তারকেশ্বর: বদলে যাওয়া জলছবি

Tarakeswar Yatra 2024: ছোটবেলায় বাসে করে যেতে যেতে চোখে পড়ত জলযাত্রীদের। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতাম। শেওড়াফুলি থেকে টানা তারকেশ্বর বাবার মন্দির! বাঁকেতে লাগানো ঘণ্টা, ঘুঙুরের শব্দের তালে, বাবা তারকনাথের নাম গুনগুন করে এক অদম্য যাত্রা। এক অদ্ভূত ছন্দ। ট্রেনে-বাসে-রাস্তায় জলযাত্রীদের ভিড় ঢেলে রাস্তার একপাশে পাল্টে যাওয়া নানা দৃশ্য এখন স্মৃতির জানলায় উঁকি মারছে। পাল্টে গিয়েছে জলছবিটাই। কেমন সেই বদলে যাওয়া জলযাত্রীদের জলযাত্রা?

তারকেশ্বর: বদলে যাওয়া জলছবি
Follow Us:
| Updated on: Jul 24, 2024 | 6:00 PM

দীপ্তা দাস

ব্যোম ব্যোম তারকব্যোম…. ভোলেবাবা পার কারেগা…। ঘুঙুর-ঘণ্টার মতো আওয়াজগুলো যেন সাঁ সাঁ করে সরে যাচ্ছে একপাশ দিয়ে। একসঙ্গে এত কথা, এত আওয়াজ শোনেনি পুলু। গাড়ির সামনে বসে হাঁ করে দেখে যাচ্ছে সে। নালিকুলে দিদার মামারবাড়ি থেকে বিয়ে বাড়ি কাটিয়ে ফিরছে সে। তখন প্রায় সন্ধ্যে। শনিবার। চন্দননগরে ফেরার পথে তারকেশ্বর রোড ধরতে গাড়ি ডান দিকে মোড় নিতেই দাঁড়িয়ে গেল। সামনে দিয়ে একনাগাড়ে বাঁকে করে জলভর্তি ঘড়া নিয়ে প্রায় দৌড়ে হাঁটছেন জলযাত্রীরা। বেশ বিশাল একটা দল পার হতে বড় রাস্তায় গাড়ি উঠতেই ফের দাঁড়িয়ে গেল। এক বিশাল রথ। কেদারনাথের আস্ত মন্দিরটাই যেন সামনের দিকে ধেয়ে আসছে। ঘণ্টা, কাঁসর নিয়ে সে এক উন্মত্ত দল। ছোট থেকে যুবক, মধ্যবয়স্ক। মাতালের মতো নেচে-কুঁদে ভোলেবাবা পার কারেগা, ব্যোম ভোলে, বাবা তারকনাথ বলে চিত্কার করছে। পিছনে আবার তারস্বরে বাজছে ডিজে। তার বিকট আওয়াজে হৃদপিণ্ডের স্পন্দন বন্ধ হওয়ার জোগার। পুলু প্রায় আতঙ্কে গাড়ির জানলা নামিয়ে অবাক চোখে দেখে যাচ্ছে। চঞ্চল বাচ্চাটি এমন দৃশ্য আগে কখনও দেখেনি। দেখিনি আমিও। আস্ত মন্দিরের আদলে তৈরি রথ নিয়ে বাবা তারকনাথের আশীর্বাদ নিতে যাওয়ার হিড়িক দেখে আমারও প্রায় ভিমরি খাওয়ার দশা। গাড়ির সামনে বাস, অটো, টোটো, লড়ি সার সার হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। শ্রাবণ মাস যে পড়ে গিয়েছে, মাথায় ছিল না। বাংলা ক্যালেন্ডারে কবে যে শ্রাবণ মেলা শুরু হচ্ছে তা বহুতলে কর্পোরেট অফিসে বসে কাজ করা কর্মরতার পক্ষে জানা সম্ভব নয়। টার্গেট আর ডেটলাইনের ঘেরাটোপে রোজকার জীবনটাই ঘেঁটে ঘ।

নালিকুল সিনেমাহল থেকে নালিককুল স্টেশনরোড ধরতে প্রায় আধঘণ্টা কেটে গিয়েছে। ডানপাশে জলযাত্রীদের ভিড়। একটু ফাঁকা হতেই আবার গাড়ির হর্ন বাজিয়ে এগিয়ে যেতে আবার থমকে গেলাম। এবার একটা বিরাট সাইজের ঘণ্টা। হ্যাঁ ঘণ্টা। সোনালি রঙের ঘণ্টার থিমে তৈরি রথ আসছে। একটা শক্তপোক্ত ফ্রেমে রেখে, নীচে চাকা লাগিয়ে গড়গড় করে ছেলে-বুড়ো সামনের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সিভিক পুলিশের বাঁশির আওয়াজে সব গাড়ি আরও বামদিকে সরে যাচ্ছে। ঘণ্টার আদলে তৈরি রথের পিছনে পিছনে বাঁকে করে জল নিয়ে আসছেন বেশ কয়েকজন। জলযাত্রীদের কর্মকাণ্ড দেখে রীতিমতো ঘাবড়ে যেতে হয়। অনেকক্ষণ ধরে এমন অদ্ভূত, অচেনা ঘটনার সাক্ষী থাকার পর পাঁচ বছরের পুলুর প্রশ্ন, ‘এরা কারা মা? কোথায় যাচ্ছে?’ এতক্ষণ ধরে এই প্রশ্নটারই অপেক্ষা করছিলাম। পরীক্ষার খাতায় যেমন কমন প্রশ্ন পড়লে মনে পুলক জাগে, তেমনিই অবস্থা আমার। প্রশ্ন শুনে সটান উত্তর আমার। এরা সবাই তারকেশ্বরের তারকনাথ মন্দিরের যাচ্ছে, মহাদেবের মাথায় জল ঢালতে। সবাই যাচ্ছেন একসঙ্গে। শেওড়াফুলি, কলকাতা, বৈদ্যবাটী, শ্রীরামপুর, দক্ষিণেশ্বর থেকে জল নিয়ে বাবার মাথায় জল ঢালতে যাচ্ছেন। শ্রাবণ মাস পড়েছে, এই সময় শিবের মাথায় জল ঢাললে অনেক অনেক আশীর্বাদ পাওয়া যায়। প্রতিবছর এরা এইসময় জল ঢালেন। কতদূর দূর থেকে আসেন। সবাই পায়ে হেঁটে যাচ্ছেন। শেওড়াফুলির নিমাই ঘাট থেকে গঙ্গাজল ভরে নিয়ে বাবার থানে হেঁটে যান। তারপরই শুরু মন্দিরে লাইন দেওয়া। তারপর জল ঢেলে বাড়ি ফেরা।

কেন করে? এমনি এমনিই করে। মুচকি হেসে বললাম। এমনি এমনি কেন করবে? কারও ভক্তি, কারও ইচ্ছে, কিছু আকাঙ্খা থাকে, সব মিলিয়ে মহাদেবের কাছে বিশেষ প্রার্থনা করতেই এই রীতি। সেই ইচ্ছের কথা জানাতে সব কষ্ট ভুলে নোংরা-কাঁকড়ে ভরতি রাস্তা পার করে, জলভর্তি ঘড়া বাঁধা বাঁক নিয়ে বাবার কাছে যান। বাবার মাথায় জল ঢাললেই সেই ইচ্ছে বা প্রার্থনা পূরণ হয়। তারকেশ্বর বাবা সকলের কথা শোনেন। সব মনের ইচ্ছে পূরণ করে। বলতে না বলতেই মুষল ধারে বৃষ্টি নেমে এল। এমন অঝোরে বৃষ্টি পড়তে শুরু হল যে জানলার ওপারের পরিবেশ পুরো ধোঁয়াশায় পরিণত হয়ে গেল। তড়িঘড়ি গাড়ির কাঁচ উঠিয়ে আস্তে আস্তে গাড়ি চালাচ্ছি। কানের পাশ দিয়ে সরে যাচ্ছে ঘুঙুর, বাঁকে লাগানো ঘণ্টার আওয়াজ। কানে আসছে ছন্দে ছন্দে সুর করে বলে চলা  ‘ভোলেবাবা পার কারেগা… ভোলেবাবা পার কারেগা… ব্যোম ব্যোম তারক ব্যোম…’। মুষলধারা বৃষ্টির মধ্যেও সেই স্লোগান, সেই সুর থামার কোনও লক্ষণ নেই। কাকভেজা হয়েও হন হন করে হেঁটে চলেছে বাচ্চা থেকে বুড়ো।

এমন অভিজ্ঞতা ছেলের আগে কখনও হয়নি। স্বাভাবিক। ওয়াইপার দিয়ে বৃষ্টির জল সরাতেই গেরুয়া শার্ট-প্যান্ট পরা ছোকড়া, চুলের হরেক রকমের স্টাইল, উন্মত্ততা, অবলীলায় নেশা করতে যাওয়ার দৃশ্য দেখে বেশ আতঙ্কিত হলাম। মহিলারাও সেই দলে সামিল। সময়টা দ্রুত ঘুরপাক খাচ্ছে। নালিকুলের একটি প্রাচীন জায়গা রয়েছে, যেখানটা বলা হয় গির্জার মোড়। যদিও গির্জার কোনও অংশের মতোই দেখতে নয়। ছোটবেলায় বহুবার বাসে করে আসার সময় এই প্রাচীন গম্বুজটাকে দেখে বুঝতে পারতাম মামারবাড়ি আর বেশি দূরে আর নেই। সেই গম্বুজে এখন অজস্র অশ্বত্থ-বট গাছের ফ্যাকড় বেরিয়েছে। দেখাই যাচ্ছে না। মাঝে একটি অংশ লাল রঙের ইট বেরিয়ে যেতে দেখা গিয়েছে। তবে এই গম্বুজ মনে হয় মল্লরাজার আমলে তৈরি। আবার ব্রিটিশ আমলেও তৈরি হতে পারে। স্থানীয়রা একে গির্জার মোড় বলে থাকেন। এই গির্জার মোড় আবার জনপ্রিয় হয়েছিল বাবা তারকনাথ সিনেমার খাতিরে। সন্ধ্যা রায় যখন জলযাত্রী হিসেবে হেঁটে হেঁটে তারকেশ্বরে বাবার থানে যাচ্ছিলেন, সেই দৃশ্যে এই গম্বুজটি দেখা গিয়েছিল। রাস্তার ধারে ওই গম্বুজটি দেখিয়ে নিজের ছেলেকেও বললাম, ‘ওই দ্যাখ গির্জা!’ ছেলে সেখানে মধ্য কলকাতার জোড়া গির্জা খুঁজছে। বুঝতে না পেরে বলে উঠল, ‘কোথায় গির্জা? দেখতে পাচ্ছি না তো? চলে গেল নাকি?’ ছেলের কথা শুনে বুঝতে পারলাম, আমাদের ছোটবেলা আর ওর ছেলেবেলা এক নয়। পুরনো আমলের একটা গম্বুজকে দেখে কেনই বা বিশ্বাস করবে যে এটা গির্জা!

বৃষ্টি একটু ধরেছে। রাস্তাঘাট জল জমে একেবারেই বিচ্ছিরি অবস্থা। ওভারব্রিজ হওয়ায় রাস্তার অবস্থা বেশ বেহাল। এবড়ো- খেবড়ো রাস্তায় কোথাও বড় আকারের গর্ত। গাড়ির একটি চাকা পড়লে মনে হচ্ছে খাদের একপাশে পড়ে যাচ্ছে। তবে বৃষ্টি কমতেই চারিদিক যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠল। মেঘের কোণে এখনও কালো মেঘ জমে রয়েছে। পাতার উপর থেকে ধুলো সরে গিয়ে গাঢ় সবুজ, হালকা সবুজের ছোট বড় গাছগুলি যেন এক নেশার ঘোরে স্থির হয়ে আছে। আকাশে ঘন কালো মেঘের সঙ্গে গাঢ় সবুজধারী গাছের ছায়ায় পরিবেশ যেন গুরুগম্ভীর হয়ে গিয়েছে। নেমে এসেছে অন্ধকার। রাস্তার একপাশ গিয়ে গাড়ি-লড়ি-বাস ধীরগতিতে চলছে। অন্যপাশ দিয়ে ঝন-ঝন, ঝুম-ঝুম, ঘণ্টার আওয়াজ, কাঁসরের আওয়াজ, বহুজনের পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে। গেরুয়া রঙের টিশার্ট। গেরুয়া রঙের হাফপ্যান্ট। কোমড়ে কাদামাটি মাখানো লাল রঙের গামছা আঁটো করে বাধা। কাঁধে বাঁশের বাঁকের দুধারে জলভর্তি পিতলের ঘড়া। মাঝারি নয়। বড়ও নয়। ছোট মাপের। সঙ্গে এক আটপৌড়ে মহিলা। লালপেড়ে কাদামাখা শাড়ি। হাতে একটি ঘটি। ঘড়া ও ঘটির মুখে গঙ্গামাটি ঢিপি করে লেপটানো। সঙ্গে ৭ বা ৮ বছরের কিশোর। গেরুয়া শার্ট, নীলরঙা কাদামাখানো হাফপ্যান্ট। হাতে একটা ছোট্ট ডুগডুগি। বাম দিকের কাঁধ থেকে ডান দিকে করে রাখা রয়েছে কাপড়ের একটি কাদামাখা স্কুল ব্যাগ। এই ব্যাগ বহুদিন দেখিনি। ছোটবেলায় গ্রামের দিকে গেলে সব ছেলেমেয়ের বাড়িতে এই ব্যাগ থাকত। পড়তে যেতে বা স্কুলে যেতে এমন মোটা কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহার করা হত। তিনজনেই খালি পায়ে হনহনিয়ে হেঁটে চলেছে। ভাবলেশহীন। ক্লান্তিহীন। তিনজনের একটাই তাগিদ, জলের ঘড়া নিয়ে যতটাদূর এগিয়ে যাওয়া যায়।

একনিমেষে হারিয়ে গিয়েছিলাম ছোট্ট আমিতে। শ্রাবণী মেলার সময় বাসে করে মাসির বাড়ি বা মামারবাড়িতে এলে এমন দৃশ্য চোখে পড়ত। এখনকার মতো এত জমজমাট ছিল না। সাদাসিদে। শান্ত। সকলেই সুন্দর করে সারি বেঁধে ভোলেবাবাকে ডাকতে ডাকতে প্রায় ঊর্দ্ধশ্বাসে দৌঁড়াত। অনেকে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কোনওরকমে বাবার থানে পৌঁছাতেই হবে। পায়ে ফস্কা। কেটে যাওয়া পা নিয়েও অক্লান্ত হয়ে হেঁটে চলেছেন সকলে। সিঙ্গুরের পথে ডাকাত কালী বাড়ি আসতে ফের একবার জ্যামে পড়লাম। এই ডাকাত কালী বাড়ি নিয়ে রয়েছে বহু কাহিনি। ছোটবেলায় মা-মাসিরা বলতেন, শ্রাবণী মেলার সময় জলযাত্রীরা ওই ডাকাত কালী মন্দিরে না দাঁড়ালে ঘোর বিপদ হয়। মন্দিরে না দাঁড়ালে বাবার কাছে পৌঁছাতেই পারেন না কেউ। তবে এই ডাকাতকালী বাড়িতে দাঁড়ানোর পিছনে রয়েছে একটি প্রধান কারণ। দেশে প্রথম রেলপথ চালু হয় ১৮৫৩ সালে। বাংলায় শুরু হয় তার একবছর পর, ১৮৫৪ সালে। সেইসময় হাওড়া থেকে হুগলি পর্যন্ত রেল চালু হয়েছিল। অন্যদিকে বাংলার বুকে, শ্রাবণী মেলা উপলক্ষ্যে দেশের নানা প্রান্ত থেকে ভক্তরা পূণ্যার্জনে ছুটে আসতেন তারকেশ্বরে। রেলপথ যখন চালু হয়, সেইসময় অধিকাশ মানুষ বিশ ক্রোশ পথ হেঁটেই পাড়ি দিতেন। তেমনি শেওড়াফুলি নিমাই তীর্থঘাট থেকে তারকেশ্বর পৌঁছাতে ভক্তরা পায়ে হেঁটেই পারি দিতেন। তখনকারদিনে, অধিকাংশই জঙ্গলে ঘেরা ছিল। পথ ছিল সরু। বাংলার ঠ্যাঙারে, ডাকাতদের ছিল চরম দাপট। ভক্তদের কলসি, ঘড়া, জামা-কাপড়… কোনও কিছুই বাদ পড়ত না। এমনকি সঞ্চয়ের কড়ি, পয়সাও হাতিয়ে নিত। সর্বস্ব খোয়াতেন অনেকেই। তারকেশ্বরের পুণ্যার্থীদের সর্বস্ব লুঠ করার আগে ও পরে এই কালী মন্দিরে পুজো দিতেন ডাকাতরা। সেইসময় ডাকাতের নাম শুনলেই আতঙ্কে দোরের দরজা বন্ধ করে দিতেন মহিলারা। ডাকাতদের হাত থাকে বাঁচাতে বাংলার বিশিষ্টরা ইংরেজদের কানে তোলেন। তারপরই ইংরেজের নির্দেশে হোরমিলার কোম্পানিকে তারকেশ্বর-বৈদ্যবাটি (শেওড়াফুলি) রেলপথ পাতার অনুমতি দেয়। জমিদার-সহ বিশিষ্টরা জমি দান করেন। তৈরি হয় রেলপথ। সেইসময় মাত্র পাঁচটি ছিল রেলস্টেশন। গোবিন্দপুর নামটি পরে দিয়ারা হয়েছে। সিঙ্গুর, নালিকুল, হরিপাল ও তারকেশ্বর। ১৮৮৫ সালের জানুয়ারি।

এই তারকেশ্বর রেলপথ ধরে সারদা মাও তারকেশ্বর যাত্রা করেছিলেন। মন্দিরে বাবাঠাকুরের দ্রুত আরোগ্য লাভের জন্য হত্যে দিয়ে পড়েছিলেন। শুধু তিনিই নয়, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন বসু এই রেলপথ ব্যবহার করেছিলেন। তবে মন্দিরে দেবদর্শনের জন্য নয়। কোনও রাষ্ট্রীয় এক সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছিলেন। হুগলির বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে অনেক কালী মন্দির। প্রাচীনকাল থেকেই এই এলাকা কালীক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত। শাক্ত বাঙালিরা সাধারণত কালীর আরাধনাই করেন। পরবর্তীকালে তারকেশ্বর মন্দির নির্মাণের পর শিবের ক্ষেত্র বলে পরিচিতি হয়।

ডাকাতকালী মন্দির পেরিয়ে দিয়ারার রাস্তা ধরতেই গাড়ি আবার আটকে গেল। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়েই চলেছে। ভিজে শরীরে লেপ্টে থাকা কাপড়, কাকভেজা ভক্তকূলের ভিড় যেন আরও বেড়ে চলেছে। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো এগিয়ে যাচ্ছে তারকানাথ দর্শনের উদ্দেশ্যে। বাইরের দৃশ্য ও পরিবেশ নেশার মতো জাপটে ধরেছিল। খানিক খানিক নস্টালজিক হয়ে যাচ্ছিলাম। এই সব দৃশ্য দেখার পর পুলুর চোখে বিষ্ময় কাটতেই চাইছে না যেন। জুলু জুলু চোখ নিয়ে জানলার ওপাশে কী ঘটে চলেছে, তাই দেখে চলেছে। অনেকক্ষণ ধরে চুপচাপ ছিল। অন্ধকার রাস্তায় গাড়ির জ্যামে আটকে বিরক্তও হচ্ছে বটে। এত লোকজনের ভিড় দেখে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে চলল। তারকেশ্বর কোথায়? ওখানে কী আছে? শিবের মাথায় জল ঢালে কেন? কী হয় সেখানে?

প্রশ্ন শুনে মনে হল এবার আমার অগ্নিপরীক্ষা শুরু হল। বাবা তারকনাথ সিনেমায় একটা গানের কলি আছে, ‘এবার তোমার পরীক্ষা…বল মা…’। সেই হয়েছে আমার দশা! একটু সময় নিয়ে ভাবলাম, একটু গুছিয়ে বলব, তার আগেই পুলুর গলা, ‘ওই দ্যাখ আরও একটা রত! শিবের রত! কত বড়!’ একটা বিশাল সাইজের ঘড়া। দুদিকে পালকির মতো ঘড়াটাকে জনাকুড়ি যুবক নিরবে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। একজন আবার পথ দেখাচ্ছে। লিডার গোছের। একটু করে নিয়ে যাচ্ছে। আবার কাঁধ বদল হচ্ছে। সারা রাস্তা ডিজের শব্দে প্রাণ অতিষ্ঠ। আবার একটা বাঁকে সুন্দর করে ফুল, রঙবেরঙের চাইনিজ লাইট দিয়ে সাজিয়েছে। বেশ সুন্দর দেখতে লাগছে। বড় বড় ঘুঙুর আর ঘণ্টা দিয়েছে। পুলুর কানে ইতিহাস গুঁজে দিতে শুরু করলাম এই বলে, ‘এই ভক্তের জন্যই ভগবানের অবস্থান। তারকেশ্বরের শিব তারকনাথ নামে পরিচিত। বাড়িতে শিবলিঙ্গ দেখেছ। এমন শিবলিঙ্গ সারা ভারতে বিগ্রহরূপে পূজিত। কোথাও তাঁকে স্থাপন করা হয়েছে, আবার কোথাও তিনি স্বয়ম্ভূ। তারকেশ্বরে বাবা তারকনাথ স্বয়ম্ভূ। মানে নিজ নিজ অধিষ্ঠিত। তারকেশ্বরের একদিকে বাংলার দুঃখের নদ দামোদর, আরেকদিকে গঙ্গা। দেশের সব শিবক্ষেত্র নদীর কাছাকাছি অবস্থিত। কিন্তু এই মন্দিরটিই একমাত্র নদী থেকে বেশ দূরে। তাই গঙ্গাকে নিয়ে এসে পুজো করার রীতি। বাঙালি মানে আমাদের কাছে বাবা তারকনাথ বড্ড নিজের। আপনজন।’

মহাশিবরাত্রি, চড়ক, নীলপুজো, চৈত্র মাসের গাজনে এই শিবের পুজোয় ভক্তের ভিড় মারাত্মক। আর এই শ্রাবণমাসে প্রতিটি দিন শিবের পুজো করা হয়। বিশেষ করে সোমবার। রবিবার দুপুরে গঙ্গাজল নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। সারারাত হেঁটে বাবার থানে লাইন দেন। সোমবার সকাল থেকে সেই জল শিবের মাথায় ঢালেন। দুধ, ডাবের জলও নিবেদন করেন। সেই দুধ ও জল গিয়ে পড়ে মন্দিরের সামনে অবস্থিত দুধপুকুরে। সেখানে স্নান করলে বা ডুব দিলে আরোগ্য লাভ হয়। মানে রোগভোগ, শরীর খারাপ হয় না আর। আর তারকনাথের মাথায় জল ঢাললে পুণ্যলাভ হয়, মনোবাসনা পূর্ণ হয়, অনেকের মানত থাকে, তা পূর্ণ করেন। সন্তানলাভ, আর্থিকলাভের খোঁজে তারকনাথের কাছে ছুটে যান সবাই। শিব তো খুব রাগী যোগী। রুদ্র মূর্তি ধারণ করেন। শ্রাবণ মাসেই সমুদ্রমন্থনের ঘটনা ঘটেছিল। সমুদ্র মন্থনের সময় মারাত্মক বিষাক্ত হলাহল পান করে নিজ কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন মহাদিদেব। বিষের তীব্রতায় নীল হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। সৃষ্টিরক্ষার জন্য তিনি নিজের প্রাণও ত্যাগ করতে রাজি ছিলেন। কিন্তু সেই সময় পার্বতী এসে তাঁর শরীরের বিষক্রিয়া রোধের জন্য মাথায় জল ঢেলেছিলেন। সেই থেকে শিবের মাথায় জল ঢালার রেওয়াজ তৈরি হয় হিন্দু ধর্মে। দীর্ঘপথ হেঁটেও কোনও ভক্তের কোনও শরীর খারাপ হয় না। ক্লান্তি থাকে না। থাকে শুধু পরিতৃপ্তি। শান্তি। দুঃখকষ্টের পরিত্রাতা তারকনাথ সকলের ডাকে সাড়া দেন।

গল্পের ছলে পুলুকে বোঝাতে শুরু করলাম। তারকেশ্বর মন্দিরটি তৈরি করেছিলেন রাজা ভারমল্ল। তিনি ছিলেন পরম শিবভক্ত। তারকেশ্বর নালিকুল থেকে বেশি দূরে নয়। এই ভারমল্লের বাবা ছিলেন কেশব হাজারি। তিনি বেনারস থেকে এই তারকেশ্বরে থাকতে শুরু করেন। সেই সময় এই জায়গার নাম তারকেশ্বর ছিল না। ছিল তাড়পুর, রামনগর এলাকার মধ্যে। কেশব হাজারির দুই পুত্র ও এক কন্যা। দুই পুত্র বিষ্ণুদাস ও ভারমল্ল। দুই ভাই নিজেদের মালিকানা জাহির করার জন্য অনেক টাকা ট্যাক্স নিত। এবার সেই ট্যাক্সের কথা কানে গেল সেইসময়কার নবাবের কানে। তাঁদের বন্দি করা হল। কিন্তু কারাগারে থাকাকালীন বিষ্ণুদাস নানা অলৌকিক শক্তি দেখাতে শুরু করেন। নবাব প্রীত হয়ে তাঁদের ছেড়ে দেন। শেষে আবার বালিগোরি ও মোহনবাগ পরগনার রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব দিয়ে দেন। ভারমল্ল যেখানে থাকত, সেখানে একটা প্রকাণ্ড গোশালা ছিল। সেই গোশালার একটি গরু কপিলা ছিল তাঁর অত্যন্ত প্রিয়। সেই গোশালার দেখাশোনা করতেন মুকুন্দ ঘোষ নামে এক কর্মচারী। রাজা ভারমল্ল লক্ষ্য করলেন, কপিলা দুধ কম দিচ্ছে। এর কারণ জিজ্ঞাসা করাতে মুকুন্দ একদিন কপিলার পিছু নিল। যে জঙ্গলে চড়তে যেত, সেই জঙ্গলে এক পরিত্যক্ত শিবলিঙ্গের উপর নিজের দুধ দিতে শুরু করে। এমন ঘটনা দেখে রাজাকে গিয়ে বললেন সে। শিবভক্ত রাজা জঙ্গল পরিদর্শন করতে গিয়ে দেখেন সেই জঙ্গলে এক সন্ন্যাসী সাধনা করছেন। তিনি আবার উত্তরাখণ্ড থেকে বাংলায় এসেছেন শৈবধর্ম প্রচারে। তিনি আর কেউ নন যোশীমঠের নিষ্প্রাণ গিরির শিষ্য মায়াগিরি। তাঁরসঙ্গে ছিলেন আরও এক সন্ন্যাসী মুকুন্দ গিরি। তাঁরা দুজনেই এই পরিত্য়ক্ত শিবলিঙ্গের আরাধনা করেছিলেন। শিবলিঙ্গের নানা অলৌকিক ক্ষমতা দেখে ওই শিবলিঙ্গটি অন্যত্র প্রতিষ্ঠা করার নির্দেশ দেন রাজা ভারমল্ল। বন পরিষ্কার করে শিবলিঙ্গ তোলার কাজ শুরু হলেও সেই খোঁড়ার কাজ আর শেষ হচ্ছে না। শিবলিঙ্গের শেষ কোথায়, তা কেউ বুঝতে পারছেন না। সেই সময় শিব স্বপ্নাদেশ দেন, ওই শিবলিঙ্গ কেউই তুলতে পারবে না। কারণ ওই বন থেকে গয়া ও কাশী পর্যন্ত ছড়িয়ে আছেন তিনি। তাই তাড়পুরের জঙ্গল থেকে না তুলে সেখানেই মন্দির গড়ার নির্দেশ দেন মহাদেব। ১৭২৯ সালে নির্মাণ হয় তারকেশ্বর মন্দির।

তারকেশ্বর নিয়ে কথা বলতে বলতেই গাড়ি চালাচ্ছিলাম। ধীর গতিতে। সঙ্গে সঙ্গী ‘‘ব্যোম ব্যোম তারক ব্যোম, ‌ভোলে ব্যোম তারক ব্যোম।’’ সঙ্গে রয়েছে আবার খেলা হবে! হর হর মহাদেব!। কথা শেষ হতেই চোখে পড়ল একটা জায়গায় জলচ্ছত্র খুলেছেন স্থানীয়রা। এমন জলচ্ছত্র শ্রাবণী মেলার সময় রাস্তার ধারে প্রচুর দেখা যায়। তবে এই জলচ্ছত্রের জায়গায় গরম গরম লুচি-হালুয়া বিলি করা হচ্ছে পূণ্যার্থীদের মধ্যে। শেওড়াফুলি থেকে জল বয়ে নিয়ে বাবার মাথায় জল ঢালা হলে পুরো দিন উপবাস রাখাই নিয়ম। তাই যত্রতত্র জলচ্ছত্রে ফলের রস, পানীয় জল বিলি করছে দেখলাম। জলযাত্রীদের দেখলেই বাবা তারকনাথ সিনেমার কথা মনে পড়বেই পড়বে। কারণ এই সিনেমা রিলিজ হওয়ার পর থেকেই বাংলায় তারকেশ্বর যাত্রার এক গিমিক ছড়িয়ে পড়ে। বাঙালির প্রিয় এই সিনেমার দৌলতে ছড়াগুলি দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ছোটবেলায় বাসে করে যেতে যেতে ভক্তের সমুদ্রের ঢেউ বোধহয় চোখে কম পড়েছিল। তখন দেখে মনে হত, কোথা থেকে আসছে কাতারে কাতারে এই ভক্তের ঢল। এই যাত্রা তো সহজ নয়। অত্যন্ত পরিশ্রম, সংযম ও সক্ষমতার পরীক্ষা। সেই সময় শুনতাম ৩৭ কিমি রাস্তার পরিশ্রম লাঘব করার জন্য বনে-জঙ্গলের ভিতরে ঢুকে গাঁজা বা ছিলেম টানত। এখন গাড়ির কাঁচের ওপারে দেখছি সব উন্মুক্ত। দু’পা অন্তর বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা। সেখানেই চলছে নেশা করার সুযোগ। বাবার থানে যাবে, আর গাঁজার সুখটান থাকবে না, তা কী করে হয়? গলা অবধি মদে চুর হয়ে দিব্য নাচতে নাচতে পায়ে পা মিলিয়ে চলছে তারকেশ্বর যাত্রা। এই যাত্রায় বাঙালি ভক্তের তুলনায় শ্রাবণী মেলায় অবাঙালিদের ভিড় বেশি। শিবের সঙ্গে যোগ হয়েছে বজরঙ্গবলীরও। গেরুয়া পতাকায় হনুমানের ছবি। শিবের নামে মাথায় একটি লাল রঙের ওড়না বা ফেট্টি বাধা। তাতে লেখা রয়েছে ‘হর হর মহাদেব’। হিন্দিভাষীদের মুখে সেই শব্দ মানালেও বাঙালিদের মুখে সেটা বেশ বেমানান। ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকলে রাস্তায় নেমে পড়েছে। শুধু তাই নয়, পথের মধ্যে দেখা গেল বিরাট সাইজের একটি জাতীয় পতাকাও। পুলু দেখতে পেয়ে বেশ উত্তেজিত। দেখেই সজোরে বলে উঠল, ‘ওই দ্য়াখো ন্যাশানাল ফ্ল্যাগ’!

ছোটবেলার স্মৃতির ভাঁজে বর্তমান অবস্থার তলানি খুঁজতে খুঁজতে পুলুর চিত্‍কারে সম্বিত ফিরল। শেওড়াফুলি দিয়ে গাড়ি নিয়ে যাওয়ার রিস্ক নিলাম না। রাত হয়ে এসেছে। দিল্লি রোড ধরে, বৈদ্যবাটির মোড় ছাড়িয়ে চন্দননগরের রাস্তা ধরলাম। সেখানেও দেখলাম ভক্তদের ভিড় কম নয়। অন্ধকার রাস্তায় দল বেঁধে ভক্তরা উর্ধ্বশ্বাসে হাঁটছেন। রাস্তার দিক থেকে একবারও চোখ ফেরাল না। ঘটি-ঘড়া কাঁধে নিয়ে আপন খেয়ালে সুরে ছন্দে পা মিলিয়ে হাঁটছেন তাঁরা। গাড়ি চালাতে চোখে পড়ল দূরের একটি গাছে টিমটিম করে আলো জ্বলছে। কাছে আসতেই তা পরিষ্কার হল। জোনাকির মেলা। একটি গাছ চকচক করে জ্বলছে জোনাকি পোকার আলো। সেই গাছের আলোর নীচ দিয়ে সার বেঁধে হেঁটে চলেছেন জলযাত্রীরা, হালকা দুলকি চালে। মৃদু স্বরে সুর করে বলে চলেছে, ‘ভোলেবাবা পার কারেগা… ব্যোম ব্যোম তারক ব্যোম’। ছোটবেলার স্মৃতি যেন আরও একবার চোখের সামনে ভাসতে থাকল। সাক্ষী থাকল নিজের সন্তানও। এক অদ্ভূত অনুভূতি। জীবনের বাড়তি পাওনা বললে কম হবে।