Durga Puja 2021: সপ্তমীতে কলাবউ স্নান! গণেশের পাশে কাপড়ে ঢাকা কলাগাছ রাখা হয় কেন?

লজ্জাপটাবৃতা অবগুণ্ঠনবতী রহস্যাবৃতা কে এই নারী? সর্বাঙ্গ বস্ত্রাচ্ছাদিতা কে এই বামা? বস্ত্রের আড়ালে কেনই বা এই দেবী নিজেকে আপাদমস্তক মুড়ে রেখেছেন ?

Durga Puja 2021:  সপ্তমীতে কলাবউ স্নান! গণেশের পাশে কাপড়ে ঢাকা কলাগাছ রাখা হয় কেন?
ছবিটি প্রতীকী
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Oct 08, 2021 | 6:34 AM

ডঃ জয়ন্ত কুশারী

মা দুর্গার পরিবারের কোনও এক সদস্যকে ঘিরে এত বিচিত্র সব মন্তব্য হতে পারে, বিশ্বাস করুন আমার অন্ততঃ জানা ছিল না। তবে মন্তব্যগুলো কিন্তু মোটেই আবোলতাবোল নয়। তা শুনলেই বুঝতে পারবেন। তাই কথা আর বাড়াব না।শুনুন সেই মন্তব্যগুলোর দু-একটি নমুনা –Who is the odd deity, mother ? Who is covered from top to bottom by clothes,not be made by the clay Goddess Durga and her companions ?

এ হেন জিজ্ঞাসা ছোট্ট সম্বর্তের।একুশ শতকের ইংরাজী মাধ্যম স্কুলের ছাত্র সে। বলার অপেক্ষা রাখে না, জিজ্ঞাসাটা ছিল তার মাকে। তিন দশক আগে ফিরে যান। এক দশক বা দুই দশক আগেও তিন দশক আগের কথার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। তাই তিন দশককে ভিত্তি দশক হিসেবে ধরে নিলে, তখন যে কথাটি শিশুদের বা আপেক্ষিক কিছুটা বড়দের মুখো মুখে ফিরত, সেটা ছিল এইরকম। কিন্তু না,প্রশ্নটা তাদের গর্ভধারিণীকে নয়। সরাসরি গণেশকে এবং অবশ্যই সেই তাঁকে ঘিরে। আর ছড়াতে। এখন শোনা যাক্ সেই ছড়া।

গণেশ দাদা পেটটি নাদা পায়ের তলায় ইঁদুর কলা বৌ-কে বিয়ে কোরে ( তোমার ) কপালে কেন সিঁদুর ?

সত্যিই তো, মা দুর্গা আর তাঁর সঙ্গী-সাথীদের তো পটুয়ারা বানিয়েছেন। রণরঙ্গিণী মায়ের ডাঁয়ে লক্ষ্মী,গণেশ। বাঁয়ে সরস্বতী, কার্ত্তিক। মাথায় বাবা আশুতোষ দেবাদিদেব।আর পদপ্রান্তে মহাসিংহ, মহিষাসুর ও মহিষ। পটুয়ার নিপুণ হাতে কেমন জীবন্ত হয়। পুরোহিত মহাশয়ের অন্তরের ভক্তিপূর্ণ পূজার্চনায় মৃন্ময়ীতে চিন্ময়ীর আবির্ভাব হয়। আয়োজকদের আয়োজনে ভক্তিবিনম্র পুষ্পাঞ্জলি প্রার্থনায় আর বাদ্যকারের ঢাকের বাদ্যিতে অসীমার প্রবেশ ঘটে সসীমাতে। তাই না, আনন্দময়ীর আগমনে বিশ্বের আপামর জীবকুল ভূমানন্দে মেতে ওঠে। প্রকৃতিও জানান দেয় তারাও সেই আনন্দের শরিক।

কিন্তু, এ কি ! এঁদের মাঝে লজ্জাপটাবৃতা অবগুণ্ঠনবতী রহস্যাবৃতা কে এই নারী? সর্বাঙ্গ বস্ত্রাচ্ছাদিতা কে এই বামা? বস্ত্রের আড়ালে কেনই বা এই দেবী নিজেকে আপাদমস্তক মুড়ে রেখেছেন ?

সর্বসমক্ষে প্রকাশমানা দেবীর পাশে আকৃতি-প্রকৃতিগতভাবে বিপরীত মেরুতে অবস্থানরতা রক্ষণশীলা এই দেবীকে বড়ই বেমানান ( Odd deity ) লাগে বই কি।

আরে আরে ! সীমন্তিনী অবগুণ্ঠিতা এই দেবী ঘোমটার আড়াল থেকে কিছু যেন বলতে চাইছেন। বাস্তবের কোলাহল মুখরতা থেকে বের হয়ে ধ্যান নিমগ্নভাবে এই দেবীর কথা শাস্ত্রমুখে শুনুন। মিতভাষী স্মিতহাস্যে অতি মৃদুস্বরে বলে চলেছেন –“ওরে পাগল, জীব মাত্রেই দুটি সত্তা থাকে। একটি অন্তঃ সত্তা অপরটি বহিঃ সত্তা। আমার থেকেই যদি তাদের ( জীবকুল +উদ্ভিদকুলের ) সৃষ্টি হয়ে থাকে, তবে আমার থেকেই তারা এই দ্বৈত সত্তা পেল। তাই আমি যখন ধারণ কর্ত্রী, পালনকর্ত্রী বা পোষণকর্ত্রী তখন আমার সত্ত্বগুণের প্রকাশ। অন্তঃ সত্তাটি প্রকটিত হয়। ধারণ করলেই তো হবে না। বাছাদের ( জীব +উদ্ভিদকুলকে ) আমার জীবন ধারণের জন্য খেতে দিতে হবে। তৃষ্ণা মেটাতে হবে। পরতে দিতে হবে। লজ্জা নিবারণের জন্য। তবেই না, পালন আর পোষণ কাজটা যথার্থ হবে। বাছাদের আমার সবাইয়ের সব খাবার রোচে না। কারও শরীর আবার কোনও বিশেষ খাদ্যগুণসম্পন্ন খাদ্যকেই চায়। অন্য খাদ্যগুণের খাদ্যকে তার পাকস্থলী পাক করতে পারে না। অর্থাৎ সুপাচ্য নয়। তাদের ত্বকের পরিচর্যার ক্ষেত্রেও সেই একই কথা।

এখন এই কথাগুলি ভেবেই সাত্ত্বিক আহার যেমন প্রস্তুত করতে হয়েছে, একই সঙ্গে কটু-অম্ল-কষায়-লবণ-উষ্ণ-রুক্ষ-বিদাহী-শৈত্য খাদ্যগুণসম্পন্ন খাদ্য এই নয়টি প্রাকৃতিক ভেষজে আমার অবস্থান। ভিন্ন ভিন্ন রূপে আর বিভিন্ন নামে। তারই সামগ্রিক রূপ হলো নবপত্রিকা রূপ। যাকে তোরা কলা বৌ বলিস। এই অন্তঃ সত্তা রূপটি সর্বসমক্ষে প্রকাশমানা হতে পারে না। কেননা,আন্তঃ ভাব একান্তই অন্তরের। তাই আমি আপাদমস্তক বস্ত্রাবৃতা ও অবগুণ্ঠিতা। রম্ভা ( কলাগাছ বা কলাতে ) -তে আমি “ব্রহ্মাণী” নামে। কচুতে আমি “কালিকা” নামে। হরিদ্রাতে আমি “দুর্গা” নামে। জয়ন্তীতে আমি “কার্তিকী” নামে। বিল্বেতে আমি “শিবা” নামে। দাড়িমী ( ডালিমে )-তে আমি “রক্তদন্তিকা নামে। অশোকে আমি ” শোকরহিতা ” নামে। মানে আমি “চামুণ্ডা” নামে। ধানে আমি “লক্ষ্মী” নামে বিরাজ করি।

শুম্ভ-নিশুম্ভবধ কালে অষ্ট শক্তির সৃষ্টি করেছিলাম আর আমি স্বয়ং ছিলাম। এই নয়টি দেবীই আসলে নবপত্রিকার অধিষ্ঠাত্রী দেবী বলে স্বীকৃতি দিয়েছি। আমার বহিঃসত্তাই হলো দশভূজা রূপটি। দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনের জন্যই এই রণরঙ্গিণী রূপ ধারণ আমার। সবই প্রয়োজনে। জীবের আর্তিনাশের জন্য। আমার পাঞ্চভৌতি ( ক্ষিতি-অপ্-তেজ্-মরূৎ-ব্যোম্ ) দেহতে অধিবাস। এই দেহেই আমি অন্তঃপুরেই দর্পণ প্রতিবিম্বে নানা দ্রব্যসম্ভারে তিন তিথি ( সপ্তমী-মহাষ্টমী-মহানবমী )-তে মহাস্নান করি। আবার আমার অন্তঃসত্তা রূপটি সূর্যোদয়ের একদণ্ড ( চব্বিশ মিনিট ) কাল আগে থেকে পূর্বাহ্ন (সকাল ন-টা সাতাশ মিনিট)মধ্যে গঙ্গায় বা প্রতিষ্ঠিত জলাশয়ে অথবা গৃহপ্রাঙ্গনে অবগাহন স্নানটি সম্পন্ন হবে। এই কালটি অতিক্রম করলে জগতের অনিষ্ট হয়। আবার সময়ে স্নানটি হলে জগতের মঙ্গল হয়। এই বলে তিনি শ্লোকটি বললেন –“পূর্বাহ্নে নবপত্রিকা শুভকরী সর্বার্থসিদ্ধিপ্রদা”। ” মধ্যাহ্নে জনপীড়ণক্ষয়করী সংগ্রাম ঘোরাবহা”।

হ্যাঁরে পাগল এর পরেও কি আমাকে গণেশের বৌ বলবি ? ওরে আমি যে গণেশজননী। তাই তো ওর ( গণেশের ) ডান দিকে থাকি। বৌ-এর স্থান তো বাম দিকে। বুঝলি এই ভুলটা আর করিস না।

আর দুটি সত্তা যখন পাশাপাশি অবস্থান করে তখন আপাত দৃষ্টিতে বেমানান হতেই পারে। যেহেতু সত্তাদুটি আকৃতি ও প্রকৃতিগতভাবে ভিন্ন মেরুতে অবস্থান করে। দৃষ্টি প্রসারিত করলে বোঝা যায় একই দেহের দুটি অঙ্গ। একটি অন্তরঙ্গ ( অন্তঃ অঙ্গ ), আর অন্যটি বহিরঙ্গ ( বহিঃ অঙ্গ )। এই বলে তিনি মুখরতা ভঙ্গ করে মৌনব্রত অবলম্বন করলেন। এবারে অধম প্রতিবেদক মৃন্ময়ী আর ভেষজময়ীর সাযুজ্য রচনা করার জন্য ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে যেটুকু বলা যায় তাই বলছে।

একদিকে পাঞ্চভৌতিক দেহ নিয়ে সপরিজন মা এসেছেন মৃন্ময়ী প্রতিমায় চিন্ময়ী রূপ ধারণ করে। মা ভৈঃ ( ভয় পেও না ) মন্ত্র দান করতে। অন্যদিকে “জগতঃ প্রাণরক্ষার্থং আগতোsসি হরপ্রিয়ে”। জীবকূলের প্রাণের দ্যোতক রূপে তাঁর এই ভেষজময়ী রূপ পরিগ্রহ। ভাবতে ভালো লাগে উভয়ের অবস্থান কিন্তু একই কাঠামোতে। শরীর ও মন নিয়ে জীবদেহ গঠিত হয়েছে। একে অন্যের পরিপূরক। ভাব ওতপ্রোতঃ। মন হলো মৃন্ময়ী প্রতিমা। শরীর হলো ভেষজময়ী ( নবপত্রিকা ) প্রতিমা। মনই তো শরীরকে চালনা করে। তাই মৃন্ময়ী প্রতিমা এলে তাঁর অঙ্গুলি হেলনে ভেষজময়ী রূপ সশরীরে বিরাজ করেন। একজনকে পটুয়া বানায়। অন্যজনকে রূপদান করেন পুরোহিত মহাশয়।

শাস্ত্র-বিজ্ঞান-বাস্তব কোথায় যেন ( এখানে ) মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। সহাবস্থান ঘটেছে। কি অপূর্ব রসায়ন ! কি অভূতপূর্বদৃশ্য!! যা প্রত্যক্ষ করলেন বিশ্বচরাচর। সচরাচর না দেখা দৃশ্যটা দৃষ্টিগোচর হয় ভক্তসাধারণের দৃষ্টিপথে দেবীদ্বয়ের সহাবস্থান। তখন তিনি আর বেমানান ( Odd deity ) দেবী থাকেন না। তখন তিনি হয়ে ওঠেন–

‘চিরকল্যাণময়ী তুমি ধন্য প্রাণীকুলের তরে বিতরিছ অন্ন।’

লেখক : সর্বভারতীয় প্রাচ্যবিদ্যা আকাদেমি-র অধ্যক্ষ।