংকল্প গ্রহণ (নিউ ইয়ার রেজোলিউশন) আজ একটা ফ্যাশন। কিন্তু আমার কাছে এসব একেবারে ভিত্তিহীন, কোনও মানে রাখে না। প্রত্যেকের উচিত একটাই সংকল্প নেওয়া যে কীভাবে তিনি ভাল মানুষ হবেন। এক্ষেত্রে সচেতনতা অর্জনের পাশাপাশি বিভিন্ন নেতিবাচক আবেগ যেমন- অহঙ্কার, লোভ, রাগ, কাম, দাম্ভিকতা, ঔদ্ধত্য, ঘৃণা এসব দূর করা প্রয়োজন। আর এর পাশাপাশি বিভিন্ন ইতিবাচক বিষয় যেমন- ভালবাসা, সহানুভূতি এইসবের বৃদ্ধি করা দরকার। আর এটা কোনও বার্ষিক লক্ষ্য নয়। বরং একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। আর তার উদ্দেশ্য হল এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে আমরা যেন ইতিবাচক কিছু প্রভাব রেখে যেতে পারি।

ভাল মানুষ হওয়ার জন্য শিক্ষা অবশ্যই প্রয়োজন, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই ভাল মানুষ হওয়ার পর্যাপ্ত মাপকাঠি নয়। কালিদাস, রামকৃষ্ণ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিবেকানন্দ, রমন মহর্ষি, গুরু নানক এবং অন্যান্য অমর ভারতীয়রা হয়তো ঐতিহ্যগত ভাবে বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় সেভাবে শিক্ষিত ছিলেন না ঠিকই, কিন্তু অনেক উচ্চ-শিক্ষিত ব্যক্তিও তাঁদের গভীর মননশীলতা এবং চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবেন না। এমনকি অনেক নিম্ন স্তরেও দেখা যায় জ্ঞান, প্রজ্ঞা এবং দক্ষতার জন্য পুঁথিগত শিক্ষাই একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। উদাহরণ স্বরূপ এমএস শুভলক্ষ্মীর কথাই ধরা যাক। শাস্ত্রীর সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে তাঁর দক্ষতা একজন সঙ্গীতে পিএইচডি করা ব্যক্তির তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই একই কথা প্রযোজ্য কিশোরী আমোকার, নন্দলাল বোস, শাশ্বতী সেন, যামনী কৃষ্ণমূর্তি, বলরাজ সাহানি, কপিল দেব, সানিয়া মির্জা, সাইনা নেহওয়াল, পি ভি সিন্ধু, বিশ্বনাথ আনন্দ, এস ডি বর্মণ এবং আরও লক্ষ লক্ষ মহান ভারতীয়র জীবনে।

আসলে শিক্ষা কাকে বলে বা প্রকৃত শিক্ষা ঠিক কী, এই প্রসঙ্গে আমাদের ধারণাই ভুল। আমরা মনে করি কেউ যদি পশ্চিমী ধাঁচের স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা না পান, তাহলে তিনি শিক্ষিত নন। একজন ব্যক্তি যদি আঞ্চলিক ভাষায় ঐতিহ্যগত ভারতীয় জ্ঞানে পারদর্শী হন, তাহলে তাঁকে নিকৃষ্ট মনে করা হয়ে। আসলে এগুলো ভ্রান্ত ধারণা ছাড়া আর কিছুই নয়।

আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাত বছর পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়েছি। এর পাশাপাশি বেদান্ত দর্শনের ছাত্রও ছিলাম। আমি আপনাদের একটা ব্যাপারে আশ্বস্ত করতে পারি যে দ্বিতীয়টা পড়তে যে আইকিউ এবং প্রচেষ্টা প্রয়োজন (শুধুমাত্র ধারণাটুকু নেওয়ার জন্য ত্রিপুরা রহস্যের ১৪ নম্বর অধ্যায়টি আমায় ১০ বার পড়তে হয়েছে) তার তুলনায় শিফের কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বই পড়া সোজা। আর এই কারণেই কিছু লোকের অজ্ঞতা দেখে আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়ি, যাঁরা প্রশ্ন করেন নরেন্দ্র মোদী স্নাতোকোত্তর কি না। অথচ ওঁর বক্তৃতা শুনলেই বোঝা যাবে যে বেদান্ত দর্শন সম্পর্কে ওঁর অগাধ জ্ঞান রয়েছে। সেই সঙ্গে মহাভারত, রামায়ণ এবং অন্যান্য অনেক ধর্মগ্রন্থ সম্পর্কেও জ্ঞান রয়েছে তাঁর। এর মধ্যে থেকে কিছু জিনিস তিনি আবৃত্তিও করতে পারেন। ইনি যদি শিক্ষিত মানুষ না হন, তাহলে কে শিক্ষিত? রামচন্দ্র গুহ? যিনি নিজের কৃতিত্ব অনুযায়ী কোনও প্রকার গবেষণা ছাড়াই একজন ইতিহাসবিদ। বই লেখা কোনও গবেষণা নয়। আমিও বই লিখেছি। চেতন ভগতও লিখেছেন।

আপনি যদি মহাভারত পড়েন, বোঝেন এবং তা অন্তর্নিহিত করেন তাহলে আমি সেটাকে ঠিক ততটাই গুরুত্ব এবং মূল্য দেব, যতটা বস্টনের ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউ অফ টেকনোলজির পদার্থবিদ্যার পিএইচডি করা একজনকে দেব। এখন যে বিষয়টা আমায় সবচেয়ে বিরক্ত করে তা হল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া কিছু শিক্ষিত লোকজন যেমন- মনীশ তিওয়ারি, প্রণয় রায়, আমির খান, বামপন্থী দল এবং তাদের সঙ্গীসাথীরা মোদীজির বড় সংস্কার পদক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। কারণ তাঁর কাছে আইভি লিগের কোনও প্রমাণপত্র বা ওই লিগের সদস্যদের সঙ্গও নেই।

অথচ বর্তমানে আমাদের দেশে মেয়েদের বিয়ের নূন্যতম বয়স ১৮ বছর থেকে বাড়িয়ে ২১ করা হয়েছে। আমাদের সমাজের জন্য এটা সত্যিই যুগান্তকারী উন্নয়ন। সমস্ত মেয়েরাই এই পরিবর্তনে খুশি হয়েছেন। আমার ঠাকুমা এবং মায়ের বিয়ে হয়েছিল মাত্র ১৮ বছর বয়সে। ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা পাশ করার পরই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল তাঁদের। অথচ তাঁরা গানবাজনায় পারদর্শী ছিলেন। কিন্তু তাতে লাভ কী? দু’জনেই শুধু রান্নাঘর এবং বাচ্চাদের বড় করতে গিয়েই জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। তবে পরবর্তী প্রজন্ম কিছুটা অন্য রকমের। আমায় দুই বোন এমএ ডিগ্রি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন এবং ভাল ফলও করেছেন। কিন্তু তারপরেও বিশেষ লাভ হয়নি। এমএ ডিগ্রি শেষ করার পরই দুই বোনের বিয়ে হয়ে যায়। তারপর সেই রান্নাঘর আর বাচ্চাদের লালন-পালনের কাজ। সেই তুলনায় আমার স্ত্রী বেশ ভাগ্যবতী। ২০ বছর বয়সে বিয়ের পরও এমএ এবং পিএইচডি করেছেন। তারপর দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের হংসরাজ কলেজে অধ্যাপিকা হিসেবে যুক্ত হন। নিঃসন্দেহে একটি সন্তোষজনক এবং ফলপ্রসূ কর্মজীবন পেয়েছেন তিনি।

আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কিন্তু দারুণ ভাবে এগোচ্ছে। আমার দুই পূত্রবধূই আমেরিকার নামকরা প্রতিষ্ঠান থেকে পিএইচডি করেছেন। এক ভাইঝি লন্ডনের একটি বিখ্যাত মাল্টিন্যাশনাল্ল কোম্পানিতে কর্মরত রয়েছেন। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পর এমবিএ করেছিলেন তিনি। আরও এক ভাইঝি খুব অল্প বয়সেই একটি প্রথম সারির স্কুলের সহ-অধ্যক্ষ হয়েছেন। ভারতের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একজন বিশারদও তিনি। কিন্তু এত উন্নয়নের পরেও নাশকতাকারীদের এই বিল নিয়ে সমস্যা রয়েছে।

এর সঙ্গেই রয়েছে আরও একটি বিষয়। মুসলমানরা মোদীর বিপক্ষে ভোট দেন। কিন্তু কেন এই বিরুদ্ধাচারণ? আমি বুঝতেই পারি না। তবে এখন সেই সময় এসেছে যখন ভারতের মুসলমানদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তাঁরা যুক্তিবাদী হয়ে এমন একজন নেতাকে বেছে নেবেন যিনি দেশে জন্য মঙ্গলের, নাকি গণমাধ্যম এবং রাজনৈতিক দল নির্মিত বিভিন্ন কুসংস্কারের ভিত্তিতে তাঁকে ছুঁড়ে ফেলে দেবেন। বিশেষ করে মুসলিম মহিলাদের এই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ তিন-তালাক বিল এবং বাবিহের নূন্যতম বয়স ২১ বছর হওয়ায় সরাসরি সুবিধা পাবেন তাঁরা। এটি তাঁদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজের বেড়াজাল পিতা, ভাই, চাচা, স্বামী এবং অবশ্যই ধর্মীয় গোঁড়াদের অবৈধ ও অন্যায় থাবা থেকে মুক্তি পেতে সহায়তা করবে। যে সুযোগ মুসলিম মহিলারা পাচ্ছেন তা যদি হাতছাড়া হয়, তাহলে ভোগান্তি হবে তাঁদের। প্রকৃতপক্ষে, তাঁদের এখন বহুবিবাহের সীমাবদ্ধতা (চার স্ত্রীর মধ্যে সীমাবদ্ধ) থেকে মুক্তির দাবি করা উচিত। কিছু মুসলমান পুরুষ এখনও এই প্রথা অনুসরণ করেন।

দেশের এই সমস্ত সমস্যা নির্মূল করার সময় সমস্ত দমে থাকা ভারতীয়দের, তাঁরা দলিত হোন, মহিলা (বিশেষ করে মুসলমান মহিলা), উপজাতি, বিশেষভাবে সক্ষম, পাহাড়ি উপজাতি— সকলেরই একজোট হওয়া প্রয়োজন। হয়তো এটা দীর্ঘস্থায়ী হবে। সংস্কারবাদী মোদীজিকেও সবসময় পাওয়া যাবে না। তাই মহিলা এবং সেই সমস্ত মানুষ যাঁরা সুদৃঢ় ভারত গড়ার পক্ষে রয়েছেন, তাঁদের প্রতি আমার আবেদন এই সুযোগ হাতছাড়া করবেন না। আমি একজন সরকারি কর্মী ছিলাম এবং একজন বিচারকও। তাই বিভিন্ন বিষয়ে দৃষ্টিকোণ তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, শিক্ষাবিদ, ডাক্তার, আইনজীবী, কন্ট্রান্টর, আমলা, অপরাধী— এদের সকলেই সম্পর্কেই একটি মিশ্র ধারণা তৈরি হয়েছে। আর তাই আমি ভাল উদ্দেশ্য চিনতে পারি। মোদী ভারত পরিবর্তনের চেষ্টায় নিজের ভূমিকা পালন করছেন। সত্ত্বর দেশের ভাল পরিবর্তনের জন্য তাঁর প্রয়োজন সমর্থন এবং উৎসাহ প্রয়োজন। উনি অমর নন। পরবর্তীতে সোনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধী, শরদ পাওয়ার, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে কেউ হতে পারেন… আমি আর বলছি না।

বাংলা প্রবাদে আছে সাধা লক্ষ্মী পায়ে ঠেলতে নেই। অর্থাৎ ঈশ্বর যখন আপনাকে ভাল কিছু দিচ্ছেন, তখন সেটা দূরে সরিয়ে দেবেন না। এটাই আসল সত্যি।