বিশ্লেষণ : তালিবান রাজে নতুন শিখরে আফগানিস্তানের আফিম-অর্থনীতি?

TV9 Bangla Explain on Afghanistan Poppy Economy : যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান অর্থনীতির একটি বড় অংশ নির্ভর করে রয়েছে আফিম চাষের উপর। রাষ্ট্রপুঞ্জের মাদক ও অপরাধ দমন শাখার তথ্য অনুযায়ী আফিম চাষের থেকে প্রতিবছর ১২০ কোটি ডলার থেকে ২১০ কোটি ডলার পর্যন্ত আয় করে আফগানিস্তান। যা সে দেশের মোট জিডিপির প্রায় ৬-১১ শতাংশ।

বিশ্লেষণ : তালিবান রাজে নতুন শিখরে আফগানিস্তানের আফিম-অর্থনীতি?
আফগানিস্তানে কি এবার আফিমের বাড়বাড়ন্ত নতুন শিখর স্পর্শ করবে ?
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Sep 22, 2022 | 1:12 PM

কাবুল : ইসলামে আফিম বা অন্য যে কোনও ধরনের মাদক সেবন ‘হারাম’। অর্থাৎ নিষিদ্ধ। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে বিশ্বের সবথেকে বড় আফিম উৎপাদনকারী দেশ আফগানিস্তান। দুই দশক আগে তালিবান রাজে হু হু করে বেড়েছে আফিমের ব্যবসা। দীর্ঘ কুড়ি বছরের মার্কিন সেনা অভিযানেও তাতে কোনও বদল হয়নি।

আফিম থেকে হেরোইন বা অন্যান্য মাদক তৈরির ডেরাগুলিতে আকাশপথে অভিযান চালিয়েছে মার্কিন সেনা। গম চাষে উৎসাহ দেওয়ার জন্য প্রচুর টাকা খরচ করেছে। আমেরিকার আফগানিস্তান বিষয়ক বিশেষ ইস্পেক্টর জেনারেলের ২০১৮ সালে প্রকাশিত এক রিপোর্ট অনুযায়ী, কাবুলিওয়ালার দেশে আফিম চাষ বন্ধ করার জন্য ৮৬০ কোটি ডলার খরচ করেছে মার্কিন মুলুক। কিন্তু অশ্বডিম্ব প্রসব ছাড়া আর কিছুই হয়নি! গত দুই দশকে হু হু করে বেড়েছে আফিম চাষ।

রাষ্ট্রপুঞ্জের মাদক ও অপরাধ দমন শাখার ২০০১ সালের পরিসংখ্যান বলছে আফগানিস্তানে অন্তত ৮ হাজার হেক্টর জমিতে আফিম চাষ হত। আর ২০২০ সালে তা বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ২৪ হাজার হেক্টর জমি। বিশ্বে মোট যে পরিমাণ আফিম চাষ হয়, তার শতকরা ৮০ ভাগই এই আফগানিস্তানে।

আফগানিস্তানের আফিম অর্থনীতি

যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান অর্থনীতির একটি বড় অংশ নির্ভর করে রয়েছে আফিম চাষের উপর। রাষ্ট্রপুঞ্জের মাদক ও অপরাধ দমন শাখার তথ্য অনুযায়ী আফিম চাষের থেকে প্রতিবছর ১২০ কোটি ডলার থেকে ২১০ কোটি ডলার পর্যন্ত আয় করে আফগানিস্তান। যা সে দেশের মোট জিডিপির প্রায় ৬-১১ শতাংশ।

Poppy cultivation in Afghanistan

বিশ্বে মোট আফিমের সিংহভাগই চাষ হয় আফগানিস্তানে

২০১৯ সালে যেখানে ১ লাখ ৬৩ হাজার হেক্টর জমিতে আফিম চাষ হত, ২০২০ সালে তা বেড়ে ২ লাখ ২৪ হাজার হেক্টর হয়েছে। আর এই এলাকাগুলির মধ্যে একটি বড় অংশ তালিবানের দখলেই ছিল। আফগানিস্তান আফিমের উপর এতটাই নির্ভরশীল যে করোনা অতিমারির সময়েও তা কমার কোনও লক্ষ্মণ নেই। বরং ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে ৩৭ শতাংশ বেড়েছে আফিম চাষ।

আফিম তো ছিলই। তার সঙ্গে আবার ২০১৫ সাল থেকে যোগ হয়েছে আফেড্রা। আফগানিস্তানের পাহাড়ি এলাকায় এই গুল্মজাতীয় গাছ থেকে ক্রিস্টাল মেথ নামে এক ধরনের মাদক তৈরি হচ্ছে।

ভাগ রয়েছে তালিবানেরও

ইসলামে আফিম জাতীয় মাদককে ‘হারাম’ বলা হয়েছে। কিন্তু তালিবানের মতো কট্টর ইসলামিক গোষ্ঠী, যারা কিনা ‘ধর্মের জন্য লড়াই’ করে, তাদের মধ্যেও কোনওদিন আফিম চাষ বন্ধ করতে তেমন উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে আফগানিস্তানের অর্থনীতি আফিমের উপর কতটা নির্ভরশীল। আর বিশেষ করে তালিবরা যখন মার্কিন সেনার বিরুদ্ধে লড়াই করছিল, তখন তাদের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য অর্থও আসত এই আফিমের ব্যবসা থেকেই।

২০২১ সালের মে মাসে আমেরিকার আফগানিস্তান বিষয়ক বিশেষ ইস্পেক্টর জেনারেলের রিপোর্ট অনুযায়ী, তালিবদের মোট আয়ের প্রায় ৬০ শতাংশ আসে মাদক ব্যবসা থেকে। বিবিসির এক রিপোর্ট বলছে, ২০১১ সালে আফিম চাষ থেকে বছরে ৪০ কোটি ডলার মুনাফা কামাত তালিবান। আর ২০১৮ সালের শেষে সেই মুনাফার ঝুলি বড় হতে হতে পৌঁছেছে ১৫০ কোটি ডলারে।

আমেরিকার আফগানিস্তান বিষয়ক বিশেষ ইস্পেক্টর জেনারেলের রিপোর্ট যদি হুবহু মিলে যায়, তাহলে তালিবরা এখন আফিম চাষ থেকে বছরে ৮০ হাজার কোটি ডলার কামাচ্ছে। রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, যেসব এলাকা তালিবানের দখলে ছিল, সেই সব এলাকায় আফিম চাষিদের থেকে ১০ শতাংশ করও কাটা হত।

তালিবানের ‘আই ওয়াশ’

কিন্তু আফিম চাষের সঙ্গে তালিব যোগের কথা কোনওদিনই প্রকাশ্যে স্বীকার করে না তালিবান নেতারা। বরং বারবার আফগানিস্তানকে আফিম মুক্ত করার কথাই বলে এসেছে তারা। আর কথায় কথায় ২০০০ সালে আফিম নিষিদ্ধ করার আইনের প্রসঙ্গ টেনে আনে। প্রথম পর্বের তালিবান রাজ শেষ হওয়ার ঠিক আগে আগে ২০০০ সালে আফিম চাষ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।

আন্তর্জাতিক মহলের চাপের মুখে পড়ে ১৯৯৭ সালে তালিবরা প্রথম জানিয়েছিল, তারা আফিম চাষ বন্ধ করে দেবে। মোল্লা ওমরের আমলে আফিম চাষ নিষিদ্ধ করতে কড়া আইন আনা হয়েছিল। যারা এরপরেও আফিম চাষ করবে, তাদের শরিয়া আইন মতে শাস্তিও দেওয়া হবে। কিন্তু সবই ছিল চোখে ধুলো দেওয়ার মতো। আদতে ১৯৯৬ সালে যেখানে ২ হাজার ২৫০ টন আফিম চাষ করা হত, ১৯৯৯ সালে তা বেড়ে ৪ হাজার ৫৮০ টন হয়েছিল।

এরপর ২০০০ সালে অবশ্য কড়া আইন এনেছিল তালিবান সরকার। কিন্তু কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা এবং অর্থনীতিবিদদের একাংশ মনে করেন, আফিম চাষ নিষিদ্ধ করার পিছনে অন্য উদ্দেশ্য ছিল তালিবানের। অনেকে বলেন, আন্তর্জাতিক মহলের স্বীকৃতি পেতেই এই কড়াকড়ি দেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছিল।

তবে একটি বড় অংশের মতে, সেই সময় আন্তর্জাতিক বাজারে আফিমের দাম কমতে শুরু করেছিল। আর তালিবদের মুনাফাও কমে যাচ্ছিল। সেই দাম বাড়াতেই আফিম চাষের উপর কিছুটা লাগাম টানতে চেয়েছিল তালিবান। আফিম মজুত করার উপর নিয়ন্ত্রণ রাখা এবং তারপর চাষের পরিমাণ কমিয়ে নেওয়া — এই দুইয়ের উপর ভর করেই আবার আফিমের দাম বাড়াতে চেয়েছিল মোল্লা ওমরের সরকার।

তালিবান রাজে মাদকের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠবে আফগানিস্তান ?

তালিবানের ডেরা কান্দাহার প্রদেশ আফগানিস্তানের আফিম চাষের সবথেকে বড় কেন্দ্রগুলির মধ্যে একটি। সংবাদসংস্থা রয়টার্সে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, কান্দাহারে বছর পয়ত্রিশের এক আফিম চাষি মহম্মদ নাদিরকে প্রশ্ন করা হয়েছিল মার্কিন প্রশাসন গম চাষের জন্য অনুদান দিলেও কেন তাঁরা আফিম চাষ চালিয়ে যাচ্ছেন। জবাবে ওই চাষি জানান, গম বা অন্যান্য ফসল চাষ করে তেমন লাভ হয় না। আফিমের চাষ থেকে তার আয় হবে ৩ হাজার ডলার। অথচ ওই জমিতেই গম চাষ করা হলে, আয় খুব বেশি হলে ১ হাজার ডলার। তবে এই আফিম চাষের টাকা তিনি একা ভোগ করতে পারবেন না। তালিবান ও চোরাচালানকারীদের ভাগ দিতে হবে।

দুই দশক পর ফের একবার আফগানিস্তানের তখতে তালিবান। তালিব মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ সাংবাদিক বৈঠক করে দায়িছেন, নতুন সরকার আফিম চাষ শূন্য করে দেবে। আফিম চাষ বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলতেই বিশ্ব বাজারে তড়তড়িয়ে বেড়েছে আফিমের দাম। সূত্রের খবর, তালিব সরকার আসার পর থেকে বিশ্ব বাজারে আফিমের কেজি প্রতি দর ৭০ ডলার থেকে বেড়ে ২০০ ডলার পার করে গিয়েছে। আর এই অতিরিক্ত মুনাফা তালিবানের হাতে যে যাচ্ছে না, তা হলফ করে বলা যায় না।

আরও পড়ুন : ৩ সন্তান চেয়ে রয়েছে মুখের দিকে, দুরু দুরু বুকেই বিমানবন্দরে যাত্রীদের স্বাগত জানাচ্ছে রাবিয়া