TV9 Explained: ফের গোটা লাতিন আমেরিকা লালে লাল, এল কি ‘দ্বিতীয় গোলাপী জোয়ার’?
Latin America's second 'pink tide': ব্রাজিলের বামপন্থী নেতা লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভার জয়ে বামপন্থীদের পুনরুত্থান নিশ্চিত হল বলে মনে করছেন অনেকে। অনেকেই বলছেন এটা লাটিন আমেরিকায় 'দ্বিতীয় গোলাপী জোয়ার'। সত্যিই কি তাই? লাতিন আমেরিকা কি ফের হাঁটছে 'বাম' দিকে?
রিও ডি জেনেইরো: রবিবার (৩০ অক্টোবর), ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ক্ষমতাসীন জেইর বোলসোনারোর বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়েছেন বামপন্থী নেতা লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা। লুলার এই জয়ের সঙ্গে সঙ্গে লাতিন আমেরিকায় বামপন্থীদের পুনরুত্থান নিশ্চিত হল বলে মনে করছেন অনেকে। বস্তুত, উত্তরে মেক্সিকো থেকে দক্ষিণে চিলি পর্যন্ত, এই অঞ্চলের রাজনৈতিক মানচিত্র ফের একুশ শতকের শূন্য দশকের মতো দেখাচ্ছে। সেই সময় বামপন্থায় আস্থা রেখেছিল প্রায় গোটা লাতিন আমেরিকা। যাকে বলা হয় ‘পিঙ্ক টাইড’ বা ‘গোলাপী জোয়ার’। লুলার জয়ের পর অনেকেই বলছেন এটা ‘দ্বিতীয় গোলাপী জোয়ার’। সত্যিই কি তাই? লাতিন আমেরিকা কি ফের হাঁটছে ‘বাম’ দিকে?
‘পিঙ্ক টাইড’ বা ‘গোলাপী জোয়ার’
একুশ শতকের শুরুতে, লাতিন আমেরিকার গণতান্ত্রিক দেশগুলি ক্রমশ নব্য উদারনৈতিক অর্থনীতি থেকে সরে বামপন্থার দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছিল। বলা যেতে পারে গোটা মহাদেশ জুড়ে তৈরি হয়েছিল বাম ও নরমন্থী বাম রাজনৈতিক তরঙ্গ। এরই পোশাকি নাম ‘গোলাপী জোয়ার’। যার নেতৃত্বে ছিলেন ভেনেজুয়েলার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট হুগো শাভেজ। ১৯৯৮ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। শাভেজ, ব্রাজিলের লুলা এবং বলিভিয়ার ইভো মোরালেসকে বলা হয় গোলাপী জোয়ারের ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’। অর্থনীতিবিদদের মতে সেই সময়ে সারা বিশ্ব জুড়ে মুখ থুবড়ে পড়েছিল বাজার অর্থনীতি। সেই কারণেই লাতিন আমেরিকানরা উদারনৈতিক অর্থনীতির পথ থেকে সরে এসেছিল। একই সময়ে বামপন্থীরাও ক্রমশ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার দিকে ঝুঁকছিল। বামেদের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি, ভর্তুকি এবং সামাজিক কল্যাণমূলক পরিষেবার মতো নীতিগুলি তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।
গোলাপী জোয়ারের নেতারা
আগেই বলা হয়েছে ১৯৯৮ সালে ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন হুগো শাভেজ। ২০০৩ সালে ব্রাজিলে নির্বাচিত হন লুলা। ২০০৬-এ বলিভিয়ায় ইভো মোরালেস। ২০০০ সালে চিলিতে রিকার্ডো লাগোস, ২০০৩-এ আর্জেন্টিনায় নেস্টর কির্চনার, ২০০৭-এ ইকুয়েডরে রাফায়েল কোরেয়া, ২০০৫-এ উরুগুয়েতে তাবারে ভাস্কেজ় – প্রায় গোটা লাতিন আমেরিকার মানচিত্রের রঙ হয়ে গিয়েছিল লাল। এই নেতাদের মধ্যে পার্থক্য ছিল। বাজার অর্থনীতির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গীতে যেমন লুলার সঙ্গে অনেক পার্থক্য ছিল শাভেজের। তবে প্রত্যেকেই নিজ নিজ দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে সফল হয়েছিলেন। লুলার প্রথম মেয়াদে যেমন ব্রাজিলের ৩ কোটি মানুষ দারিদ্রসীমার উপরে উঠে এসেছিল। সামাজিক বৈষম্য মোকাবিলায় নিরন্তর প্রচেষ্টা ছিল সরকারগুলির তরফে। অর্থনৈতিক দিক থেকেও প্রভূত উন্নতি ঘটেছিল।
ভাটার টান
তবে, তার পরের দশকেই ভাটার টান দেখা গিয়েছিল এই গোলাপী জোয়ার আন্দোলনে। একুশ শতকের প্রথম দশকের গোড়াতেই পণ্যের দাম কমে গিয়েছিল। যা রফতানি-নির্ভর লাতিন আমেরিকাকে প্রায় ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। একই সময়ে গোলাপী জোয়ারের বামপন্থী সরকারগুলি কল্যাণমূলক নীতিগুলি টিকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয়েছিল। কারণ, ক্রমে সঞ্চয় কমছিল, ব্যয় হচ্ছিল মাত্রাতিরিক্ত। ফলে, সমর্থকদের গ্রাস করছিল হতাশা। যা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রতিক্রিয়াশীল পরিবর্তনের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল। বামপন্থী সরকারগুলি একে একে প্রত্যাখ্যাত হতে শুরু করে। ২০১৩ সালে শাভেজের মৃত্যুতে তৈরি হয় নেতা সঙ্কটও।
রক্ষণশীল তরঙ্গ
লাতিন আমেরিকা যে বামেদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়েছে, তা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে ২০১৫ সালে। সেই বছরের আর্জেন্টিনার নির্বাচনে মধ্য-ডানপন্থী মৌরিসিও ম্যাক্রির কাছে পরাজিত হন বাম প্রার্থী ড্যানিয়েল সিওলি। এর পর ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট তথা লুলার উত্তরসূরি দিলমা রুসেফ অযোগ্য বলে প্রমাণিত হন এবং পদ থেকে অপসারিত হন। ২০১৭ সালে ইকুয়েডরে সামান্য ভোটে জয় পেয়েছিলেন রাফায়েল কোরেয়ার উত্তরসূরি তথা তাঁর ভাইস-প্রেসিডেন্ট লেনিন মোরেনো। নির্বাচনের পরে অবশ্য তিনি কোরেয়ার সঙ্গে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করে ডানপন্থায় আস্থা রেখেছিলেন। আর ২০১৮ সালে ব্রাজিলের নির্বাচনে অতি-ডানপন্থী প্রার্থী জেইর বোলসোনারোর জয়, লাটিন আমেরিকায় গোলাপী জোয়ারের কফিনে শেষ পেরেক ছিল বলে মনে করা হয়।
দ্বিতীয় গোলাপী জোয়ার?
তবে ইতিহাসের চাকা আবার ঘুরছে। ২০১৯-এ আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নরমপন্থী-বাম প্রার্থী আলবার্তো ফার্নান্দেজ, কর্পোরেটদের পছন্দে ডানপন্থী প্রার্থী মৌরিসিও ম্যাক্রিকে ক্ষমতাচ্যুত করেছেন। ২০২০ সালের অক্টোবরে বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয় পেয়েছেন বামপন্থী লুইস আরকে। গত বছর পেরুর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন বাম শিক্ষক নেতা পেড্রো কাসিলো। চলতি বছরের মার্চ মাসে চিলির ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ প্রেসিডেন্ট হয়েছেন প্রাক্তন বামপন্থী ছাত্রনেতা গ্যাব্রিয়েল বোরিক। আর কলম্বিয়ার ইতিহাসে প্রথমবার বামপন্থী প্রেসিডেন্ট হয়েছেন গুস্তাভো পেট্রো। তাহলে কি সত্যিই লাটিন আমেরিকায় দ্বিতীয় গোলাপী জোয়ার এল?
‘প্রত্যাখ্যানবাদী’ তরঙ্গ
লাতিন আমেরিকার মানচিত্র ফের লালে লাল দেখে মনে হতেই পারে, ফের ‘বাম’দিকে ঝুঁকছে এই মহাদেশ। কিন্তু, বিশ্লেষকদের মতে, এবারের প্রবণতা ভিন্ন। লাতিন আমেরিকার এই জোয়ার এবারের বামমুখী চলা মতাদর্শগত নয়, বরং ‘প্রত্যাখ্যানবাদী’ তরঙ্গের জের। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গোটা বিশ্ব-অর্থনীতি এখন সঙ্কটে রয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারীর বিধ্বংসী প্রভাব দারিদ্র্য এবং সামাজিক বৈষম্যের সমস্যাকে আরও গভীর করে তুলেছে। অধিকাংশ ভোটার অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন। বিশ্বব্যাপী ক্ষমতাসীন সরকারগুলি তাদের উপেক্ষা করেছে, অপমান করেছে বলে মনে করছে সাধারণ মানুষ। আর তাই মানুষ বিকল্প খুঁজছে। এই বিকল্পের খোঁজই লাতিন আমেরিকাকে ‘বাম’দিকে ঠেলে দিয়েছে। ডানপন্থীদের সরিয়ে বামেদের এনে উদ্ধারের আশা করছে গোটা লাতিন আমেরিকা। কিন্তু, যদি এই নতুন প্রজন্মের বাম নেতারা তাঁদের আশাপূরণে ব্যর্থ হন, পরবর্তী নির্বাচনে তাঁদের ছুড়ে ফেলতেও দ্বিধা করবে না মানুষ। এমনটাই মনে করছেন আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা।